ফাইজুল ইসলাম: পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর নিদর্শনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো— তিনি তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জীবনসঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত: ২১)
কোরআনে বলা হয়েছে,”মুসলিম বিবাহ হচ্ছে Mithaqun Ghalithun যার অর্থ দাঁড়ায় বিবাহ একটি শক্তিশালী চুক্তি।”
আব্দুল রহিম বনাম সালিমা (ILR 1886 8 ALL 149) মামলায় বিচারপতি মাহমুদ মুসলিম বিবাহের প্রকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তি এবং কোন ধর্মীয় আচার নয়।”
মুসলিম বিবাহের উপাদান
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানি চুক্তি। একটি দেওয়ানি চুক্তির অত্যাবশকীয় উপাদানগুলো হল, ১. প্রস্তাব, ২. গ্রহণ, ৩. বৈধ বস্তু, ৪. পক্ষদের সক্ষমতা ও ৫. বিনিময় মূল্য
অন্যদিকে, মুসলিম বিবাহের অত্যাবশকীয় উপাদানগুলো হল, ১. ইজব বা প্রস্তাব দেয়া, ২. কবুল বা প্রস্তাব গ্রহণ করা, ৩. দেনমোহর (বিনিময় মূল্য) এবং ৪.পক্ষদ্বয়ের সক্ষমতা
আজ আমরা আলোচনা করবো দেনমোহর নিয়ে। শরীয়া আইনে দেনমোহর প্রদান করা ফরজ। দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর সম্ভ্রমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে টাকা বা সমমূল্যের উপহার প্রদান
ইসলামে দেনমোহর কি?
ইসলামে বিবাহ হল দুটি পক্ষের মধ্যে একটি আইনি চুক্তি এবং একটি পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান নয়। স্বামী কর্তৃক বিবাহের সময় স্ত্রীর প্রতি সম্মানের চিহ্ন হিসাবে প্রদত্ত উপহার বা মোহর বাধ্যতামূলক এবং তাকে মেহর বলা হয়। এটা স্ত্রীর আইনগত অধিকার।
এই উদ্দেশ্যে কুরআনে ব্যবহৃত শব্দগুলির মধ্যে একটি হল সাদাকাহ (৪:৪), যার অর্থ হল উপহার যা সরল বিশ্বাসে এবং একটি ভাল কাজ হিসাবে দেওয়া হয়, উদারতার মাধ্যমে, নিজেকে বড় করার অর্থ ছাড়াই।
কুরআনে ব্যবহৃত অন্য শব্দটি হল আজর (৩৩:৫০)। এই শব্দের অর্থ পুরস্কার এবং মজুরি বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। এটি সেই মহিলাকে উপহার হিসাবে দেওয়া হয় যে তার পরিবার এবং তার বাড়ির নিরাপত্তা ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবং একটি নতুন এবং অজানা পরিবেশে সামঞ্জস্য করার ঝুঁকি নিচ্ছে।
মোহর পরিশোধে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। সেই অর্থে মোহর দেয়া ফরজ।
কোরআনুল কারিমে আরো এরশাদ হয়েছে, যদি তাদেরকে মোহরানা প্রদান করে থাকো, তবে তাদেরকে বিয়ে করায় তোমাদের কোনো অপরাধ নেই (সুরা নাস: ৬০)।
দেনমোহর হচ্ছে স্ত্রীর হক। স্ত্রীকে দেনমোহর প্রদান করা স্বামীর উপর ফরজ। আল্লাহ তা’আলা সূরা নিসার ৪ নাম্বার আয়াতে বলেন, “আর তোমাদের স্ত্রীদের তাদের দেনমোহর দিয়ে দাও খুশী মনে। অবশ্য স্ত্রী চাইলে দেনমোহর কিছু অংশ কিংবা অংশ ছেড়ে দিতে পারে।
এমনকি নবী (সা.)-কেও বলা হয়েছে, “হে নবী, আমরা আপনার জন্য সেই স্ত্রীদের হালাল করেছি যাদের মোহর আপনি পরিশোধ করেছেন…”। (৩৩:৫০)।
হযরত আলী যখন বিবি ফাতেমার হাত চাওয়ার জন্য নবীর কাছে এলেন, তখন নবীজী তাকে প্রথম যে জিনিসটি জিজ্ঞাসা করলেন তা হল, “তোমার কাছে মোহর দেওয়ার মতো কিছু আছে কি?”
সে বলল তার একটা ঘোড়া আর একটা জিন আছে। সে তার জিন ৪৮০ দিরহামে বিক্রি করে নবীর কাছে নিয়ে আসে। নববধূ এবং নতুন পরিবারের তাৎক্ষণিক চাহিদা এই পরিমাণ দ্বারা পূরণ করা হয়।
মৃত্যুশয্যায় বিধবাকে কখনও কখনও তার স্বামীকে ক্ষমা করতে বলা হয়। মোহর সারা জীবন স্বামীর উপর ঋণ থাকে এবং তার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীরা এই ঋণ পায় এবং তা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। মোহর হল স্ত্রীর একমাত্র সম্পত্তি এবং এর উপর পিতা-মাতা বা অন্য কোন আত্মীয়-স্বজনের কোন অধিকার নেই।
মুসলিম আইনে দেনমোহর
মোহর মোহরানা নামেও পরিচিত একটি অর্থ যা স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর পক্ষের মধ্যে চুক্তি বা আইনের মাধ্যমে বিবাহের ক্ষেত্রে প্রদেয় হয়। – তৈয়বজী
বিভিন্ন স্কুলে দেনমোহরের পরিমাণ
বিভিন্ন চিন্তাধারার জন্য নির্ধারিত পরিমাণ দেনমোহর: হানাফী মাযহাব- ১০ দিরহাম, মালিকি স্কুল – ৩ দিরহাম, শফি স্কুল – কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং শরিয়া স্কুল – কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ নেই।
যে সমস্ত মুসলমান দরিদ্র এবং ১০ দিরহামও দিতে পারে না, তারা তাদের স্ত্রীকে মাহর প্রদানের পরিবর্তে কুরআন শিক্ষা দিতে পারে।
মোহর (Dower) কত প্রকার
প্রসঙ্গত আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। আমাদের মধ্যে দুই ধরনের মোহরের প্রচলন রয়েছে। এক. ﻣﻬﺮ ﻣﻌﺠﻞ (মোহরে মু‘আজ্জাল) বা নগদ মোহর বা prompt dower। দুই. Deferred Dower বা মোহরে মুওয়াজ্জাল
এ শব্দগুলো যেহেতু বিয়ের মজলিস ছাড়া সচরাচর শোনা যায় না তাই অনেকে এ শব্দ দুটির অর্থ বুঝে না। শরীয়তের দৃষ্টিতে মোহরে মু‘আজ্জাল হল সেই মোহর, যা বিয়ে সম্পন্ন হওয়ামাত্র নগদ আদায় করা অপরিহার্য হয়ে যায়। হয়তো সে বিয়ের সময়ই তা পরিশোধ করে দিবে অথবা বিয়ের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পরিশোধ করবে। এক্ষেত্রে স্ত্রীর তা দাবি করার অধিকার আছে। যেহেতু আমাদের সমাজে নারীরা সাধারণত মোহর দাবি করে না তাই এরূপ মনে করা উচিত হবে না যে, সেটা পরিশোধ করা আমাদের জন্য জরুরি নয়; বরং কর্তব্য হল স্ত্রীর চাওয়ার অপেক্ষা না করে যত দ্রুত সম্ভব এই ফরয দায়িত্ব হতে মুক্ত হওয়া।
মোহরে মুয়াজ্জাল বলা হয় সেই মোহরকে, যা পরিশোধের জন্য উভয় পক্ষ কোনো তারিখ নির্ধারণ করে। ঐ তারিখ আসার আগে মোহর আদায় করা স্বামীর জন্য আবশ্যকীয় নয়। স্ত্রীও সেই তারিখের আগে এই মোহর দাবি করতে পারবে না। সুতরাং মোহর মুয়াজ্জাল হওয়ার অর্থ হচ্ছে, বিয়ের দিনই তা পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা হবে, কিন্তু আমাদের সমাজে সাধারণত কোনো দিন-তারিখ নির্ধারণ না করে শুধু এটুকু বলে দেওয়া হয় যে, এই পরিমাণ মোহরে মুয়াজ্জাল (বাকি মোহর)। আর সামাজিক প্রচলন অনুযায়ী তার অর্থ দাঁড়ায়, তা পরিশোধ করা হবে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রী কারো মৃত্যু হলে। এটিও একটি ভুল প্রচলন।
আরেকটি বিষয় হল, স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে যে গয়নাগাটি দেওয়া হয় মোহরের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক নেই। আমাদের সামাজিক প্রচলন মতে স্ত্রী এই অলংকারের মালিক হয় না; বরং সেগুলো তাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। ফলে স্ত্রী সেই অলংকার স্বামীর অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারে না এবং কাউকে উপহারও দিতে পারে না। আর এ কারণেই-আল্লাহ না করুন-তালাকের ঘটনা ঘটলে স্বামী তা ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের অলংকার দ্বারা মোহর আদায় হয় না। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে স্পষ্টভাবে বলে যে, আমি এই অলংকার মোহরস্বরূপ তোমাকে দিয়েছি এবং তুমি এর মালিক তাহলে সেই অলংকার মোহর হিসেবে গণ্য হবে। সেক্ষেত্রে ঐ অলংকারের উপর স্ত্রীর পূর্ণ অধিকার থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই তা স্ত্রীর নিকট থেকে ফেরত নেওয়া যাবে না।
মোহরানা বৃদ্ধি বা হ্রাস হতে পারে কি না
স্বামী যে কোন মুহুর্তে দেনমোহর বাড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে, স্ত্রীর কাছে দেনমোহরের পুরো বা আংশিক টাকা পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। হিবাতুল মাহর বা হিবা-ই-মাহর বলতে স্ত্রী কর্তৃক মহর ক্ষমাকে বোঝায়। যখন একজন স্ত্রী তার স্বামীর দ্বারা উপেক্ষা করে এবং বিশ্বাস করে যে তাকে ফিরে পাওয়ার একমাত্র বিকল্প হল মাহর মওকুফ করা, তখন তার মাহর মওকুফ তার চুক্তি ছাড়াই বিবেচনা করা হয় এবং তার উপর বাধ্যতামূলক নয়।
কে দেনমোহর পরিবর্তন করতে পারে?
স্বামী বাড়াতে পারে কিন্তু কমাতে পারে না। স্ত্রী কর্তৃক মোহর বাতিল করাকে হিবে-ই-মাহর বলা হয়। স্ত্রী মহর অর্থাৎ মোহর আংশিক বা সম্পূর্ণ বাতিল করতে পারে তবে তার জন্য তাকে বয়ঃসন্ধি লাভ করতে হবে। তবে স্ত্রী কর্তৃক মহর বাতিল সম্মতিক্রমে হতে হবে।
দেনমোহর নিয়ে মুসলিম আইন কি বলে?
“স্বামী দেনমোহর প্রদান না করলে স্ত্রী চাইলে তালাক দিতে পারবেন।”
Safura Khatun vs Osman Goni Mollah,1957,9 DLR 455
মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ (Muslim Family Law Ordinance 1961) অনুযায়ী সালিশি পরিষদের অনুমতি ছাড়া আরেকটি বিয়ে করলে স্বামীকে অবিলম্বে তার বর্তমান স্ত্রীর বা স্ত্রীদের তাৎক্ষণিক Prompt (নগদ) অথবা বিলম্বিত (বাকি) দেনমোহরের যাবতীয় টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করা না হলে তা বকেয়া রাজস্বের মতো আদায় হবে। বিয়ের চুক্তিতে দেনমোহর পরিশোধের পদ্ধতি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না থাকলে দেনমোহরের সমগ্র অর্থ ‘চাওয়া মাত্র প্রদেয়’ বলে ধরে নিতে হবে। আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য-মিলন অর্থাৎ সহবাসের আগে বিবাহবিচ্ছেদ হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে, সম্পূর্ণ দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করতে হয়। ১৯৮৫ সালের মুসলিম পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ (Muslim Family Court Ordinance 1985) অনুসারে, দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, তা আদায়ের জন্য স্থানীয় পারিবারিক আদালতে মামলা করতে হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদের তিন বছরের মধ্যে এই মামলা করতে হয়।
স্ত্রী, তাহার, দেনমোহরের টাকা না পাইলে, সে এবং তার মৃত্যর পর তার উত্তরাধিকারীগণ, তার জন্য মামলা দায়ের করিতে পারে তাৎক্ষনিক দেনমোহর আদায়ের মামলা দায়ের করিবার সময় সীমা হইল দেনমোহরটি দাবী ও উহা প্রদানে অস্বীকৃতির তারিখ হইতে ৩ বছর, অথবা যেখানে বিবাহ থাকাকালীন এই জাতীয় কোন দাবীই উস্থাপিত হয় নাই, সেখানে মৃত্য কিংবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিলে।
দেনমোহরের মামলায় তামাদি আইন
১৯০৮ সালের তামাদী আইন, তফসীল-১, অনুচ্ছেদ-১০৩ “বিলম্বিত” দেন মোহরটি আদায়ের সময় সীমা হইল মৃত্য অথবা তালাকের ফলে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিলে ঐ তারিখ হইতে তিন বৎসর।
[তফসীল-১, অনুচ্ছেদ-১০৪] “বিলম্বিত” দেনমোহরের দাবীতে স্বামীর সম্পত্তি বিধবার বৈধ দখলে থাকাকালীন তামাদীর মেয়াদ বিধবার বিপক্ষে যাইতে না, স্ত্রী লিখিতভাবে তালাক প্রাপত হইলে, তামাদী আইনের ১০৩ ও ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্ত্রীকে উক্ত লিখিত তালাক দানের তথ্য বা সংবাদটি শোনার তারিখ হইতেই তামাদীর সময় শুরু হবে আদায়ের দাবীতে মামলা দায়ের করার অধিকার স্ত্রীর রয়েছে।
স্ত্রী আগে তালাক দিলে কি স্বামীর দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়?
১৯৩৯ সালে ‘মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯’ প্রণীত হয়। অত্র আইনের ৫ ধারাতে উল্লেখ আছে, ‘স্ত্রী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের (তালাক) ফলে স্ত্রীর দেনমোহরের অধিকার খর্ব হবে না।’ অর্থাৎ কোনো মহিলা যদি কোনো কারণে তার স্বামীকে তালাক দেন, তাহলে উক্ত স্বামী দেনমোহরের নির্ধারিত টাকা স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। আদালত তাকে (স্বামীকে) কোনো অজুহাত দেখানোর সুযোগ দেবেন না। যেমন স্বামী বলতে পারবেন না, ‘তালাকের নোটিস বস্তুত স্ত্রীর পক্ষ থেকে এসেছে, সুতরাং সে দেনমোহর পরিশোধ করতে বাধ্য না।’
যদি কোনো স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চান, তাহলে তাঁর সেই অধিকার রয়েছে। কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে যদি আপনার স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, তাহলে তিনি সরাসরি আপনাকে তালাক দিতে পারেন। আর ১৮ নম্বর কলামে যদি কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে আদালতে যেতে হয়। স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়।
মনে রাখতে হবে, স্বামী বা স্ত্রী যিনিই তালাক দিন না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তবে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য জীবনযাপন না হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে দেনমোহরের অর্ধেক পরিশোধ করা যাবে। তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর কারণে বা অন্য কোনো কারণে স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সম্পর্ক ছিন্ন হলেও স্ত্রী তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার উত্তরাধিকারীদের কাছে এই দাবি করতে পারবে।
আবার স্বামীর আগে স্ত্রী মারা গেলেও দেনমোহর মাফ হয় না। স্ত্রীর উত্তরাধিকারীরা এই দেনমোহরের হকদার। তারাও মামলা করার অধিকার রাখে। যদি স্ত্রীর মোহরানা পরিশোধ করা না হয়ে থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মতোই প্রথমে স্বামীর মোট রেখে যাওয়া সম্পত্তি থেকে মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। বাকি সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বণ্টন করা হবে যেখানে মোহরানা দেয়ার পরেও স্ত্রী আবার উত্তরাধিকারী স্বত্বে তার অংশ পাবে। মোহরানা পরিশোধ করায় যদি মৃত স্বামীর সম্পত্তি আর অবশিষ্ট না থাকে, তবে অন্যান্য ঋণের মতো সম্পূর্ণ সম্পত্তি মোহরানা বাবদ স্ত্রীকে সমর্পণ করতে হবে। ফলে ওয়ারিশরা আর কোনো অংশ পাবে না।
বিভিন্ন মামলার রায় কি বলে?
মোহাম্মদ আহমেদ খান বনাম শাহ বানো বেগম
সুপ্রিম কোর্টের মতে, স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি সম্মানের চিহ্ন হিসাবে দেনমোহর দেন। মাহর হল একটি অর্থ যা বিবাহের সময় পরিশোধ করতে হবে অথবা তালাকের সময় পরিশোধ করতে হবে না। আদালত বলেছে যে Cr.P.C এর ১২৫ ধারা অনুযায়ী, এই ধরনের মহিলারাও ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী।
হাকিম মসিহউদ্দিন বনাম আব্দুল ওয়াহিদ (2010)
মুসলিম রীতি অনুযায়ী, ইশরাত বানো দিল্লিতে আসামিকে বিয়ে করেছিলেন। ইশরাতের পূর্ববর্তী বিয়ে থেকে রিফাত নামে একটি মেয়ে ছিল এবং আসামী তাকে নিজের মেয়ে বলে জড়িয়ে ধরে। বিবাদী এবং ইশরাত বানো উভয়েই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন এবং নিকাহের সময় ২০,০০০ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছিল।
আদালত বাদীদের পক্ষে রায় দেয় এবং বার্ষিক ৬% হারে যৌতুকের ২০০০০ টাকা এবং ভবিষ্যতের সুদ পুনরুদ্ধারের জন্য একটি ডিক্রি জারি করা হয়।
বীনা বনাম বি. মোহাম্মদ (2015)
কেরালা হাইকোর্ট রায় দিয়েছে যে যেহেতু এটি দ্রুত দেনমোহরের বিষয় ছিল, তাই বিবাদীকে স্ত্রীর দাবিতে বা বিবাহের সময় বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় দেনমোহর দিতে বাধ্য ছিল। বিবাদী বিবাহের সময় যে মোহরানা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা পরিশোধ করতে বাধ্য কারণ সে কখনও তা দেয়নি।
নাসরা বেগম বনাম রিজওয়ান আলী
সুপ্রিম কোর্ট এই মামলায় রায় দিয়েছে যে বিবাহের সময় যদি একটি দেনমোহর চুক্তি করা হয়, তবে তা পরিশোধের জন্য স্বামী দায়ী, এবং এই ব্যবস্থার অধীনে স্ত্রীর দ্বারা দেনমোহরের পরিমাণ আদায়যোগ্য।
সম্প্রতি বাংলাদেশের দেনমোহর নিয়ে যুগান্তকারী রায়
সম্প্রতি জমি মোহরানা হিসেবে গ্রহণ নিয়ে ‘জিয়াউল হক ও অন্যান্য বনাম ফারহানা ফেরদৌসী ও অন্যান্য’ নামে আদালতে একটি মামলা হয়। মামলাটির শুনানি শেষে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও আহমেদ সোহেলের যৌথ বেঞ্চ রায় দেন।
এতে বলা হয়েছে, স্বামীর পাশাপাশি তার পক্ষে যে কেউ দেনমোহন পরিশোধের দায়িত্ব নিতে পারবেন। সেইসঙ্গে পারিবারিক আদালতে মামলা করে স্বামীর জমি মোহরানা হিসেবে পুনরুদ্ধার করতে পারবেন স্ত্রী।
মূলকথা দেনমোহর স্ত্রীর অধিকার। স্বামীর তা আদায় করতেই হবে। সম্প্রতী আদালতের রায় আমাদের জন্য নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।