যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকা (ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ—আইডব্লিউওসি) পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মঙ্গলবার (৮ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বছর আইডব্লিউওসি পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করেছে।
পরিবেশ রক্ষা এবং বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় তাঁর ব্যতিক্রমী সাহসী ভূমিকা ও নেতৃত্বের জন্য সম্মানজনক এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আরও ১১ জন নারী নিজ নিজ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় এই পুরস্কার পাচ্ছেন।
১৪ মার্চ এক ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত নারীদের সম্মান জানানো হবে। এ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সেখানে উপস্থিত থাকবেন। মার্কিন ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন পুরস্কারপ্রাপ্ত নারীদের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন।
এ বছরের আইডব্লিউওসি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত অন্য নারীরা হলেন ব্রাজিলের সিমোন সিবিলিও দো নাসিমেনতো, মিয়ানমারের এই থিনজার মং, কলম্বিয়ার হোসেফিনা ক্লিনজার জুনিগা, ইরাকের তাইফ সামি মোহাম্মদ, লাইবেরিয়ার ফাসিয়া বোয়েনোহ হারিস, লিবিয়ার নাজলা মানগোউস, মলডোভার ডোইনা ঘেরমান, নেপালের ভূমিকা শ্রেষ্ঠা, রোমানিয়ার কারমেন ঘেওরঘে, দক্ষিণ আফ্রিকার রোয়েগসান্ডা পাসকো এবং ভিয়েতনামের ফম দোয়ান ত্রাং।
প্রসঙ্গত, ২০০৭ সাল থেকে এ পুরস্কার দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বছর পুরস্কারের ১৬তম বছর। এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৮০টির বেশি দেশের ১৭০ জনের বেশি নারীকে আইডব্লিউওসি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, লৈঙ্গিক সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠায় যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ঝুঁকি নিয়ে ও ত্যাগ স্বীকার করে ব্যতিক্রমী সাহস দেখান ও নেতৃত্ব দেন, তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
রিজওয়ানা হাসানের পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জ, যদিও জন্মেছেন ঢাকার ধানমন্ডিতে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি। বাবা সৈয়দ মহিবুল হাসান, মা সুরাইয়া হাসান। বাবা-মায়ের একমাত্র কন্যা তিনি এবং পরিবারে সবার ছোট। পরবর্তীতে সহপাঠী আইনবিদ ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি তিন সন্তানের জননী: মেয়ে নেহলা, দুই ছেলে যাবির ও জিদান।
শিক্ষাজীবন
রিজওয়ানা হাসান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্রথমে লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হলেও আইনের প্রতি আগ্রহ থেকে পরে বিভাগ পরিবর্তন করে আইন বিভাগে ভর্তি হন। এবং সেখান থেকে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে এলএলএম সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশের বাইরে বেশ কয়েকটি ফেলোশিপ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ করেন।
কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে যোগ দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)-তে। বেলা-ও তখন মাত্র যাত্রা শুরু করেছে। এরপর ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বেলা’র সংগঠক ও প্রধান মহিউদ্দিন ফারুক মৃত্যুবরণ করলে রিজওয়ানা ‘কমনওয়েলথ বৃত্তি’র সুযোগ হাতছাড়া করে বেলা’র প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেন। বেলা’র হাত ধরেই লড়ে চলেন পরিবেশের ক্ষতিসাধনকারী নানা চক্র আর ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে।
১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনের সময় প্রার্থীরা পুরান ঢাকায় অন্যায়ভাবে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে প্রচারকাজ চালাচ্ছিলেন। বেলা’র মাধ্যমে জনস্বার্থে আদালতে মামলা করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তৈরি করলেন একটি মাইলফলক। আদালত এই কাজকে জনস্বার্থের বিপরীত বলে রায় দেয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এজাতীয় কাজ বন্ধে উদ্যোগ নেয়।
এরপর তিনি জাহাজ ভাঙা শিল্পের মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনা ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে লড়াই শুরু করেন। তিনি বেলা’র মাধ্যমে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডগুলোর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশের নিরাপত্তাহীনতা, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাহীনতা, এ শিল্প থেকে যথেচ্চ বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি কারণে।
এরপর শ্রমিকদের অধিকার আদায়, বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধে করেছেন আরো তিনটি মামলা। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসেই আদালতের রায়ে ‘পরিবেশগত ছাড়পত্র’ ছাড়া জাহাজ ভাঙার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
এছাড়াও জলাশয় ভরাট করে আবাসন তৈরি, পলিথিনের যথেচ্চ ব্যবহার, পাহাড় কাটা, বন ধ্বংস, চিংডির ঘের, সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে যেখানেই পরিবেশের ক্ষতি সাধিত হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানেই তিনি এবং তার নেতৃত্বে বেলা, পরিবেশ রক্ষায় আইনিভাবে এগিয়ে এসেছে।
আরো যত সংগঠনে জড়িত
তিনি বেলার প্রধান নির্বাহী ছাড়াও ফেডারেশন অফ এনজিওস ইন বাংলাদেশ-এর সহসভাপতি, এনজিও এরডিআরএস-এর সভাপতি। এছাড়া তিনি “নিজেরা করি” সংগঠন ও এসোসিয়েশন অফ ল্যান্ড রিফর্মস এন্ড ডেভলপমেন্ট-এর একজন সদস্য। বেসরকারি এসব কাজ ছাড়াও তিনি সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটির সদস্য।
এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিকভাবে ফ্রেন্ডস অফ আর্থ ইন্টারন্যাশনাল-এর নির্বাহী সদস্য; এনভায়রনমেন্টাল ল’ এলায়েন্স ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং এনভায়রনমেন্টাল ল’ কমিশন অফ দ্যা আইইউসিএন-এর সদস্য। পাশপাশি তিনি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করছেন সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অফ এনভায়রনমেন্টাল এক্টিভিস্ট (SAANS)-এ।
প্রকাশনা
রিজওয়ানার উদ্যোগে বেলা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু পরিবেশ রক্ষা ও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের ভূমিকা সংক্রান্ত প্রকাশনা। এছাড়াও তার ব্যক্তিগত প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে: ল’জ রেগুলেটিং এনভায়রনমেন্ট ইন বাংলাদেশ; এবং জুডিসিয়াল ডিসিশনস অন এনভায়রনমেন্ট ইন সাউথ এশিয়া।
সম্মাননা
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা তৈরির কারণে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রথমবারের মতো আয়োজিত “পরিবেশ পুরস্কার”-এ ভূষিত হোন। তার পরিচালিত সংগঠন বেলা ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম ঘোষিত গ্লোবাল ৫০০ রোল অফ অনার্স পুরস্কারে ভূষিত হয়।
প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পেয়েছেন ‘পরিবেশের নোবেল’ খ্যাত “গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজ”। তার এসব নানামুখি কর্মকান্ডের কারণেই ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকী তাকে “হিরোজ অফ এনভায়রনমেন্ট” খেতাবে ভূষিত করে।
এছাড়া তিনি ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে নেপালভিত্তিক ক্রিয়েটিভ স্টেটমেন্টস এ্যান্ড সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ প্রদত্ত “সিলেব্রেটিং ওমেনহুড এওয়ার্ড”প্রাপ্ত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম পাঁচজন নারীর একজন। এছাড়াও তিনি ২০১২ সালে এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসেবে বিবেচ্য ফিলিপাইনভিত্তিক রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।