কামরুজ্জামান পলাশ: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা অন্যায়ের শিকার ব্যক্তি যারা আর্থিক অসহায়ত্ব ও অসচ্ছলতার জন্যে আদালতের দারস্থ হতে অপারগ। তারা সুবিচার কিভাবে পাবে? এই ধরনের আর্থিকভাবে অসহায় ও অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী কথা মাথায় রেখে তাদের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০০ সালে প্রণয়ন করা হয়, ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ (২০০০ সালের ৬ নং আইন)।
আইনগত সহায়তা কি?
লিগ্যাল এইড বা আইনী সহায়তা হলো এমন এক বিধান যারা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে নিজের কোন আইনী প্রতিনিধি বা উকিল নিয়োগ কিংবা আদালতের যাবতীয় ব্যয় বহন করতে অপারগ । তাদের জন্য আইনী পরামর্শের অধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক গঠিত আইনী সহায়তা প্রদান কার্যক্রমকে আইনী সহায়তা বলে।
এখন দেখে নেয়া যাক, কোন শ্রেণির ব্যক্তিগণ এই সেবার জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন। ‘আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা-২০১৪’ তে উক্ত ব্যক্তিবর্গের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন-
- আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যার বার্ষিকগড় আয় (সুপ্রীম কোর্টে আইনগত সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ) ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয়।
- কর্মে অক্ষম, আংশিক অক্ষম বা কর্মহীন কোন ব্যক্তি।
- বার্ষিক দেড় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম মুক্তিযোদ্ধা; এবং
- কোন শ্রমিক যার বার্ষিক গড় আয় এক লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয়।
তাছাড়া কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই নিম্নবর্নিত ব্যক্তিগণ উক্ত সেবার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
- কোন শিশু
- মানব পাচারের শিকার কোন মানুষ
- শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার কোন নারী বা শিশু
- নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে
- ক্ষুদ্র জাতিসত্তা বা নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের লোক
- পারিবারিক সহিংসতার শিকার বা সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছে এমন কোন ব্যক্তি
- বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন কোন ব্যক্তি
- ভি জি ডি কার্ডধারী কোন দুস্থ মাতা
- দুর্বৃত্ত কর্তৃক এসিড দগ্ধ নারী বা শিশু
- আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত কোন মহিলা
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি
- আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা বা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যক্তি
- বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ ব্যক্তি
- আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলিয়া বিবেচিত কোন ব্যক্তি ;এবং
- জেল কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলিয়া বিবেচিত কোন ব্যক্তি।
তাছাড়া বিনামূল্যে এই সেবাগ্রহীতাদের জন্য সরকারী আইনী সহায়তার জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার (টোল ফ্রি) ১৬৪৩০ রয়েছে যার মাধ্যমে আইনী সেবা পৌঁছে গেছে আর্থিকভাবে অসচ্ছলব্যক্তির নিকটে।
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এর অধীনে অসহায়, দুস্থ ও অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীর সুবিচার নিশ্চিত লক্ষ্যে আইনী সহায়তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠন করা হয় বিভিন্ন কমিটি। যেমনঃ
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এর ধারা-৮ক তে বলা হয়েছে সুপ্রীম কোর্ট কমিটি সম্পর্কে। উক্ত আইনের ধারা-৮খ তে সুপ্রীম কোর্ট কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যাতে বলা হয় যে,
- যোগ্যতা ও প্রণীত নীতিমালা অনুসারে অসহায়, দুস্থ ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীগনের আবেদন ও দরখাস্ত গ্রহণপূর্বক বিবেচনাক্রমে আইনগত সহায়তা প্রদান।
- মঞ্জুরকৃত আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রদত্ত আইনগত সহয়তার ধরন ও শর্ত নির্ধারণ করা।
- বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করা।
- জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা।
- বোর্ড কর্তৃক অর্পিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা।
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ ধারা-৯ তে বলা হয়েছে জেলা কমিটি সম্পর্কে। উক্ত আইনের ধারা-১০ তে জেলা কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যাতে বলা হয় যে,
- যোগ্যতা ও প্রণীত নীতিমালা অনুসারে অসহায়, দুস্থ ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীগনের আবেদন ও দরখাস্ত গ্রহনপূর্বক বিবেচনাক্রমে আইনগত সহায়তা প্রদান।
- জেলা পর্যায়ে আইনগত সহায়তা কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহন করা।
- আইনগত সহায়তা সম্পর্কে জনগনের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা।
- বোর্ড কর্তৃক অর্পিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা।
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এর ধারা-১২ তে বলা হয়েছে উপজেলা কমিটি ও ইউনিয়ন কমিটি সম্পর্কে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন, দায়িত্ব,কার্যাবলি ইত্যাদি) প্রবিধানমালা-২০১১ তে উপজেলা কমিটি ও ইউনিয়ন কমিটি’র দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যাতে বলা হয় যে,
- যোগ্যতা ও প্রণীত নীতিমালা অনুসারে অসহায়, দুস্থ ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল বিচারপ্রার্থীগণের আবেদন ও দরখাস্ত গ্রহণপূর্বক ইহা দ্রুত জেলা কমিটির নিকট প্রেরণ।
- আইনগত সহায়তা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- বোর্ড কর্তৃক অর্পিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা।
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ এর ধারা-১২ক তে বলা হয়েছে বিশেষ কমিটি সম্পর্কে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলি ইত্যাদি) প্রবিধানমালা-২০১৬ ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (শ্রম আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলি ইত্যাদি) প্রবিধানমালা-২০১৬ তে বিশেষ কমিটি’র দায়িত্ব ও কার্যাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে।
জাতীয় আইনগত সহয়তা প্রদান সংস্থার তথ্য মতে ২০০৯ খ্রিঃ থেকে ২০২২খ্রিঃ পর্যন্ত সেবা গ্রহণকারী সংখ্যা নিম্নরূপ
আইনী পরামর্শ সেবা: ২৯৩৭৫৩টি;
মামলায় আইনগত সহায়তা: আইনী সেবা ৩১৬৪২৮টি, নিষ্পত্তিকৃত ১৫০৩৯৯টি;
বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি সেবা: উদ্যোগ গ্রহণ ৬২৯৯২টি, নিষ্পত্তি ৫৫০৪৭টি, উপকারভোগীর সংখ্যা ৯৩৭৪২ জন;
হটলাইনের মাধ্যমে সেবা: ১৭৩২৮টি
মোট আইনী সেবা গ্রহীতা ৭,২৪,২৪৮ জন এবং এ সময় ক্ষতিপূরণ আদায় ৮৫,৬১,৭৬,৭৮৪ টাকা।
এইভাবে আইন ও নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে আইনী সেবা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া নিঃসন্দেহে সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ যা প্রসংশনীয়। আর্থিকভাবে অসহায় ও অসচ্ছল মানুষও সুবিচার পাবে একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের এই তো দৃষ্টান্ত।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি