মো. শহীদুল্লাহ মানসুর: কয়েক মাস আগের কথা, এক মেয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ায় তার কাছে থাকা মোবাইল নম্বর কোথায় অবস্থান করছে তা ট্র্যাক করতে সিম অপারেটরে চাকরিরত পরিচিত এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে কয়েকবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি বারবার বলেছিলেন, আমরা সাধারণ কোন ব্যক্তিকে কোন ধরণের তথ্যই দিতে পারি না, তবে শুধুমাত্র তদন্তের প্রয়োজনে পুলিশ বা তদন্তকারী কর্মকর্তাকে দিতে পারি।
এখান থেকে বুঝা যায়, সিম অপারেটররাও চাইলে কারো ফোন কল বা অবস্থান বা অন্যকোন তথ্য আড়ি পেতে শোনা বা সংরক্ষণ করার কোন অধিকার রাখেনা বরং এটি নৈতিকভাবে ও আইনত অপরাধ, সেখানে সাধারণ মানুষ কিভাবে অন্যের ফোন কল রেকর্ড করতে পারে তা আবার ফাঁসও করতে পারে? আইনত তা পারে না বা পারা উচিৎও নয়, আইন থেকেই বিশ্লেষণ করা যাক;
নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ(International Covenant on Civil and Political Rights) এর ১৭ অনুচ্ছেদ, জাতিসংঘের শিশু সুরক্ষা(UNCRC) সনদের ১৬ অনুচ্ছেদ এবং জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার’সের ১৪ অনুচ্ছেদে “ব্যক্তিগত গোপনীয়তা” কে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে বা মানহানি সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে কেউ চাইলেই ইচ্ছামতো কথা বলতে বা লিখতে পারে না বা পারবে না।
সংবিধানের ৪৩ (খ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোন নাগরিককে তল্লাশী বা আটক করতে হলে সে নাগরিকের নিরাপত্তা লাভের অধিকার থাকবে এবং চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। এখানে অন্যান্য বলতে যতভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব, যা হালের ফেসবুক কিংবা ইমো বা ইত্যাদি সব যোগাযোগ মাধ্যমও হতে পারে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ৪৭ ধারা অনুযায়ী, তদন্তের স্বার্থে কোনো ব্যক্তি, সত্তা বা সেবা প্রদানকারী কোনো তথ্য প্রদান বা প্রকাশ করলে উক্ত ব্যক্তি, সত্তা বা সেবা প্রদানকারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি আইনে অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। তবে তদন্তের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি, সত্তা বা সেবা প্রদানকারীর তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্যাদির গোপনীয়তা রক্ষা করবেন। এক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তি উক্ত বিধান লঙ্ঘন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৫ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক বা মিথ্যা জানা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন তাহলে উক্ত প্রকাশ বা প্রচার একটি
অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং তিনি অনধিক ৩ (তিন) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার একই অপরাধ বারবার ঘটালে অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৬ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি আইনগত কারণ ছাড়া অপর কোনো ব্যক্তির পরিচিতি তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয়, দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তাহলে উক্ত কাজ একটি অপরাধ বলে বিবেচিত হবে এবং তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। আবার একই অপরাধ বারবার ঘটালে অনধিক ৭ (সাত) বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ব্যাখ্যা- ‘পরিচিতি তথ্য’ অর্থ কোনো বাহ্যিক, জৈবিক বা শারীরিক তথ্য বা অন্য কোনো তথ্য যা এককভাবে বা যৌথভাবে একজন ব্যক্তি বা সিস্টেমকে শনাক্ত করে, যার নাম, ছবি, ঠিকানা, জন্ম তারিখ, মাতার নাম, পিতার নাম, স্বাক্ষর, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন নম্বর, ফিঙ্গার প্রিন্ট, পাসপোর্ট নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ই-টিআইএন নম্বর, ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল স্বাক্ষর, ব্যবহারকারীর নাম, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নম্বর, ভয়েজ প্রিন্ট, রেটিনা ইমেজ, আইরেস ইমেজ, ডিএনএ প্রোফাইল, নিরাপত্তামূলক প্রশ্ন বা অন্য কোনো পরিচিতি যা প্রযুক্তির উৎকর্ষতার জন্য সহজলভ্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দন্ডবিধি ১৮৬০ এর ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আবার একই অপরাধ পুনঃপুন ঘটালে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৫ (পাঁচ) বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এর ৬৩ ধারা অনুযায়ী, যদি অন্য কোন আইন বাধা না দেয় তবে কোনো ব্যক্তির অনুমতি ছাড়া ইলেকট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, দলিল, যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।এবং এর জন্য অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড হতে পারে।
‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অ্যাক্ট’ ২০০৬-এ আরো বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ইলেক্ট্রনিক স্বাক্ষর সার্টিফিকেট যা বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছে তা প্রকাশ করেন তবে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। বা কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারণা বা অন্য কোন বেআইনি উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রস্তুত বা প্রকাশ করে তবে সেটিও অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। এধরনের অপরাধের জন্য অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয়দন্ড হতে পারে। এ থেকে বুঝা যায় আইনগত ভিত্তি ছাড়া কোন তথ্য প্রকাশ করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। সেটি নিজে করলেও অপরাধ হবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের (Universal Declaration of Human rights, UDHR) ১২ অনুচ্ছেদঅনুযায়ী, কোন ব্যক্তি কখনোই অন্য কোন ব্যক্তির গোপনীয়তা, পারিবারিক বিষয়, বাসস্থান বা যোগাযোগে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমনকিকোনব্যক্তির আত্মসম্মান নষ্ট হয় এমন কোনো পদক্ষেপও নিতে পারবে না। যদিউক্তক্ষেত্রগুলোয়কোন হস্তক্ষেপ বা আক্রমণকরাহয়তবেএইহস্তক্ষেপবাআক্রমণেরবিরুদ্ধে আইনগত সুরক্ষার অধিকার থাকবে।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১২২ ধারায় বলা হয়েছে,বিবাহ চলমান থাকাকালীন স্বামী ও স্ত্রীর কথা-বার্তার বিষয়বস্তু প্রকাশ করতে তাদের বাধ্য করা যাবে না, যদি না মামলা তাদের নিজেদের মধ্যে না হয় বা স্বামী-স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করা যেতে পারে। এখানে কারো ঘরোয়া বা একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য আদালতেও প্রকাশ করা যাবে না তাদের অনুমতি ছাড়া বা প্রকাশ করতে জোর করা বা বাধ্য করা যাবে না।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১২৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোন মক্কেল বা আসামী যদি কোন আইনজীবীকে কোন ব্যাপারে মন্তব্য করে বা মক্কেল ও আইনজীবীর যে কথোপকথন হবে তা মক্কেলের প্রকাশ্য অনুমতি না নিয়ে আদালতে বা আদালতের বাইরে প্রকাশ করতে পারবে না।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা ও দিনাজপুর।