মোহাম্মদ সেলিম মিয়া: বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর মহান একুশে ফেব্রুয়ারি। তারিখটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সালের ২নং আইন) জারি করা হয়। এর ধারা ৩-এর বিধান নিম্নরূপ-
(১) এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস-আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।
(২) ৩(১) উপধারায় উলিস্নখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহা হইলে উহা বেআইনি ও অকার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।
(৩) যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তাহলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বিধৃত আছে যে, ‘আদালত’ অর্থ সুপ্রিম কোর্টসহ যে কোনো আদালত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ এবং উল্লিখিত আইনের অধীন আদালতসহ প্রজাতন্ত্রের সব কার্যক্রম ও রাষ্ট্রীয় নথিপত্র বাংলা ভাষায়ই বাধ্যতামূলকভাবে সম্পাদিত হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আইন বিভাগ তথা জাতীয় সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান এবং ১৯৮৭ সালের ২নং আইনের বিধান পুরোপুরি অনুসরণ করছে। নিম্ন আদালতেও তা অনুসরণ করা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হাশমত উল্লাহ্ (মো.) বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায় (৪৪ ডিএল আর ৩৩২-৩৩৮ অনুচ্ছেদ ২০) হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছে যে, সরকার অধস্তন দেওয়ানি আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয় নাই বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে।
হাশমত উল্লাহ্ (মো.) বনাম আজমিরি বিবি ও অন্যান্য মামলায় (৪৪ ডিএল আর ৩৩২-৩৩৮ অনুচ্ছেদ ২০) হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছে যে, সরকার অধস্তন দেওয়ানি আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয় নাই বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে।
এ রায়ে হাইকোর্ট বিভাগ তিনটি পরিভাষার কথা বলেছেন- রাষ্ট্রভাষা, সরকারী ভাষা ও আদালতের ভাষা। এ তিনটি ভাষার মধ্যে আদালতের ভাষা সবচেয়ে সংকীর্ণতম। আদালতের কথায়, রাষ্ট্রভাষা হলো রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম অর্থাৎ নির্বাহী, আইন বিভাগ ও বিচারিক প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহৃত ভাষা। সরকারী কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তা সরকারী ভাষা আর আদালতের কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তাই আদালতের ভাষা। যেহেতু আদালতের ভাষাটি সবচেয়ে সংকীর্ণতম তাই তাকে রাষ্ট্রভাষা বুঝাবে না এবং সেকারনে সংবিধানের ভাষা বিষয়ক স্কীম মানার আবশ্যকীয়তা নাই।
বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি সাধারণ আইন এবং সিভিল প্রসিডিউর কোড বা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বিশেষ আইন। আইনপ্রণেতাগণ বিশেষ আইনের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন এবং যেহেতু বাংলা প্রচলন আইনের মাধ্যমে বিশেষ আইনগুলোর বিধানকে বাতিল করা হয়নি তাই বিচারিক আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের আবশ্যকীয়তা নাই।
আদালতের মতে- বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি সাধারণ আইন এবং সিভিল প্রসিডিউর কোড বা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড বিশেষ আইন। আইনপ্রণেতাগণ বিশেষ আইনের ব্যাপারে সজাগ ছিলেন এবং যেহেতু বাংলা প্রচলন আইনের মাধ্যমে বিশেষ আইনগুলোর বিধানকে বাতিল করা হয়নি তাই বিচারিক আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের আবশ্যকীয়তা নাই। একইসাথে পরবর্তী সাধারণ আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকা ছাড়া পূর্ববর্তী বিশেষ আইনের বিধানকে অমান্য করার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের সংবিধানে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে বাধা না থাকায় এবং বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে সুস্পষ্টভাবে বারণ না করায় বিচারিক আদালতের ভাষা ইংরেজি হতে বাধা নেই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করেন।
ফলে আজ অবধি বিচার কাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি।
দেওয়ানি কার্যবিধির উল্লিখিত ধারা ১৩৭ নিম্নরূপ
১৩৭(১)-এ বলা হয়েছে, অত্র বিধি অর্থাৎ কোড বলবৎ হওয়ার সময় হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন কোনো আদালতের যে ভাষা ছিল, সরকার অন্যরূপ নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত তা উক্ত অধস্তন আদালতের ভাষা হিসেবে প্রচলিত থাকবে।
১৩৭(২)-এ বলা হয়েছে, এরূপ আদালতের ভাষা কী হবে এবং কোন রীতিতে সে আদালতসমূহে আবেদনপত্রসমূহ এবং আদালতের কার্যবিবরণী লিখতে হবে তা ঘোষণা করার অধিকার সরকারের থাকবে।
১৩৭(৩)-এ বলা হয়েছে, যে ক্ষেত্রে এরূপ কোনো আদালতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত অন্য কিছু লিখিতভাবে সম্পাদন করার জন্য অত্র কোর্ট আদেশ বা অনুমোদন করে, তা ইংরেজিতে লেখা যাবে; কিন্তু কোনো পক্ষ বা তার উকিল যদি ইংরেজি ভাষার সহিত পরিচিত না হন, তবে তার অনুরোধক্রমে আদালতের ভাষায় ওই ইংরেজির অনুবাদ তাকে সরবরাহ করা হবে এবং এরূপ ক্ষেত্রে আদালত যেরূপ সঙ্গত মনে করেন, অনুবাদের খরচ সম্পর্কে সেরূপ আদেশ দান করবেন।
দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৮ ধারা সাক্ষ্য ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা সংক্রান্ত।
১৩৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, হাইকোর্ট বিভাগ সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিচারক বা তা না হলে বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষিত কোনো শ্রেণীর বিচারককে এ মর্মে নির্দেশ দিতে পারেন যে, যেসব মোকদ্দমায় আপিল চলে, সেসব মোকদ্দমায় সাক্ষ্য ইংরেজি ভাষায় ও নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
১৩৮(২) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো বিচারক পর্যাপ্ত কারণে (১) উপধারায় বর্ণিত নির্দেশ পালনে বাধাপ্রাপ্ত হন, তবে তিনি সে কারণ লিপিবদ্ধ করবেন এবং প্রকাশ্য আদালতে শ্র“তিলিপির মাধ্যমে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করাবেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ২২১(৬), ৩৫৭(১), ৩৬৬ ও ৩৬৭ ধারা বিচারিক আদালতের অভিযোগ, সাক্ষ্য, রায় প্রদানের পদ্ধতি ও রায়ের ভাষা সংক্রান্ত। উভয় ধারায় যতটুকু ভাষা বিষয়ে প্রাসঙ্গিক সে বিষয়ে আলোকপাত আবশ্যক।
ধারা নং ২২১ (৬)-এ বলা হয়েছে, অভিযোগ ইংরেজী অথবা আদালতের ভাষায় লিখতে হবে।
ধারা নং ৩৫৭ (১)-এ বলা হয়েছে, ধারা ৩৫৬ উল্লিখিত ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি সাক্ষীর সাক্ষ্য মাতৃভাষায় লিখিত হবে।
ধারা নং ৩৬৬ (১)-এ বলা হয়েছে, আদি অধিক্ষেত্রের যে কোনো ফৌজদারি আদালতের প্রতিটি বিচারিক রায় আদালতের ভাষায় অথবা অন্য যে কোনো ভাষায় যা আসামি অথবা তার আইনজীবী বুঝতে সক্ষম সে ভাষায় ঘোষণা অথবা উক্ত রায়ের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতে হবে।
ধারা নং ৩৬৭ (১)-এ বলা হয়েছে, অনুরূপ সকল রায় অত্র বিধির অন্য কোথাও আলাদাভাবে বিবৃত না হলে আদালতে বিচার পরিচালনাকারী কর্মকর্তা স্বহস্তে অথবা তার শ্র“তলিপিতে আদালতের ভাষায় অথবা ইংরেজিতে লিখতে হবে।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারায় বলা হচ্ছে, এই বিধির উদ্দেশ্যে ইহার দ্বারা শাসিত অঞ্চলে অবস্থিত প্রত্যেকটি আদালতের ভাষা কি হবে সরকার তা নির্ধারণ করতে পারবেন।
হাইকোর্ট বিভাগ রুলসে সুনির্দিষ্টভাবে কোন ভাষায় হাইকোর্ট বিভাগের রায় ও সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হবে সে বিষয়ে উল্লেখ না থাকলেও ৪র্থ অধ্যায়ের ১নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্টে দাখিলকৃত দরখাস্তসমূহের ভাষা হবে বাংলা/ইংরেজি এবং হাইকোর্ট রুলসের ৫ম অধ্যায়ের ৬৯নং বিধিতে বলা হয়েছে, হাইকোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ ও ডিক্রি দেওয়ানী কার্যবিধির এপেনডিক্স-জি ও ফর্ম-৯ অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রুলস বা অন্য কোনো আইনে পৃথকভাবে আপিল বিভাগ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে কোন ভাষা ব্যবহার করবে সে বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকলেও আপিল বিভাগ রুলসে আদেশ নং ঠওও (২)-এ বলা হয়েছে, এ আদালতের সম্মুখে পরিচালিত বিচার কার্যে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কোনো দলিল প্রদর্শিত বা ব্যবহৃত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না উহা এ বিধি অনুযায়ী অনুমোদিত না হয়।
এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার উচ্চতর ও অধীনস্থ বিচার বিভাগে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য আদালতের ভাষা বাংলা মর্মে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা ৫৫৮ এর অধীন একটি এবং দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ১৩৭(২) এর অধীন একটি অর্থাৎ মোট দুটি ঘোষণাপত্র জারি করতে পারে।
প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র দুটি জারি করা হলে আদালতে তা অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব তৎপুর্বে ইংরেজিতে রচিত বিদ্যমান আইনসমূহ নির্ভরযোগ্য বাংলায় অনুবাদ ত্বরান্বিত করা জরুরি এবং ইহা রাষ্ট্রের দায়িত্বও বটে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ আইন কমিশন ও বাংলা একাডেমি জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া মন্ত্রণালয়সমূহের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুবাদ কাজ বেগবান করা এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল এবং উদ্যোগী করে গড়ে তোলাও প্রয়োজন।
সুপ্রিম কোর্টে অধিকাংশ বিচারপতির ইংরেজি ভাষায় দেওয়া রায় ও আদেশ সাধারণ মানুষের বোধগম্য করাতে তা দ্রুত অনুবাদ করা উচিৎ এবং একটি অনুবাদ সেল গঠন করা উচিৎ সুপ্রিম কোর্টের।
বাংলা ভাষাকে আদালতের ভাষা হিসেবে শতভাগ চালু না করায় রাষ্ট্রের সব নাগরিক তাদের সাংবিধানিকভাবে পাওয়া মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংবিধান আমাদেরকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা ও চর্চায় নিষেধ করেনি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ও উন্নতি করতে হলে ইংরেজি ভাষা চর্চা ও উন্নতভাবে শিখতে হবে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অফিসের ভাষা, ইংরেজি ব্যতীত শিক্ষার ভাষা, সাইন বোর্ড, বিল বোর্ডের ভাষা, পত্র যোগাযোগ, গণমাধ্যমের ভাষা অবশ্যই বাংলা হতে হবে।
উল্লেখ্য, জাপান, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মানির মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়া, তুরস্কের মতো কম প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রয়োজন ছাড়া ইংরেজি ব্যবহার করে না। বাংলা ভাষার জন্য এ দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।