শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: মানুষের নিরাপত্তাবিধান ও কল্যাণসাধনের জন্য নানা ধরনের আইন জারি করা হয়। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন নিয়ম-আইন-কানুনের সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। যুগে যুগে দেশে দেশে মানুষের উপকারের জন্য আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের আইন জারি করা হচ্ছে। এরই অনুবৃত্তিক্রমে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ (২০০৯ সনের ২৬নং আইন) প্রবর্তিত হয়েছে। ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন হচ্ছে ক্রেতা সাধারণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য আইন।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত ক্রেতার অধিকার এখন আন্তর্জাতিকভাবে মেনে চলা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এ ধরনের আইন বহু পূর্বেই জারি করা হয়েছে। এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্তা-অধিকার আইনটি অপেক্ষাকৃত নতুন। এ আইনটি বাংলাদেশে প্রচলিত কল্যাণকর আইনসমূহের মধ্যে অন্যতম। আইনটি দীর্ঘ দিনের চাহিদার ফসল।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন দেশের সকল মানুষ এবং অনাগত মানবশিশুকেও স্পর্শ করে। কেননা, একটি দেশের অনাগত বা মাতৃগর্ভ শিশুও একজন ভোক্তা হিসেবে সঠিক প্রয়োজনীয় দ্রব্য সেবাদি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। ভোক্তা-অধিকার মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই ভোক্তা অধিকার আইন বাস্তবায়িত হয়েছে।
জানা যায়, ক্রেতা সাধারণদেরকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে নেদারল্যান্ডের হেগে একটি সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ অংশগ্রহণ করে। এরই ফলে আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠন গঠিত হয়। সংগঠনটির নাম হয় International Organization of Consumers Union. এ প্রেক্ষিতে সর্বপ্রথম ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়। তবে ১৯৬২ সালের আগে বিশ্বে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এজন্য ক্রেতা সাধারণ নানা প্রতারণার স্বীকার হতো।
আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি ক্রেতা সাধারণদের অনুকূলে কংগ্রেসে এক ভাষণ দেন। এ ভাষণে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার সংক্রান্ত কয়েকটি অধিকারের বিষয়ে তুলে ধরা হয়। তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করা হয়- একজন ভোক্তার অন্যতম ৪টি অধিকার রয়েছে: নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং প্রতিকার পাওয়ার অধিকার। এই অধিকারগুলো পরবর্তীকালে ভোক্তা-অধিকার নামে পরিচিত লাভ করে। ফলে মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তা-অধিকারগুলো অনুমোদন লাভ করে আইনি স্বীকৃতি পায়। এভাবে পৃথিবীতে ক্রেতার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ভোক্তা-অধিকার রক্ষার জন্য প্রণীত নীতিমালায় জন এফ কেনেডির ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত বক্তৃতার বিষয়গুলোকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এরই অনুবৃত্তিক্রমে জাতিসংঘের ঘোষিত ১৫ই মার্চকে প্রতি বছর বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভোক্তা-অধিকার দিবস পালন করা হচ্ছে।
পরবর্তীকালে জন এফ কেনেডির বক্তৃতায় বর্ণিত ভোক্তা-অধিকারগুলোকে বিস্তৃত করে জাতিসংঘ ৮টি অধিকারকে ভোক্তা-অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এগুলো হচ্ছে- মৌলিক চাহিদাপূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, শিক্ষালাভের অধিকার এবং সুস্থ পরিবেশে থাকার অধিকার। এই অধিকারগুলো ভোক্তার-মৌলিক মানবাধিকার।
বাংলাদেশ এই অধিকারগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে ও মেনে চলছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬ক থেকে ৪৭ক পর্যন্ত বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। এছাড়াও ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত প্রচলিত বেশ কয়েকটি আইন জারি আছে। প্রায় প্রচলিত চল্লিশটিরও অধিকার এসংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। এছাড়াও ভোক্তা-অধিকার সংক্রান্ত প্রচলিত আইন জারি আছে। প্রায় প্রচলিত চল্লিশটিরও অধিক এ সংক্রান্ত আইন করা হয়েছে। যেমন- তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯; নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩; পণ্য বিক্রয় আইন, ১৯৩০; ওজন ও পরিমাপ আইন, ১৯৮২; অত্যাবশ্যক পণ্য সামগ্রী আইন, ১৯৫৬ প্রভৃতি আইন।
বাংলাদেশে ভোক্তা-অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালের ৬ই এপ্রিল ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন জারি করা হয়। এ আইনে বলা হয়েছে ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্যক্রম রোধ ও এ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য এ আইনে প্রণীত হয়েছে। বক্ষ্যমান এ আইনের ৮২টি ধারা ও অনেক ধারার উপধারা রয়েছে। ভোক্তা-অধিকার আইনটি বিস্তৃত পরিসরের আইন। এ আইনে খাদ্য, পণ্য, ঔষধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবাকে ভোক্তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ১৮ থেকে ২১ ধারায় বর্ণিত বিধানুযায়ী গঠিত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রকাশিত লিফলেটে (leaflet) এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নে উক্ত লিফলেটের আলোকে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর বিধানুযায়ী ভোক্তা-অধিকার ও দায়িত্ব, ভোক্তা-অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ এবং দণ্ড সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
ভোক্তা-অধিকার: জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা-অধিকার ৮টি। যথা-
১. মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বিধৃত।)
২. তথ্য পাওয়ার অধিকার (তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এই বিষয়ে বিধৃত।
৩. নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার;
৪. পছন্দের অধিকার
৫. জানার অধিকার
৬. অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার,
৭. ভোক্তা-অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভের অধিকার এবং
৮. সুস্থ পরিবেশের অধিকার
জাতিসংঘ স্বীকৃত উক্ত ৮টি অধিকার ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-সহ প্রচলিত অন্যান্য চল্লিশটিরও অধিক আইনে বিধৃত রয়েছে।
এ আইনের বিধানুযায়ী ভোক্তা-অধিকার আইনের উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:
১. ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়ন;
২. ভোক্তা-অধিকার বিরোধীকার্য প্রতিরোধ;
৩. ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ নিষ্পত্তি;
৪. নিরাপদ পণ্য বা সেবা নিশ্চিতকরণ;
৫. পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা;
৬. পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারণা রোধ;
৭.ভোক্তা-অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
আইনটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ।
এ আইনানুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ ভোক্তা। যিনি পুনঃবিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত কোনো ক্রেতা মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন: বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করে বিক্রয় করেন।
এ আইনানুযায়ী ভোক্তার ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিম্নরূপ:
১. ভোক্তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানা
২. ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের সুফল সম্পর্কে জানা
৩. ভোক্তার অধিকার বিরোধী কার্যের কুফল সম্পর্কে জানা
৪. যাচাই বাছাই করে সঠিক পণ্য বা সেবা সঠিক মূল্যে কেনা
৫. ভোক্তার অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া এবং
৬. অভিযোগ দায়ের করা।
ভোক্তার অধিকার আইনানুযায়ী নিম্নোক্তগণ বিক্রেতা। যথা- কোনো পণ্যের
১. উৎপাদনকারী বা প্রস্তুতকারী
২. সরবরাহকারী
৩. পাইকারী বিক্রেতা
৪. খুচরা বিক্রেতা
বিদ্যমান আইনানুযায়ী নিম্নোক্ত কার্যাবলি ভোক্তার অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ।
১. নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা
২. জেনেশুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বিক্রয়ের প্রস্তাব করা;
৩. স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নিষিদ্ধ দ্রব্য কোনো খাদ্য পণ্যের সাথে মিশ্রণ ও বিক্রয় করা;
৪. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা;
৫. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা;
৬. ওজনে কারচুপি করা
৭. বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা
৮. পরিমাপে কারচুপি করা;
৯. দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা,
১০. কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা,
১১. মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা,
১২. নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো কার্য করা যাতে সেবা গ্রহিতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।
১৩. অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা;
১৪. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহিতার অর্থ বা স্বাস্থ্য বা জীবনহানি, ইত্যাদি ঘটানো।
১৫. কোনো পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে পণ্যের উপাদান, খুচরা বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণদের তারিখ, ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা;
১৬. আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠান সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা লটকিয়ে প্রদর্শন না করা;
১৭. আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ না করা এবং সংশ্লিষ্ট স্থানে বা সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে উক্ত তালিকা লটকিয়ে প্রদর্শন না করা।
আলোচ্য আইনানুযায়ী নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযোগকারী হবেন।
১. কোনো ভোক্তা
২. একই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা,
৩. কোনো আইনের অধীনে নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা,
৪. জাতীয় ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা তার পক্ষে অভিযোগ দায়েরর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা,
৫. সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা;
৬. সংশ্লিষ্ট পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি।
উল্লেখ্য, ভোক্তার সমস্যার উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করতে হয়। দায়েরকৃত অভিযোগ অবশ্যই লিখিত হতে হবে। ফ্যাক্স, ইমেইল, ওয়েবসাইট, ফেইসবুক ইত্যাদি ইলেক্টনিক মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে অভিযোগ দায়ের করা যাবে। অভিযোগের সাথে পণ্য ক্রয়ের প্রামাণাদি সংযুক্ত করতে হবে। অভিযোগকারীর পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ইমেইল নম্বর (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে।
ভোক্তার অধিকার অধিকার লঙ্ঘনে এ আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় নানা ধরনের শাস্তি এবং জরিমানার বিধান রয়েছে। এ আইনের বিধানুযায়ী ভোক্তা-অধিকার বিরোধীকার্য ও অপরাধ এবং দণ্ডসমূহ নিম্নরূপ:
(ক) অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ হবে-
১. পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা বা মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লেখা না থাকা।
২. পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও লটকায়ে প্রদর্শন না করা;
৩. নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা ক্রিয়ের প্রস্তাব করা;
৪. প্রতিশ্রুতি পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা;
৫. নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা;
৬. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা;
৭. ওজনে, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা;
৮. পরিমাপে, দৈঘ্য পরিমাপকে ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা;
৯. মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
(খ) ভোক্তা-বিরোধী কার্য ও অপরাধ করলে অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ- মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে।
(গ) অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ- অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা।
(ঘ) অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ- মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলাদায়ের করা।
(ঙ) অনধিক ৩ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধ-
১. জেনেশুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা;
২. খাদ্য পণ্যে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ ও বিক্রয় করা।
৩. পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন করা।
৪. সেবা গ্রহিতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা;
৫. অবহেলা, দায়িত্বহীন দ্বারা সেবাগ্রহিতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানী ইত্যাদি ঘটানো।
(চ) অপরাধ পুনঃসংঘটনের দণ্ড: উক্ত অপরাধসমূহে দণ্ডিত ব্যক্তি পুনরায় একই অপরাধ করলে তিনি সর্বোচ্চ দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এ আইনে ফৌজদারি প্রতিকার পাওয়া যায়। যথা-
১. ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধসমূহ প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে বিচার্য।
২. জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর উচ্চতর শাস্তি বিধানকল্পে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করতে পারবে;
৩. অভিযোগকারী ফৌজদারি মামলা। সরাসরি দায়ের করতে পারবেন না;
৪. অভিযোগ দায়ের হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ফৌজদারি মামলা দায়েরের লক্ষ্যে অভিযোগপত্র ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বা বিশেষ ট্রাইবুনালে দাখিল করতে হবে।
৫. আরোপিত ও আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্য হবেন।
এ আইনে ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধের জন্য দেওয়ানি আদালতে প্রতিকার পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রম সূচিত হওয়ার কিংবা ঐ ব্যক্তি অনুরূপ কার্যের জন্য ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ভোক্তা ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে স্থানীয় অধিক্ষেত্রের যুগ্ম জেলা জজের আদালতে দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে পারবেন।
এ আইনে ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধ অভিযোগের প্রশাসনিক প্রতিকার রয়েছে। যথা-
১. জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা সমীচীন মনে করলে ফৌজদারি মামলা দায়েরের পরিবর্তে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শুধু জরিমানা আরোপ, ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম সামরিক বা স্থায়ীভাবে স্থগিত করতে পারবেন। উল্লেখ্য, আইনের বিধানুযায়ী জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর একটি Quasi Judiciary বা আধাবিচারিক সংস্থা।
২. প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আরোপিত ও আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্য হবেন।
এ আইনের বিধানুযায়ী ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ফৌজদারি আপিল দায়ের করতে পারবে। সংক্ষুব্ধ পক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংক্ষুব্ধ আদেশের প্রদানের ৬০ দিনের মধ্যে স্থানীয় অধিক্ষেত্রের সেশন জজের আদালতে আপিল দায়ের করতে পারবেন।
ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধের দেওয়ানি শাস্তির প্রাপ্ত পক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংক্ষুব্ধ দেওয়ানি রায় ও ডিক্রির আদেশ প্রদানের ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে আপিল দায়ের করা যাবে।
ভোক্তা-অধিকার বিরোধী অপরাধের জন্য জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রশাসনিক আদেশের ফলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করতে পারবেন।
ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ একটি জনকল্যাণমূলক আইন। এ আইন ভোক্তাদের কল্যাণসাধন করছে। তবে আইনটি জারি হওয়ার পর একযুগ পেরিয়ে গেছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আইনের সময়োপযোগী করতে হয়। ভোক্তা-অধিকার আইন জারি হওয়ার সময়ে ই-কমার্স বা অনলাইন বেচাকেনা তেমন ছিল না। বর্তমানে সময়ে ই-কমার্স ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করছে। এ আইনের বিধানুযায়ী কোনো অভিযোগকারী সরাসরি আদালতে অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। অভিযোগকারীকে ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ করতে হয় যা অভিযোগ দায়ের বাধা। কিন্তু এ বিষয়ে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ কার্যকর বিধানের সীমাব্ধতা রয়েছে। ফলে ক্রেতা বা ভোক্তাগণ প্রতারিত হচ্ছে। এছাড়া এ আইনে অধিদপ্তরের সংক্ষুব্ধ আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের বিধান নেই।
এই অবস্থায়, সময় ও বাস্তবতার নিরীক্ষে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইনটি সংশোধন হওয়া প্রয়োজন। এবং জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে ভোক্তা-অধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আইন পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা রাখার বিধান চালু করা। এক্ষেত্রে দেশব্যাপী কয়েকজন আইনজীবী পরামর্শক নিয়োগ রাখার বিধান আইনে যুক্ত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ভোক্তার অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ভোক্তা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা।
সর্বোপরি, বিদ্যামান ২০০৯ সালের ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা, সংবিধানিক আইন ও আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত করছে।
লেখক: গবেষক