র্যাগিংয়ের ঘটনায় জড়িত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) চার শিক্ষার্থীকে এক সেমিস্টারের জন্য বহিষ্কার এবং আরও ৩১ শিক্ষার্থীকে বুয়েটের হল থেকে বহিষ্কার করা সঙ্ক্রান্ত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে।
রায় প্রদানকারী বিচারকগণের স্বাক্ষরের পর আজ বুধবার (২ মার্চ) এ সংক্রান্ত রায়ের ৩০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে, গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিল সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে এ রায় দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার অনিক আর হক ও আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
রায়ে র্যাগিং নিয়ে আদালত যা বললেন
এখনকার দিনে র্যাগিং একটি সামাজিক-আইনি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক আশা ও প্রত্যাশা নিয়ে উচ্চ শিক্ষা জীবন শুরু করতে আসা শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙ্গে দেয় র্যাগিং। গুরুতর আঘাতসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি, এটি একই সাথে ভুক্তভোগীর মনে গুরুতর মানসিক চাপ এবং ট্রমা সৃষ্টি করে। এতে অনেকে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়ে, ফলে ভুক্তভোগীর কর্মজীবনের সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়াও র্যাগিং -এর চরম পর্যায়ে আত্মহত্যা ও অপরাধমূলক হত্যার ঘটনাও ঘটতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে, সামাজিক-অ্যাকাডেমিক এই ব্যাধিকে প্রতিহত করার জন্য, সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে) র্যাগিংয়ের নামে যে কোনও ধরণের কার্যকলাপ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে) র্যাগিং বিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণে কঠোর হতে হবে।
অতএব, সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজসহ) র্যাগিং এর নামে কার্যকলাপগুলিকে প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করবে:
১. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান র্যাগিং-এর নামে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এবং এ সংক্রান্ত সব ধরনের কার্যকলাপ/সমাবেশ/পারফরম্যান্সে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ করতে দেবে না।
২. র্যাগিংয়ের আড়ালে ঘটতে পারে এমন ঘটনাগুলির উপর নজরদারি নিশ্চিত করার জন্য সকল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিজিল্যান্স কমিটি (vigilance committee) থাকা উচিত। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আবাসিক হল সহ তাদের নিজ নিজ প্রাঙ্গনে র্যাগিং-এর ঘটনার বিরুদ্ধে রিপোর্ট না করা বা নিষ্ক্রিয়তার জন্য দায়ী হবে।
৩. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে র্যাগিং করার পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়গুলো প্রকাশ করবে।
৪. সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা সম্বলিত পোস্টার টাঙাতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের র্যাগিং করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করবে।
৫. নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগে শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে অঙ্গীকারের আকারে একটি হলফনামা নেওয়া যেতে পারে যাতে কোনো শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ে জড়িত থাকলে তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।
৬. “র্যাগিং” বা অন্য কোন শব্দ যাই ব্যবহার করা হোক না কেন, যখনই, এ ধরণের ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধের উপাদান থাকবে, কর্তৃপক্ষকে প্রচলিত আইনের অধীনে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শাস্তিমূলক অধ্যাদেশের অধীনে সকলের ভালোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাধীদের বহিষ্কারের মতো কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মামলার প্রেক্ষাপট
২০১৮ ও ২০১৯ সালে র্যাগিংয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে বুয়েটের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বহিষ্কার ও আবাসিক হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব রেসিডেন্স অ্যান্ড ডিসিপ্লিন কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই শাস্তি দেওয়া হয়।
দণ্ডপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা শাস্তির কপি হাতে পাওয়ার পর এর বিরুদ্ধে একাডেমিক কাউন্সিলে আপিল করেন। কিন্তু তা খারিজ হয়। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালে ৩৫ শিক্ষার্থী হাইকোর্টে পৃথক রিট করেন। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বরে বুয়েটে র্যাগিংয়ের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের শাস্তি আরোপে একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় সুযোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় বুয়েট কর্তৃপক্ষ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টকে এ সংক্রান্ত রুল ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় আপিল বিভাগের নির্দেশনার আলোকে রুল নিষ্পত্তি করে রায় দেন হাইকোর্ট।