মোহাম্মদ শিশির মনির: কোন পেশায় দক্ষতা অর্জন সত্যিই দুরূহ কাজ। কিতাবে পড়া জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগিয়ে মানুষ দক্ষতা অর্জন করে। যে যত জটিল সমস্যা মোকাবেলা করে সে তত দক্ষ হিসেবে গড়ে উঠে। কারণ মানব জীবনের সমস্যাসমূহ নিয়ম মেনে হয় না। বরং একটি ঘটনা যখন ঘটে যায় তখন নানান নিয়ম খুঁজতে হয়। কখনও পূর্বের ঘটনার সাথে মিলে যায়। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু নতুনত্ব থাকে। এভাবেই নতুন নজির তৈরি হয়। অভিজ্ঞতার ঝুলি বড় হতে থাকে। অন্যের কাছে যা নতুন অভিজ্ঞ লোকের কাছে তা পরিচিত মনে হয়। কারণ তিনি কাছাকাছি সমস্যা আগেও মোকাবেলা করেছেন।
অভিজ্ঞতা অর্জন সত্যিই ধৈর্যের কাজ। তারচেয়ে বেশি জরুরী অভিজ্ঞজনের সাথে সময় কাটানো। ওস্তাদ থেকে জ্ঞান সঞ্চয় করা। মধুর মত আহরণ করতে হয়। ভাবতে হয়। নোট রাখতে হয়। নির্ঘুম রজনী কাটাতে হয়। ধ্যান করতে হয়। পুরাতন নজিরসমূহ বার বার পড়তে হয়। কোন না কোন ক্লু পাওয়া যায়। না বুঝলে ওস্তাদের কাছে বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করতে হয়। ওস্তাদ কখনও সরাসরি বলে দেন আবার কখনও খুঁজতে বলেন। তখন ধৈর্য্যচুতি ঘটার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। সারা দিনরাত খুঁজার পরও ধমক খেতে হয়। প্রশ্ন আসে পেশায় থেকে লাভ কী? তবুও পথ চলতে হয়। নতুন সূর্য উঠে। পুরাতন ভুলে নতুনকে আলিঙ্গন করতে হয়। এ যেন নিরন্তর পথ চলা। অজানা গন্তব্যের পথে নিরুদ্দেশ যাত্রা।
আমার জানামতে আইনজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, শিল্পী ইত্যাদি পেশাসমূহ একই সূত্রে গাঁথা। একই পদ্ধতি অবলম্বন করে সিদ্ধহস্ত হতে হয়। মূলতঃ এগুলো গুরুমুখী বিদ্যা। ওস্তাদ ও শাগরেদ খাপে খাপে মিলে গেলেই ক্লিক করে। আর না মিললে সারাজীবন শূন্যই থেকে যায়। অদ্ভুত এই প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-ছেলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের রূপান্তর হয়। কখনও কখনও শাগরেদ ওস্তাদের চেয়ে এগিয়ে যায়। এ দেখে ওস্তাদ মুচকি হাসে আর পরিতৃপ্ত হয়। শাগরেদ বড় হয়ে এক সময় নিজেই ওস্তাদে পরিণত হন। তাঁর হাত ধরে নতুন শাগরেদ জন্ম নেয়। চক্রাকারে চলতে থাকে ওস্তাদ-শাগরেদ-ওস্তাদ চক্র।
যে বা যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পেশাজীবী হয়ে ওঠেন তাদের চিন্তায় ভাইরাসের অস্তিত্ব বিরল। কারণ তাদের প্রক্রিয়ায় এন্টি ভাইরাস খুবই শক্তিশালী। তাদের পক্ষে সিনিয়রের গায়ে ঢিল মারা সম্ভব না। তারা সিনিয়রকে গালি গালাজ করতেই পারবে না। তারা কখনও চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে পারবে না। অপমান তো অনেক দূরের কথা। কারণ সিনিয়র শব্দটির মর্মার্থ তারা ভাল করেই অনুধাবন করতে পারে। আর যারা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় নাই বা হঠাৎ বড় হয়ে গেছে তাদের সামনে সিনিয়রই কী আর জুনিয়রই কী? সিনিয়র শব্দের মর্ম তাদের পক্ষে অনুধাবন করা মোটেও সম্ভব নয়।
সনদ-পোশাক-ব্যান্ড-কলার বিদেশি গাউন ইত্যাদি আইন পেশায় অপরিহার্য। তবে এই বিষয়গুলো বাহ্যিক প্রলেপ মাত্র। কারও সুযোগ থাকলে বেশি দামি পোশাক বা গাউন কিনে ব্যবহার করতে পারেন। নিত্য-নতুন পোশাক পরিধান করে অন্যকে দেখাতেই পারেন। কারণ তার সামর্থ আছে। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে কেতাদূরস্ত হওয়ার অফুরন্ত সুযোগ বিদ্যমান। কারণ তার সঙ্গতি ভাল। ধনে-জনে-যশে-খ্যাতিতে একক ও অদ্বিতীয়। দাপটের কারণে কাছে যাওয়াই দুষ্কর। আর যিনি নীরবে নিভৃতে আইনের চর্চা করে যাচ্ছেন বা সিনিয়েরের সাথে থেকে থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন তার ঐশ্বর্য অমূল্য। তার কাছে ঐ দামী পোশাক খুব বেশি অর্থ বহন করে না। তার ঐশ্বর্যের মানদণ্ড ঐ চটকদার পোশাক নয় বরং জ্ঞান ও শিষ্টাচার। পেশাদার পরিচয় দিয়েও যার মাঝে এই দুটি গুণ নাই তাকে সে খুবই গরীব মনে করে যদিও ঐ ব্যক্তির আছে নাম-যশ-খ্যাতি-দাপট-মনি-মুক্তা-জহরত।
এই পেশায় জ্ঞান ও শিষ্টাচার অপরিহার্য। যার এই দুটি গুণ নাই তিনি সত্যিই দরিদ্র যদিও সে ধনে-জনে অতুলনীয়। কোর্টের ডায়াসে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলেন তখন সেটি পরিষ্কার হয়ে যায়। তখন আর ঢেকে রাখা যায় না। উন্মোচিত হয়ে যায়। সুন্দর পোশাক আর জহরতের দাপট পাংশে হয়ে যায়।
আইনপেশায় দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা (consistency and continuity) অপরিহার্য। আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অবশ্যই এই দুটি নীতি ঠিক রাখতে হবে। না হয় বাজিকরদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার কোন উপায় কারও জানা থাকবে না। জ্ঞান ও শিষ্টাচারের জয় হউক।
[নোট: কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না]
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।