সিরাজ প্রামাণিক: মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য স্থানে তল্লাশি করা হোক কিংবা বাড়ি ঘরে সবক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসার কিংবা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অফিসারকে বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত অফিসারকে একটি জিডি মূলে কোনো স্থানে বা স্থাপনায় প্রবেশ করতে হয় কিংবা প্রকাশ্য স্থান থেকে মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনের অপরাধে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার করতে হলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর ২১ এবং ২৩ ধারার বিধান অনুসরণ করতে হয়।
এরপর পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পি আর বি’র ২৮০ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে কোনো স্থান তল্লাশি করার জন্য প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই পুলিশ অফিসার ও তার সঙ্গীদের নিজের কাছে কিছু নেই তা উপস্থিত সাক্ষী কর্তৃক প্রবেশের পূর্বেই সার্চ করাতে হবে। নতুবা নিজেদের বহন করা মাদকদ্রব্য দিয়ে যে কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন।
এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৩ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, তল্লাশি করার আগে তল্লাশির জন্য প্রস্তুত কর্মকর্তা বা অন্য কোনো ব্যক্তি যে স্থানে তল্লাশি করা হবে সেই এলাকার দুই বা ততোধিক সম্মানিত বা গণ্যমান্য ব্যক্তিকে তল্লাশিতে হাজির থাকতে বা সাক্ষী হতে আহ্বান জানাবেন। প্রয়োজনে তল্লাশি কর্মকর্তা লিখিত আদেশ দিতে পারবেন।
এই ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, সম্মানিত/গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে তল্লাশি করতে হবে। ওই সময় যা পাওয়া গেছে সেগুলোর তালিকা প্রস্তুত করবেন, তালিকা প্রস্তুত হলে জব্দ তালিকায় উপস্থিত ব্যক্তিদের স্বাক্ষরও নিতে হবে।
(৩) উপধারায় রয়েছে, তল্লাশির স্থানে দখলদার উপস্থিত থাকতে পারবেন।
(৪) উপধারায় বলা হয়েছে, সাক্ষীদের স্বাক্ষরিত জব্দ তালিকার সমগ্র কপি উপস্থিত দখলদারকে দিতে হবে ।
(৫) উপ-ধারায় বলা আছে, লিখিত আদেশ দ্বারা আহ্বান করা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তল্লাশি কার্যক্রমে হাজির হতে বা সাক্ষী হতে অস্বীকার বা অবহেলা করেন তিনি দণ্ডবিধির ১৮৭ ধারায় অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন।
পি আর বি ও ফৌজদারী কার্যবিধির এ দুটি ধারার বিধান অনুসারে তল্লাশিতে উদ্ধারকৃত বস্তুগুলো ঘটনাস্থলে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করতে হবে এবং ঘটনাস্থলেই জব্দ ও নমুনা আলাদা করতে হবে এবং সেগুলোকে জব্দকারী অফিসার ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য যুক্ত লেভেল দ্বারা সিলগালা করতে হবে যাতে পরবর্তীতে এগুলোর মধ্যে কোনরুপ অপরাধমূলক দ্রব্য প্রবেশ করানো না যায়।
জব্দকৃত কথিত মাদকদ্রব্য থানার অফিসার-ইন চার্জ এর নিকট জমা দিতে হবে এবং সেগুলো অবশ্যই থানার প্রপার্টি রেজিষ্টারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মাদকের পরিমাণ বেশী হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে সংরক্ষণ করা অসুবিধাজনক হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা যাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর সেকশন ২৯(২) ধারা মতে। আর যদি এমন হয় যে, মাদকের পরিমাণ এত বেশী যে যেগুলো থানা পর্যন্ত পরিবহন করা অসুবিধাজনক, সেক্ষেত্রে ঘটনাস্থলেই সেগুলো ধ্বংস করা যাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর সেকশন ২৯(৩) ধারা মতে।
মাদক ধ্বংসের পর ঘটনাস্থলেই জব্দকৃত নমুনা আলামত আদালতের অনুমতি নিয়ে পিআরবি ৫২২ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠাতে হবে এবং কিছু আলামত আদালতে প্রদর্শনীর জন্য কোর্ট মালখানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যে নম্বরে মালখানায় কথিত বস্তুগুলো গ্রহণ করেছেন সেই কোর্ট মালখানা রেজিস্টার (সিএমআর) অভিযোগ পত্রের ৬ নং কলামে উল্লেখ করতে হবে। কোর্ট মালখানায় প্রেরিত কথিত মাদকদ্রব্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুসারে বিচারিক আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।
মাদকের এই পথ পরিক্রমায় সংবাদ প্রাপ্তি, তল্লাশি, উদ্ধার, জব্দ, রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য প্রেরণ, ধ্বংস, নমুনা মালখানায় প্রেরণ, আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করা-এগুলোর মধ্যে যদি কোনো একটি ব্যত্যয় ঘটে অর্থাৎ আসামীপক্ষ থেকে যদি এগুলোর কোন একটির অভাব উপস্থাপন করতে পারেন তাহলে আসামীকে খালাস দিতে হবে। কারণ উচ্চ আদালত বলছেন সন্দেহের সুবিধা আসামী পাইতে হকদার ও অধিকারী, মোটেই আদালতের দয়া নয়।
আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা আছে যে, মানুষের জীবন, সম্পত্তি, সুনাম বা স্বাধীনতার হানিকর কোনো কার্য আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে গ্রহণ করা যাবে না। কাজেই আইন যেভাবে বলছে ঠিক সেইভাবে আইনী ব্যবহার লাভ প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। জাবেদ ইমাম ভোলায় সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর নিউ মার্কেট থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর বহনকারী মাইক্রোবাস থেকে ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু মামলা দায়ের ও জব্দ তালিকায় ত্রুটি থাকায় মামলা দায়েরকারী পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেছিলেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট। ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল তাঁর দখল থেকে উদ্ধার করা হলেও তার ওজন বা পরিমাণ কত ছিল তা এজাহার বা চার্জশিটে উল্লেখ ছিল না। ওই ত্রুটির কারণে জাবেদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলেও বিচারিক আদালত জাবেদকে চার বছরের বেশি কারাদণ্ড দিতে পারেননি। পরবর্তীতে মামলায় দুর্বলতার সুযোগে হাইকোর্ট থেকে বেকসুর খালাস পান জাবেদ।
মাদকের মামলার জব্দ তালিকা, এজাহার ও তদন্তে এমন ত্রুটি থাকার ঘটনা অহরহ ঘটছে। ফলে মাদকের অধিকাংশ মামলায় আসামীরা খালাস পাচ্ছে। যদিও ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে উচ্চ আদালত বলেছেন, ঘটনাস্থলের তাৎক্ষণিক পরিস্থিতিতে হয়তো এমন সাক্ষী না পাওয়ায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সাক্ষী করা বাধ্যতামূলক নয়। বিষয়টি ৮ বিএলটি ৩৫২ পাতায় উল্লেখ রয়েছে। ফলে বিচারিক আদালতে আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষকে দুই ধরনের সিদ্ধান্ত শুনানির সময় উপস্থাপন করতে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিও দেখা দেয়। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত মূল আইন অনুসরণ করা। কারণ মূল আইন অনুসরণ না করলে আসামির সুবিধা পাওয়ার সুযোগ থাকে।
এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ আছে ৪৫ ডিএলআর ২৯৭ পৃষ্ঠায়। এ মামলায় হাইকোর্ট বলেছেন, সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি চালানোর বিধান করার লক্ষ্য হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভাব্য চাতুরী ও মনগড়া কিছু করার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ তৈরি করা। তল্লাশি যে সততার সঙ্গে হয়েছে তা নিশ্চিত করা তার জন্য বাধ্যতামূলক।
ফলে ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতাসহ আট কারণে মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য কারণগুলো হলো, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, আদালতে সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাও সাক্ষ্য দিতে আসেন না।
সম্প্রতি একটি মাদকের মামলায় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক লিখেছেন, মামলার বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা একই ব্যক্তি। তিনি উভয় ভূমিকায় সাক্ষ্য দেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হওয়ায় তাঁকে নিরপেক্ষ সাক্ষী বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। পর্যাপ্ত সময় পাওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপক্ষ সব সাক্ষীকে আদালতে হাজির না করায় আসামিপক্ষ সুবিধা পেয়েছে। আসামিকে মাদকসহ হাতেনাতে আটক করার বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে পারেনি। আসামীকে খালাস দেয়া হলো।
আরেকটি মাদক মামলায় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক লিখেছেন, দুই আসামির কাছ থেকে গাঁজা উদ্ধার করা হলেও জব্দ তালিকার সাক্ষীরা গাঁজা উদ্ধারের পক্ষে সাক্ষ্য দেননি। কেবল পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। এছাড়া রাষ্ট্রপক্ষ ঘটনাস্থলের, এজাহারের, অভিযোগপত্রের ও জব্দ তালিকায় উল্লিখিত সাক্ষী আদালতে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে আসামি খালাস পেয়েছেন।
হাইকোর্ট বলেছেন, রূঢ় বাস্তবতা হলো, ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৪৪ ধারা অনুসারে অপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। অথচ অদ্যবধি পর্যন্ত কোনো ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা বা বিকল্প হিসেবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা জজ বা দায়রা জজদের ট্রাইব্যুনাল হিসেবে কাজ পরিচালনার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আইনে কোনোরূপ সংশোধনও করা হয়নি। সৃষ্ট এ পরিস্থিতি অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও হতাশাজনক।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com