শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: পৃথিবীতে আইনবিজ্ঞান ও পেশা অত্যন্ত প্রাচীন। বাংলাদেশেও আইনবিদ্যা ও পেশা অনেক পুরনো। এরই অনুবৃত্তিক্রমে এদেশের জনসাধারণ আইনের বিভিন্ন পরিভাষা ও শব্দগুচ্ছের সাথে কম-বেশি সবাই পরিচিত। কিন্তু বাংলাভাষায় আইনের প্রামাণিক আকর একটি শব্দকোষ গ্রন্থের অভাব দীর্ঘদিনের। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেকোনো বিষয়ের শব্দকোষ গ্রন্থ সর্বদা ব্যবহার্য এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় গ্রন্থ। শব্দকোষগ্রন্থে জ্ঞানের বিশেষ শাখার শব্দসমূহের বর্ণনানুক্রমিক তালিকা, অর্থ, বুৎপত্তি, প্রয়োগ-ব্যাখ্যা ইত্যাদি থাকে। উপযুক্ত একটি শব্দকোষ গ্রন্থের অভাবে কেবল শব্দের সঠিক অর্থগ্রহণ ও বিদ্যার যে কোনো শাখার সঠিক শিক্ষাগ্রহণ করাই শুধু বিলম্বিত হয় না; জাতীয় জীবনের আশা-আকাক্সক্ষার অগ্রগতির চাকাও ব্যাহত হয়। জাতি পিছিয়ে যায় ও অনগ্রসর হয়।
পৃথিবীর ভাষাসমূহের মধ্যে বাংলা একটি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী পুরনো সমৃদ্ধভাষা। এ ভাষা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষাকে বিশ্বসভ্যতার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি আইনগতভাবেই বাংলা ভাষার লালন বিকাশ ও অভিধান প্রণয়নের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ (২০১৩ সনের ৩৩নং আইন)-এর বাংলা একাডেমির কার্যাবলির ধারা ১০-এর উপধারা ১ থেকে ২২ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির কার্যাবলি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ আইনের ধারা ১০-এর ১ উপধারায় বলা হয়েছে : একাডেমির কার্যাবলি হইবে নিম্নরূপ, যথা-
১০(১): জাতীয় আশা আকাঙ্খার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসারসাধন। উক্ত আইনের উক্ত ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়, ১০(৩): ‘বাংলা ভাষার প্রামাণ্য অভিধান, পরিভাষা ও ব্যাকরণ রচনা, রেফারেন্স গ্রন্থ, গ্রন্থপঞ্জি এবং বাংলা ভাষায় বিশ্বকোষ প্রণয়ন, প্রকাশন ও সহজলভ্যকরণ’। অতঃপর এ আইনের ১১ ধারায় বাংলা একাডেমিকে অভিধান প্রণয়নের কাজে মুখ্য প্রতিষ্ঠান বলা হয়েছে। আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, মুখ্য প্রতিষ্ঠান: বাংলা ভাষা প্রমিতকরণ ও উহার উৎকর্ষসাধন এবং বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের জন্য মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য হইবে’।
বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলাভাষাকে কীভাবে দেশের সর্বক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহারযোগ্য করা যায় সে লক্ষ্যে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। বাংলা একাডেমি থেকে এ পর্যন্ত অভিধান-বিশ্বকোষ-কোষগ্রন্থ পরিভাষা পর্যায়ের প্রায় পঁচিশখানার অধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। যা সর্ব মহলে সমাদৃত। তন্মধ্যে আইনবিষয়ক পরিভাষা-কোষ গ্রন্থও রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে এদেশে আইন চর্চার ধারা ইংরেজি ভাষায় প্রবাহমান। বহু বছর ধরে বিভিন্ন আইন ইংরেজি ভাষায় প্রণীত হওয়ায় এ সংক্রান্ত প্রামাণ্য বাংলা ভাষায় আইনগ্রন্থ ও শব্দকোষের অভাব দীর্ঘ দিনের।
১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সংকলিত ‘আইন পরিভাষা-কোষ’ (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক সংকলিত হয় জুন ১৯৭০ সালে। সে সময় ‘আন্তর্জাতিক আইন পরিভাষা-কোষ’ নামে একটি গ্রন্থ একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৯১ সালে মো. আব্দুল হামিদ সংকলিত ‘আইন কোষ’ প্রকাশিত হয়েছে। তার আগে গাজী শামছুর রহমান-এর সম্পাদনায় ‘আইন পরিভাষা’ ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয়। এভাবে বাংলা একাডেমি আইনবিষয়ের শব্দকোষ তৈরির প্রথম প্রয়াস করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে বাংলা ভাষার একাধিক অভিধান, বিশ্বকোষ, আইনসহ নানা বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন শব্দকোষ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে মুদ্রিত আইনবিষয়ক ‘আইন পরিভাষা-কোষ’ ও পরবর্তিকালে ‘আইন কোষ’ একাধিকবার মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এরপারও আইন সংক্রান্ত শব্দকোষ, পরিভাষা-কোষের অভাব বিদ্যমান ছিল। এর কারণ উপযুক্ত পান্ডুলিপি ও দক্ষ সংকল-সম্পাদকের অভাব।
২০২০ সালে আইন কমিশন থেকে ‘আইন-শব্দকোষে’র বিশাল পরিশ্রম ও ব্যয়সাধ্য কাজটি হওয়ায় এ অভাব দূর হয়েছে। একটি সমৃদ্ধি ও ব্যবহার-উপযোগী অখণ্ড ‘আইন-শব্দকোষ’ প্রকাশ করে আইন কমিশন দেশে-বিদেশে বাংলা ভাষাভাষী সকল মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। প্রায় সাড়ে দশ হাজারের অধিক শব্দ সংযোজন করে মুদ্রিত হয়েছে আইন কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘আইন-শব্দকোষ’ নামের অখণ্ড গ্রন্থটি। এ যাবৎ প্রকাশিত আইন শব্দকোষসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো আইন কমিশনের ‘আইন-শব্দকোষ’ গ্রন্থটি। এ গ্রন্থ প্রণয়নে আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ১৯-তম প্রধান বিচারপতি। তাঁর সময়ে তিনি উচ্চ আদালতে ল্যান্ডমার্ক বাংলায় রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যার ধারাবাহিকতা এখনও কোনো কোনো বিচারপতি অনুসরণ ও মান্য করে চলছেন। আইন কমিশন থেকে প্রকাশিত ‘আইন শব্দকোষ’ গ্রন্থটির নেপথ্যেও তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। যেকোনো শব্দকোষে শুধু শব্দ এবং অর্থ করলে ভালোভাবে ভাষা অনুধাবন করা যায় না। শব্দ বা Word মূলত বিমূর্ত। শব্দের বিস্তৃত Context না থাকলে এর কোনো অর্থ থাকে না, বোধগম্য হয় না।
আইন কমিশন প্রণীত ‘আইন-শব্দকোষে’ শব্দের অর্থান্তর ক্রমাসংখ্যাসহ পদান্তর সংকেত দেওয়া হয়েছে; তেমনি তার ব্যবহার ও সংশ্লিষ্ট প্রচলিত আইনের ধারা এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিধিসহ ব্যবহার দেখানো হয়েছে। এই শব্দকোষে শব্দ ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এছাড়া ‘আইন-শব্দকোষ’ Function and systematic use of word দেখানোর বিষয়টিও লক্ষ্য করা গেছে।
আইন কমিশনের ‘আইন-শব্দকোষে’র ভুক্তিগুলো ব্রিটিশ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এই ত্রিকালের ঐতিহ্য বহন করছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক আইনের অনেক শব্দ ব্যাখ্যাসহ অর্থান্তর করা হয়েছে। আইন কমিশন প্রণীত ‘আইন-শব্দকোষ’ বাংলা ভাষার একটি বড় অভাব পূরণ করেছে।
জানা যায়, আইন কমিশনের ‘আইন-শব্দকোষ’টি প্রথম প্রকাশ হয় ২০০৬ সালে। সে সময় বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি ও ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামান একত্রে সংকলন ও সম্পাদনা করে প্রণয়ন করেছিলেন ‘আইন-শব্দকোষ’ (ঢাকা: অন্য প্রকাশ, প্রথম প্রকাশ, ২০০৬)। তখন এ গ্রন্থে প্রায় ছয় হাজার ভুক্তি ছিল।
পরবর্তীকালে আইন কমিশন গ্রন্থটির একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইন কমিশনের উদ্যোগে কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এবং জাতীয় অধ্যাপক ডক্টর আনিসুজ্জামানসহ বিশেষজ্ঞ একটি দল আইন-শব্দকোষ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা আইনের আরও সাড়ে চার হাজার শব্দের নতুন বাংলা পরিভাষা সংকলন ও সম্পাদনা করে নির্ধারণ করেন।
প্রথম প্রকাশের ছয় হাজার ও আইন কমিশন কর্তৃক গঠিত বিশেষজ্ঞ দলের নির্ধারণকৃত নতুন সাড়ে চার হাজার সবমিলিয়ে প্রায় দশ হাজারের বেশি শব্দের ভুক্তি নিয়ে আইন কমিশনের ‘আইন-শব্দকোষ’ (ঢাকা: আইন কমিশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০২০)। আইন কমিশনের প্রণীত পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণের ‘আইন শব্দকোষটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশত বার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়েছে।
আইন কমিশনের ‘আইন শব্দকোষটি শুধু বাংলাদেশের আইনের গবেষক-শিক্ষার্থী-আইনজীবী বিচারকরা উপকৃত হবেন এমন নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষীরা উপকৃত-অনুগৃহীত ও বাধিত হবেন। এ গ্রন্থটি আইনজীবীর তাঁর মক্কেলের মামলায় প্রতিকার লাভের বিষয়ে আদালতে বাংলায় বক্তব্য, আর্জি, জবাব লিখনে বিশেষ সহায়ক হবে। এতে আদালতে প্রতিকার লাভের আশায় আসা জনসাধারণ তাদের মামলা ও আদালতের রায়-আদেশ সম্পর্কে সহজে বুঝতে পারবেন। ফলে বিচারকগণের জন্যও তা সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিচারকগণ মামলার রায় বাংলায় লিখতে সহজতর হবে। এছাড়া ইংরেজিতে দেওয়া রায়গুলো বাংলা অনুবাদেও কাজে আসবে। সুতরাং আইন কমিশনের ‘আইন শব্দকোষের’ গুরুত্ব ও ব্যবহার ব্যাপক।
‘আইন-শব্দকোষ’ আদালতে বাংলায় রায় প্রদান, সংসদে বাংলায় আইন প্রণয়নসহ আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় আইন কমিশনের ‘আইন-শব্দকোষ’ একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আইনজীবী বিচারক-আইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এ গ্রন্থ অবশ্য পাঠ্য। তাদের সকলের জন্য আইন-শব্দকোষ’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় একটি গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। জনসাধারণ বোধগম্য বাংলা ভাষায় উচ্চ আদালতের বিচারকদের বাংলায় রায় ও আদেশ প্রদান এবং সব আদালতে বাংলা ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক থাকা আবশ্যক। আইন-আদালতে তাঁদেরকে সর্বদা বাংলা ব্যবহারে মনস্ক হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আইন কমিশনের ‘আইন শব্দকোষের’ গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যবহার অপরিসীম।
মোটকথা, বাংলায় রায় প্রদানসহ আদালতের কার্যক্রমে বাংলা ব্যবহার-উপযোগীর ক্ষেত্রে ‘আইন শব্দকোষ’ বিচার বিভাগে অনন্য ভূমিকা অনস্বীকার্য। আদালতে বাংলা ভাষা প্রয়োগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারকদের বাংলায় রায় লিখতে বাধা কাটাতে আইন কমিশনের এরূপ কার্য সর্বদা দেশের মানুষ প্রত্যাশা করে। তবেই বাঙালি জাতি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক: গবেষক।