ব্যারিস্টার আবদুল হালিম
ব্যারিস্টার আবদুল হালিম

মানবাধিকার কমিশনের দাঁত-জিহ্বা দু’টোই আছে, কিন্তু প্রয়োগ করছে না

সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতিমান আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল হালিম। অনন্য অসাধারণ মেধাবী আবদুল হালিম ছাত্রজীবন থেকেই সাংবিধানিক আইনসহ আইন বিষয়ক অসংখ্য বই লিখেছেন। শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনস্বার্থে অগণিত মামলায় আইনি লড়াই করে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি। অসহায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা দিতে চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ (সিসিবি) ফাউন্ডেশন গড়ে তুলেছেন। শাজাহানপুরে রেলওয়ে কলোনিতে পাইপের মধ্যে আটকা পড়ে শিশু জিহাদ মারা যাওয়ার ঘটনায় উচ্চ আদালতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন তিনি। শিশু জিহাদের মামলায় বাংলাদেশে সর্বপ্রথম সাংবিধানিক আইনে ক্ষতিপূরণের দ্বার উন্মোচিত হয়।

আরও একটি প্রথমের প্রবর্তক তিনি। তা হল বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা। পুলিশ কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার গৃহকর্মী খাদিজার পক্ষে দীর্ঘ ৯ বছর নাছোড়বান্দার মতো আইনি লড়াইয়ে লেগে থাকার ফলস্বরূপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়। এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম। সম্পাদক অ্যাডভোকেট বদরুল হাসান কচির নেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: নয় বছর এই সামান্য বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করলেন!

ব্যারিস্টার হালিম: সংগ্রামের শুরু সামান্য দিয়েই হয়। খাদিজার মানবাধিকার লঙ্ঘন সামান্য হতে পারে কিন্তু এর ব্যপ্তি অনেক বড়। এই ছোট মানবাধিকার লঙ্ঘনটাই কিন্তু বলে দিচ্ছে দেশের অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা যায়।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: নয় বছর একটা দীর্ঘ সময়, এটা কি অতিরিক্ত না?

ব্যারিস্টার হালিম: শুধু দীর্ঘ কিংবা অতিরিক্তই কেবল নয়, ছোট এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি সনাক্ত করতে মানবাধিকার কমিশন সময় নিয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেই নাই। ছয় বছর কমিশনকে কেবল তাগাদা দিয়েছি। ছয় বছর পর প্রথম যখন মানবাধিকার কমিশন নতুন করে খাদিজার নির্যাতনের বিষয়কে শুনানি করতে ডাকল, তখন আমার সিসিবি ফাউন্ডেশন থেকে ভাবলাম কমিশন অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছে। কমিশন পুলিশের বিরুদ্ধে গাফলতি পেয়ে গেছে। সরকারের বিরুদ্ধে খাদিজাকে যাতে ক্ষতিপূরণের জন্য সুপারিশ করে তাঁর জন্য ব্যবস্থা নিতে পত্র দেই। কিন্তু কমিশন উল্টো সিসিবি ফাউন্ডেশনকে শুনানিতে ডাকে। এ প্রেক্ষিতে কমিশনকে লিগ্যাল নোটিশ জারি করে কমিশনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে রিট করি। হাইকোর্ট কার্যক্রমে ২০১৮ সালের রুল ২০১৯ সালেই শুনানি করে খাদিজার পক্ষে রায় পাই। হাইকোর্ট কমিশনকে নির্দেশনা দেয় যাতে খাদিজার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি শুনানি করে নিষ্পত্তি করে এবং সাথে সাথে হাইকোর্ট আরও বলে আইনের ১৯ ধারা মোতাবেক ভুক্তভোগী খাদিজাকে ক্ষতিপূরণের সুপারিশও যেন তারা করে। আমরা সাহস পেলাম। কমিশনে নতুন করে শুনানি হল। লিখিত সাবমিশন দিলাম। দু’দিন শুনানি হল। শুনানিতে খাদিজা (ভিডিওতে –স্পষ্ট না) সাক্ষী দিয়েছে। খাদিজা এত বছর পরেও তার অমানবিক নির্যাতন ভুলতে পারেনি। সে কমিশনের সকল সদস্যদের সামনে বিচার চায়। কমিশন সকলের শুনানি গ্রহণ করে এই প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য খাদিজাকে ৫০ হাজার তাকা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: কমিশনের সুপারিশ কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করে?

ব্যারিস্টার হালিম: না, প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করে না। কমিশনের সুপারিশের পরেও আমাদেরকে আরও প্রায় দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়। সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও যখন দেখলাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি, তখন আমরা প্রথমে কমিশনকে তাগিদপত্র দিলাম। হাইকোর্টের রায়ে একটা নির্দেশনা ছিল। কমিশনের সুপারিশ না মানলে কমিশন যেন হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে। তাগিদপত্র দেওয়ার পরেও এক বছর পেরিয়ে যায়। আমি তখন কমিশনে যোগাযোগ করি। কমিশন থেকে বলা হল সুপারিশ না মামলে কমিশনের কি করার আছে? তখন আমি কমিশনকে আইনি নোটিশ দিলাম। এরপর কমিশন আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবকে শুনানিতে তলব করে। শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষ হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষতিপূরণ দেয় না। কমিশন কেন হাইকোর্টে গেল না, এই না যাওয়াটা হাইকোর্টের রায়ের লঙ্ঘন। এ কারনে কমিশনকে আবারও তাগাদা দিলাম। এর কিছুদিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খাদিজার নামে ৫০ হাজার তাকার চেক প্রস্তুত করে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: পত্রিকায় এবং ছবিতে দেখেছি খাদিজা ভান্ডারিয়া ইউএনও –এর কাছ থেকে চেক গ্রহণ করেছে। আপনি খাদিজার জন্য নয় বছর সংগ্রাম করলেন। খাদিজাকে সামনাসামনি দেখেছেন?

ব্যারিস্টার হালিম: খাদিজাকে সামনা সামনি কখনোই দেখিনি। আমার সিসিবি ফাউন্ডেশন মামলাটি করেছিল জনস্বার্থেই। জনস্বার্থে মামলা করলে যার উপকারে মামলা করা হয় তার সামনাসামনি দেখা করার প্রয়োজন পড়ে না।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: খাদিজা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে, আপনি যে দীর্ঘ ৯ বছর লেগে থাকলেন, মূল আইনি লড়াইটা আপনিই করলেন, আপনার কেমন লাগছে?

ব্যারিস্টার হালিম: ভাল লাগছে অবশ্যই। কারন নয় বছর পরে হলেও যে সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এটা গরীবের মানবাধিকার রক্ষায় একটা বড় অর্জন। একযুগ ধরে কমিশন বলে আসছিল- কমিশনের জিহ্বা আছে কিন্তু দাঁত নেই। এখন প্রমাণিত হল যে, কমিশনের দাঁত, জিহ্বা দু’টোই আছে। কিন্তু সে প্রয়োগ করছে না। কমিশন আইনি প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করলে সরকার সেটা মানতে বাধ্য।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: দেশে এত গুম, ক্রসফায়ার, ধর্ষণ, বিশেষ করে শিশুদের ওপর নির্যাতন- এগুলোর বিষয়েও কি কমিশন ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করতে পারে?

ব্যারিস্টার হালিম: মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে এবং মানবাধিকার রক্ষায় কমিশনের এই কাজটা অর্থাৎ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য- এই বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করাই কমিশনের মূল কাজ। সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না। একটা মানুষ গুম হওয়ার সাথে সাথে তার সব মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। এ ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিশনের উচিত সরকারের কাছ থেকে প্রতিবেদন চাওয়া। প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট না হলেই প্রাথমিকভাবে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা উচিত। বাস্তবে কমিশন যা করে তা হল অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য একটা পত্র দিয়ে দায় সারে। কিন্তু অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা এবং বিচার করা- এগুলো কমিশনের কাজ না। কমিশনের কাজ হলো মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেই কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়ে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা। সরকার ক্ষতিপূরণ না দিলে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করা করা। গত এক যুগে কমিশন হাইকোর্টে আসেনি। তার অভিযোগ নিষ্পত্তির কার্যক্রম ঠিক করেনি। অভিযোগ নিষ্পত্তি সে কিভাবে করছে তা নিজেও জানেনা। আইনের ৩০ ধারার অধীনে অভিযোগ নিষ্পত্তির বিধিমালাও তৈরি করেনি।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: শেষ কথা কী কমিশন সম্পর্কে?

ব্যারিস্টার হালিম: শেষ কথা বলে কিছু নেই। কমিশনকে কাজ করতে হবে মানবাধিকার রক্ষায়। খাদিজার মতো ঘটনা হাজার হাজার ঘটে চলছে দেশে। কমিশনের উচিত হবে দেরি না করে খুব দ্রুত কয়েকটা অভিযোগে সরকারকে ক্ষতিপূরণের আওতায় আনা। সরকারকে মানবাধিকার রক্ষায় জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা এবং ক্ষতিপূরণ আদালত করার অন্যদিক হলো সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা। ভারতের কমিশন মাসে পঞ্চাশ থেকে ষাট লাখ ভারতিয় রুপি সরকারকে ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করে এবং সেটা ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিশ্চিত করে। কমিশন যেটা করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ সেটা করলেই আমরা খুশি হব। মানুষ খুশি হবে।

ল’ইয়ার্স ক্লাব: আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছু সময় ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।