সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম জনপ্রিয় আইনজীবী নেতৃত্ব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে একাধিক পদে নয় বার নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে শুধু সম্পাদক হিসেবে টানা সাতবার নির্বাচিত হয়ে সর্বোচ্চ আদালত অঙ্গনের আইনজীবী সমিতিতে অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছেন। আইন পেশার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতিতেও সক্রিয় তিনি। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) -এর রাজনীতিবিদ এবং নোয়াখালী -১ আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। মাহবুব উদ্দিন খোকন ২০০৮ সালে বিএনপির প্রার্থী হিসাবে নোয়াখালী-১ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীও। তিনি ঢাকায় অবস্থিত আইন সংস্থা ‘মাহবুব অ্যান্ড কোম্পানির’ প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান।
সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাৎকারে জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবীর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচি। আইনজীবীদের নেতৃত্ব প্রদানে অভূতপূর্ব সাফল্য, সমিতি ও আইনজীবীদের কল্যাণে তাঁর কৃতকর্মের ফিরিস্তি, বার কাউন্সিল প্রসঙ্গ নিয়ে সাজানো হয়েছে সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: সর্বোচ্চ আদালতে আইনজীবীদের সংগঠন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের টানা ৭ বারের নির্বাচিত সম্পাদক আপনি, কীভাবে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করলেন! কোন যাদুর কাঠি নাকি আপনার দায়িত্ববোধ ও ধারাবাহিক কাজের সুফল?
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মোটমাট নয় বার নির্বাচিত হয়েছি। এরমধ্যে সাতবার সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। অন্য দু’বার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছি। বিষয়টি আমাকেও ভাবায়, আইনজীবীরা কেন ভোট দেন। ভাবনার উপসংহারে ব্যক্তিগতভাবে কিছু যুক্তি খুঁজে পাই। আমার ধারণা আইনজীবীরা ভোট দেওয়ার প্রথম কারণ হতে পারে- আমার সরলতা, সততা, তাঁরা বিশ্বাস করেন আমি সৎ। পরম করুণাময়ের অসীম দয়ায় দায়িত্বপালনে সর্বদা সততা ও নিষ্ঠা বজায় রাখতে পেরেছি। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে- দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও দলকানা ছিলাম না। নির্বাচিত হওয়ার পর দলমতে ঊর্ধ্বে ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। সকল নির্বাচিত প্রতিনিধির মানসিকতা এমনই হওয়া উচিত। এছাড়া আমি ক্ষতিকারক নই, সজ্ঞানে আমার দ্বারা কারো ক্ষতি হয়নি কখনো। সম্ভবত আমার সারল্য, সততা এবং ক্ষতিকারক না হওয়ার প্রবণতা বিবেচনায় আইনজীবীরা বারবার আমাকে নির্বাচিত করেছেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আইনজীবী ও সমিতির কল্যাণে বাস্তবায়িত আপনার উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন…
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন: সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন করা এক সময় আইনজীবীদের শখে পরিণত হয়েছিল। মূলত সীমিত সংখ্যক আইনজীবী হওয়ায় এমনটা হতো। মাত্র এক থেকে দেড় হাজার সদস্যের সংগঠন ছিল তখন। কিন্তু পর্যায়ক্রমে সংখ্যাটা বেড়েছে। ফলে সমিতির নেতৃত্ব দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। প্রায় দশ-এগারো হাজার আইনজীবীর এ সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করা কঠিন দায়িত্ব। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, পবিত্র অঙ্গনের আইনজীবীদের সংগঠন এটি। খামখেয়ালীর সুযোগ নেই, সার্বক্ষনিক সজাগ থাকতে হয়। প্রধান নির্বাহীর মতো সমিতির মূল দায়িত্বটা সম্পাদককেই পালন করতে হয়। আমি সম্পাদক থাকাকালীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম যে বিষয়টি মীমাংসা করতে পেরেছি, তা হল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে ৩৫ বছর বয়সের পর যারা সদস্য হতেন তাঁরা সমিতির ‘সাধারণ সদস্য’ ছাড়া কিছুই না। অর্থাৎ সমিতির অন্যান্যরা বেনাভোলেন্ট ফান্ডের সুবিধাভোগী হলেও ৩৫ বছরের বেশি বয়সে সমিতির সদস্য হলে এসব আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। সে সময় সুপ্রিম বারের সদস্য সংখ্যা ছিল ৪ হাজারের মতো এর মধ্যে প্রায় ১২-১৩ শ’ সদস্য এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ বেনাভোলেন্ট ফান্ডের টাকা কিন্তু সকল সদস্যের সিট ভাড়া (কিউবিকল ফি), ওকালতনামা থেকেই বেনাভোলেন্ট ফান্ডে টাকা জমা হত। বিষয়টি অযৌক্তিক মনে হল। ২০১৪ সালে রাজনৈতিক কারণে একবার কারাগারে যেতে হয়েছিল। জেলে বসেই বিষয়টি নিয়ে ভাবার সুযোগ পাই। সমিতির বঞ্চিত সদস্যের সুযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন একটি খাত তৈরির পরিকল্পনা করি। নাম দিলাম ‘contributory benefit’ অর্থাৎ যারা কন্ট্রিবিউট করবেন, তাঁরা বেনিফিট পাবেন। জেল থেকে বেরিয়ে সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ডেকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি উপ কমিটি গঠন করে দিলাম। এরপর প্রস্তাবটি সাধারণ সভায় পাশ করা হল। বছরে আট হাজার টাকা জমা দিয়ে সমিতির সুবিধা বঞ্চিত সেসব সদস্যদের নামে ৫০ হাজার টাকা জমা হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় আড়াই হাজার সদস্য এ সুবিধা ভোগ করছেন।
আদালত প্রাঙ্গণে বই মেলার আয়োজন করেছি। এটিও অভূতপূর্ব। এর আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে বইমেলার চল ছিল না। এখন কিন্তু জাঁকজমকভাবে বইমেলা হয়, প্রধান বিচারপতি মেলার উদ্বোধন করেন। সমিতির লাইব্রেরির অবস্থা অত্যন্ত করুণ ছিল। না ছিল একটা কম্পিউটার, না ছিল পর্যাপ্ত বই। পরে একটি ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় বেশ কিছু কম্পিউটার স্থাপনসহ সমিতির পাঠাগার মানসম্মত ও আধুনিকায়নের চেষ্টা করেছি। সম্পাদক থাকাকালীন আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, একটি ল’ইয়ার্স ক্লাব করা। এপ্রেক্ষিতে একটি অস্থায়ী ল’ইয়ার্স ক্লাব করেছি।
সমিতিতে প্রায় ১৮-১৯ শ’ নারী সদস্য রয়েছে। এদের অনেকেই সন্তান বাসায় রেখে আদালতে আসতে নিরাপদ বোধ করতেন না। নারী আইনজীবীদের কাজের সুবিধার্থে চাইল্ড কেয়ার স্থাপন করেছি।
আইনজীবীদের শের-ই বাংলা ভবনের কাজ পূর্বসূরী সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন ও সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদীর নেতৃত্বে দেড়তলা পর্যন্ত করতে পেরেছিলেন। পরবর্তীতে আমি দায়িত্বগ্রহণের পর ভবনটি আটতলা পর্যন্ত করতে সক্ষম হয়েছি। যদিও এখানে নানান জটিলতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। প্রথম ভবনটি বহুতল করণের ক্ষেত্রে পিডব্লিউডি (গণপূর্ত অধিদপ্তর) থেকে জানানো হয় ৪ তলার বেশি করা সম্ভব নয়। এরমধ্যে আবার তৎকালীন প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে পুলিশ পাঠিয়ে স্থাপনা ভেঙ্গে দেওয়াসহ নানা সমস্যা ডিঙ্গিয়ে নতুন করে পিলার করে রিঅ্যাক্টিফিকেশনের মাধ্যমে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণ করেছি। এখন ভবনটি মোট নয়তলা হয়েছে।
এছাড়াও আদালত প্রাঙ্গণে ছোট একটা জায়গা ছিল, যা কারো নজরে আসেনি। সেখানে সোহরাওয়ার্দী ভবন নির্মাণ করেছি। এ ক্ষেত্রেও নানা বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। ভবনের পাইলিং শুরুর পর দাঙ্গা পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে গেছে। একপ্রকার যুদ্ধ করেই ১০তলা ভবনের কাজ শেষ করেছি।
সুন্দর কর্মপরিবেশ সৃষ্টিসহ পেশাগত উন্নয়নেও কাজ করেছি। পাশাপাশি আদালত অঙ্গন থেকে টাউট উচ্ছেদেও ভূমিকা রেখেছি। প্রায় ৩০ বছর ভুয়া সনদ, জাল সার্টিফিকেট দিয়ে প্র্যাকটিস করে যাচ্ছেন এমন বেশকিছু টাউট নারী-পুরুষকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বিতাড়িত করেছি। অভিযুক্তদের দাখিল করা শিক্ষা সনদ দেখে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়ে সঠিক অনুসন্ধান করে সত্যতা পাওয়ার পর সমিতির সদস্যপদ বাতিল করেছি। এক্ষেত্রে আমি দলমত দেখিনি, সে যে-ই হোক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। যদিও অনেকেই সেসব টাউটদের ভালো আইনজীবী বলেই জানতেন! অথচ শিক্ষা সনদই ভুয়া! চিহ্নিত এসব টাউটদের ছবিও আদালত অঙ্গনে টানিয়ে দিয়েছি যাতে কেউ প্রতারিত না হয়।
সুপ্রিম কোর্টে দালালদের দৌরাত্ম ছিল। প্রতিমাসে অন্তত এক-দু’বার অভিযান চালিয়ে দালাল নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। যাতে এদের খপ্পরে পড়ে বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হন।
দায়িত্বপালনকালে সবসময় সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা, আইনজীবীদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছি। স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং বিচার কাজে বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সমিতি সবসময় প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কাজ করেছে। দেশের রাজনৈতিক সমস্যা যেন সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারেও সজাগ থেকেছি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন, আইনজীবী নিবন্ধন ছাড়া বার কাউন্সিলের আর কি কি কাজ রয়েছে? সেই সাথে এসব কাজে বার কাউন্সিলের সফলতা ব্যর্থতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন।
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন: বার কাউন্সিলের কাজ শুধু সনদ দেওয়া নয়। সনদ প্রদানের পর আইনজীবীদের পেশাগত আচরণ বিধি ও নীতি-নৈতিকতা মেনে চলছে কি না এসব তদারকি করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়াও আইনজীবীদের সনদ প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে বার কাউন্সিল আরো কিছু দায়িত্ব পালন করা জরুরি। যেমন প্রতি মাসেই দেশে নতুন কোন আইন হয়েছে কি না, পুরনো কোন আইন সংশোধন হয়েছে কি না এগুলোর হালনাগাদ তথ্য জেলা বার সমূহে পাঠানো উচিত। এতে করে আইনজীবীরা সর্বশেষ প্রণীত আইন কিংবা আনীত সংশোধন সম্পর্কে আপ-টু-ডেট থাকবে। কারণ প্রত্যেক আইনজীবী বার কাউন্সিলকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করতে হয়। এ প্রেক্ষিতে কাউন্সিলের ওপর আইনজীবীদের কিছু সেবা প্রদানের দায় বর্তায়। আইনজীবীদের ভালো-মন্দ দেখভাল করা সহ পেশাগত মানোন্নয়নেও বার কাউন্সিলের কাজ করা দরকার।
অথচ বার কাউন্সিল নিয়ে আইনজীবীদের অভিযোগের শেষ নেই। এটা একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। ধরুণ একটা চিঠি দিলেন, ছয় মাসেও তার উত্তর পাওয়া যাবে না। এছাড়া বার কাউন্সিলের বেশিরভাগ কর্মচারি পদোন্নতিমূলে উচ্চপদে নিয়োগ পাচ্ছে। ফলে আধুনিক তথা ডিজিটাল পদ্ধতির নানান ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছে। জনবল সংকট তো রয়েছে, দক্ষ জনবল সংকট অধিক হারে রয়েছে।
এছাড়া বার কাউন্সিলের নির্বাচিত কমিটির সবাই দলীয় মনোনয়নে নির্বাচনে অংশ নিলেও নির্বাচিত হওয়ার পর দলমত ভুলে গিয়ে আইনজীবীদের কল্যাণ ও স্বার্থে কাজ করা জরুরি।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: ভবিষ্যতে আইনজীবী সমিতির সর্বোচ্চ পদ তথা সভাপতি পদে আপনাকে দেখা যাবে কি?
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন: এটা আসলে দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমার এ ব্যাপারে তাড়াহুড়া নেই। দল যদি কখনো মনে করে এ পদে আমি যোগ্য এবং দল থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা পাই তখন ভেবে দেখবো।
ল’ইয়ার্স ক্লাব: তৈরি হওয়ার জন্য সময় নিচ্ছেন কী?
ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন: নির্বাচনের জন্য আমার তৈরি হতে হয়না। আমি সর্বদাই প্রস্তুত। সমিতির নির্বাচন কেন জাতীয় নির্বাচনের জন্যও যদি আমাকে ২ সপ্তাহ সময় দেয় আমি নির্বাচনে নেমে পড়ব। কারণ ছোট বেলা থেকেই নির্বাচন করতে করতে আমি অভ্যস্ত। নতুন করে প্রস্তুত হওয়ার কিছু নেই।
আরও পড়ুন- অধস্তন আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনয়নে উচ্চ আদালত থেকে মনিটরিং প্রয়োজন