মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব: বিগত কয়েকবছর ধরে দূষণ সংক্রান্ত যেকোন তালিকাতে বাংলাদেশের তালিকা শীর্ষে। বরাবরের মতো জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি), ২০২২-এর প্রতিবেদনে শব্দ দূষণের তালিকাতে রাজধানী ঢাকা প্রথম স্থান অর্জন করেছে। এই অর্জন যেমন অস্বস্তির পাশাপাশি উদ্বেগেরও বটে। ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা প্রথম অবস্থানে থাকার পাশাপাশি রাজশাহী রয়েছে তালিকার চতুর্থ স্থানে। তালিকায় দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদ, পাকিস্তানের ইসলামাবাদ এবং ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)এর নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার জন্য গ্রহণযোগ্য শব্দের মানমাত্রা ৫৫ ডেসিবেল এবং বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। সেখানে ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল পাওয়া গেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ঢাকাবাসীকে জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণের বেশি মাত্রার শব্দ সহ্য করতে হয়। এই প্রতিবেদন অনুসারে তালিকার শহরগুলোর মধ্যে সবথেকে কম শব্দ দূষণ হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে, সেখানে শব্দের সর্বোচ্চ গড় তীব্রতা ২০ ডেসিবেল। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্পেনের বার্সেলোনা, ২২ ডেসিবেল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের ৩০টি কঠিন রোগের জন্য দায়ী ১২ রকম দূষণ, যার মধ্যে শব্দ দূষণ একটি। শব্দ দূষণের কারণে কানে কম শোনা, মাথাধরা, অনিদ্রা, হাঁপানী, খিঁচুনী, লেখাপড়া এবং কাজ কর্মে অনীহাসহ নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। অপ্রত্যাশিত বা আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশী সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। শব্দ দূষণের দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ অনুসারে দেখা যায় উচ্চ শব্দ জনসাধারণের মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতার কারণ। এটি উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ হৃদস্পন্দন, মাথাব্যথা, বদহজম ও পেপটিক আলসার সৃষ্টির কারণ, এমনকি গভীর ঘুমকেও ব্যাহত করে। যেকোন ব্যক্তি যেকোন স্থানে আধঘণ্টা বা তার অধিক সময় ধরে ১০০ ডেসিবল বা তার অধিক শব্দ দূষণের ফলে বধির হয়ে যেতে পারে। শব্দ দূষণের এই ভয়াবহতার শিকার সব শ্রেণীর মানুষ, বিশেষ করে বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও শিশুরা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা অনুসারে মাত্রাতিরক্ত শব্দের কারণে দেশের প্রায় ১২ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। আরস্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদন অনুসারেসাড়ে ৯ শতাংশ পুলিশ সদস্য যারা সরাসরি সড়কে কাজ করে তাদের শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শব্দ দূষণের উৎস
ইউএনইপি এর প্রতিবেদন অনুসারে শব্দ দূষণের প্রধান প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে – সড়কে যানজটকালে যানবাহন থেকে নির্গত শব্দ, ট্রেন এবং উড়োজাহাজ থেকে সৃষ্ট শব্দ, শিল্পকারখানা থেকে সৃষ্ট শব্দ।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন এবং সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ার পলিউশন স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের মতে, শব্দ দূষণের প্রধান পাঁচটি উৎস হল যানবাহন, নির্মাণ সাইট, শিল্প ও কলকারখানা, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং গৃহস্থালীয় হতে সৃষ্ট শব্দ।
যানবাহন থেকে সৃষ্ট শব্দ দূষণের উৎসের মধ্যে রয়েছে বাস, ট্রাক, মোটরবাইকে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক হর্ন (শব্দ ছড়ায় প্রায় ১২০ ডেসিবেল) যা জনপূর্ণ সড়কে চলমান মানুষের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। ক্ষতিকর হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি ও বিক্রি বন্ধে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ হয়নি।
এছাড়াও মাইক, টেপরেকর্ডারের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, কলকারখানায় ব্যবহৃত যান্ত্রিক মেশিনের শব্দ, ওয়েল্ডিং কারখানার শব্দ এবং জেনারেটর থেকে উৎপন্ন শব্দ অন্যতম।
আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
শব্দ দূষণরোধ করতে বিভিন্ন সময় সরকার আইন প্রণয়ন করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ২০ ধারা অনুযায়ী শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে এবং এই ধারার বাস্তবায়নে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ প্রণয়ন করা হয়েছে।
এই বিধিমালার বিধি ৭ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন এলাকার শব্দের সর্বোচ্চ মানমাত্রা অতিক্রম করতে পারবে না এবং বিধি ৮ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি মোটর, নৌ, বা অন্য কোন যানে অনুমোদিত শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী হর্ণ ব্যবহার করতে পারবে না এবং নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ ব্যবহার করা যাবে না।
বিধিমালা অনুযায়ী শব্দের মাত্রা নীরব এলাকায় দিবাভাগে ৫০ এবং রাত্রিতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিবাভাগে ৫৫ এবং রাত্রিতে ৪৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাভাগে ৭০ এবং রাত্রিতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিবাভাগে ৭৫ এবং রাত্রিতে ৭০ ডেসিবল নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে ধর্মীয় স্থান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সরকারী বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস, বিজয় দিবস, ২১শে ফেব্রেুয়ারী, ১লা বৈশাখ, মহররম বা সরকার কর্তৃক ঘোষিত অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দিবসের অনুষ্ঠান প্রচার, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশংকায় বিপদ সংকেত প্রচার ইত্যাদি বিষয়সমূহে এই বিধিমালা প্রযোজ্য হবে না।
এই বিধিমালা অনুসারে কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ (এক) মাস কারাদন্ডে বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদন্ডে বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হবে।
সড়ক পরিবহণ আইন, ২০১৮ এর ৪৫ ধারা অনুসারেসরকার বা সরকার কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, সময় সময়, মোটরযানের শব্দমাত্রার সীমা নির্ধারণ করতে পারবে; কোনো মোটরযান চালক নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত উচ্চমাত্রার কোনোরূপ শব্দ সৃষ্টি করতে পারবে না। সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কর্তৃক, আদেশ দ্বারা, ঘোষিত নীরব এলাকা অতিক্রমকালে কোনো মোটরযান চালক কোনোরূপ হর্ন বাজাতে পারবে না এবং কোনো মোটরযান চালক, মালিক বা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, নির্ধারিত শব্দমাত্রার অতিরিক্ত শব্দমাত্রা সৃষ্টিকারী কোনো যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা হর্ন মোটরযানে স্থাপন, পুনঃস্থাপন বা ব্যবহার করতে পারবে না বা করবার অনুমতি প্রদান করতে পারবে না।
তবে উপরোক্ত বিধানগুলো অ্যাম্বুলেন্স, অগ্নি-নির্বাপক যান, জরুরী উদ্ধার কাজে নিয়োজিত যান ও জরুরী জনগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ব্যবহৃত মোটরযানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। এই আইনের ৮৮ ধারাতে বলা হয়েছে, উপরোক্ত বিধান ভঙ্গ করলে তা হবে একটি অপরাধ; তজ্জন্য অনধিক ৩ (তিন) মাসের কারাদন্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ড এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক ১ (এক) পয়েন্ট কর্তন করার বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এর দায়েরকৃত রিট মামলা যার নং ৩০০/১৯৯৫। এ মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট আদেশ প্রদান করে যে ট্রাক, বাস বা যানবাহনে ব্যবহৃত নিষিদ্ধ হাইড্রোলিক হর্নের পরিবর্তে আইনত: অনুমোদিত হর্নের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে কিন্তু আজ পর্যন্ত হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারে কোন পরিবর্তন আসেনি। শব্দ দূষণের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণ জনগণকে জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে অথচ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর অনুচ্ছেদ ৩১ এবং ৩২ এ জীবনের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। দেশে আইন থাকা সত্ত্বেও শব্দ দূষণ বেড়েই চলেছে কারণ আইনের বাস্তবায়ন নেই।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রস্তাবনা
শব্দ দূষণ পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলছে, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের মানুষ। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। ফলে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নিন্মলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
- বাস-ট্রাক টার্মিনাল ও ব্যস্ত সড়কে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও শাস্তি আরোপ করা;
- ক্রমান্বয়ে পুরো শহর এলাকাগুলো হর্ণমুক্ত ঘোষণা করা;
- আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা;
- ফ্ল্যাট/শিল্প এলাকায় জেনারেটরের শব্দের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা ও আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা;
- সামাজিক অনুষ্ঠানে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে জনসমর্থন আদায় ও আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা;
- উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী এবং হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহারকারী যানবাহন তাৎক্ষনিকভাবে আটক করে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থাকে আরোও জোরদার এবং কঠোর করা;
- চালকদের প্রশিক্ষণ প্রদান;
- উচ্চ আওয়াজে মাইক বা টেপরেকর্ডার ইত্যাদি ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে সাধারণ জনগণের মধ্যে লিফলেট প্রচার, বিলবোর্ড স্থাপন, দেয়াল লেখনি ইত্যাদির বৃদ্ধি করা;
- প্রচার মাধ্যমগুলো যেমন রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদিতে শব্দ দুষণের কারণ, প্রতিকার এবং ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রচার করা;
- সরকার কর্তৃক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং দেশের প্রচলিত আইনের সঠিক বাস্তবায়ন করা।
মন্তব্য
ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স বিভাগের অবসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় এ বছর ১৪৩ দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ১৪২। বিভিন্ন রকম পরিবেশ দূষণ রাজধানী ঢাকাকে করে তুলেছে বসবাসের অযোগ্য। পরিবেশ দূষণের মধ্যে শব্দ দূষণ একটি নীরব ঘাতক যাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।পরিবেশের সাথে জনস্বাস্থ্য বিষয়টি অতপ্রতভাবে জড়িত। তাই জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে শব্দ দূষণ রোধ করা আবশ্যক। ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে যেহারে শব্দ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আশংকাজনক। একটি দূষণমুক্ত, সুস্থ, বসবাসযোগ্য শহর উপহার দেবার জন্য নানা রকম দূষণ রোধের সাথে সাথে গুরুত্বের সাথে শব্দ দূষণ রোধে দ্রুত কার্যকর এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরী।
লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ঢাকা; আইনজীবী, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)।