দেড় শত বছরের পুরনো ইংরেজ আমলে প্রণীত সাক্ষ্য আইন (এভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৭২) আধুনিক ও যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বিদ্যমান আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। সংশোধনী চূড়ান্ত হলে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে ধারণ করা ছবি, ভিডিও, অডিও রেকর্ডিং মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে।
ইতোমধ্যেই সাক্ষ্য আইনের প্রাথমিক খসড়া প্রণয়ন করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এরপর এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিক মতবিনিময় সভাও করেছে সরকার। খসড়ার ওপর অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। খসড়াটি চূড়ান্ত হলে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদনের পর তা সংসদে পাঠানো হবে।
এ আইনের কয়েকটি বিতর্কিত ধারা বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি খসড়ায় ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা সংক্রান্ত সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) এবং ১৪৬(৩) ধারা দুটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। আইনটির সংশোধনী পাস হলে দেশে বিচারাধীন মামলার গতি বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছে আইন মন্ত্রণালয়। বিচার প্রক্রিয়ায় এ সংশোধনী যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে তাদের আশা।
হত্যা, সন্ত্রাস, হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণসহ এ জাতীয় অপরাধে মামলা হয় ফৌজদারি আইনে। আর জমি ও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের মামলা হয় দেওয়ানি আইনে। এ দুই ধরনের আইনের মামলা তদন্ত, পরিচালনা আর বিচারের জন্য রয়েছে একাধিক আইন। সিভিল প্রসিডিউর কোড (দেওয়ানি কার্যবিধি) এবং ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড (ফৌজদারি কার্যবিধি) ছাড়াও সাক্ষ্য আইন এখানে মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। কোনো ব্যক্তি প্রতিকার দাবি করে মামলা করলে তার অধিকারের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে হয়। এ কারণে ১৮৭২ সালে উদ্ভব হয় সাক্ষ্য আইনের।
এ আইনটি এখন পর্যন্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পুরোনো আইনটির পরিবর্তনের দাবি জানানো হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ আইনটি সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। দ্রুত সময়ে বিচার শেষ এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ডিজিটাল সাক্ষ্যপ্রমাণ বর্তমান সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিচারব্যবস্থায় ডিজিটাল সাক্ষ্যপ্রমাণ যুক্ত করার সময় এসেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সাক্ষ্য আইনের ওপর ভিত্তি করে দেশের সব আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করা হয়। মামলায় কে সাক্ষ্য দিলেন, কী সাক্ষ্য দিলেন, কীভাবে সাক্ষ্য দিলেন এবং ওই সাক্ষীর সাক্ষ্যে পুনরায় জেরা করা বা সাক্ষ্য দেওয়ারও বিধান আছে। সাক্ষ্যের ওপর নির্ভর করে অপরাধ প্রমাণিত হওয়া বা না হওয়া।
ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে মামলার বিচার পরিচালনায় কীভাবে একজন সাক্ষীর কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে, কোনটি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয়, তা উল্লেখ রয়েছে সাক্ষ্য আইনে। এ আইনে মৌখিক ও দালিলিক নামে দুই ধরনের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এখানে ডিজিটাল রেকর্ডকে সাক্ষ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির কথা বলা নেই।
তবে দ্রুত বিচার আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দায়ের করা মামলায় ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে গৃহীত অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্র সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
এখন সাক্ষ্য আইন সংশোধনের প্রাথমিক খসড়ায় ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ বলতে কোনো ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল, ম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল বা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র বা সিস্টেমকে বোঝানো হয়েছে। সংঘটিত অপরাধের অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্র এসব যন্ত্র ও সিস্টেমের মাধ্যমে রেকর্ড করে তা মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যথাযথ নিরাপত্তা না থাকায় অনেক চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষীকে হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাক্ষীর প্রতি হুমকির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ফলে ভয়ে তারা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চান না। তা ছাড়া সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। কোনো কোনো সময় মামলার প্রকৃত আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, বিদ্যমান পুরোনো সাক্ষ্য আইনটি এখনও কার্যকর। তবে ডিজিটাইজেশন একটি নতুন বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষ্য আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সাক্ষ্য আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি বাংলা ভাষায় করা হলেও সাক্ষ্য আইন ইংরেজিতেই করা হবে। এর কারণ, কিছু আইন ইংরেজিতে থাকা প্রয়োজন বলে মন্ত্রিসভায় ইতোপূর্বে আলোচনা হয়েছে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা অনেক জরুরি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন নামে আইন রয়েছে। অন্য দেশগুলোর আদলে আমাদের দেশেও এটা করা যেতে পারে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, পুরোনো সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা হলে বিচার বিভাগের উৎকর্ষতা ও উন্নয়নে সহায়ক হবে। পুরোনো আইনের অনেকগুলো ধারা সংযোজন-বিয়োজন করা হবে। সাক্ষ্য আইন সংশোধন করা একটা ভালো উদ্যোগ।