সিরাজ প্রামাণিক: ‘ইফতার পার্টি’ শব্দের সাথে ধর্মের, না রাজনীতির, না রোজা’র কি সম্পর্ক আছে-সে বিষয়ে পন্ডিতরা সমাধান দিবেন। তবে ইফতার পার্টিতে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এই লেখার প্রতিপাদ্য।
সম্প্রতি সুধীজনদের নিয়ে যশোর জেলা প্রশাসনের ইফতার অনুষ্ঠানে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ইখতিয়ারুল ইসলাম মল্লিকের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের আসামীর জামিন বিষয়ে বাগবিতন্ডার ঘটনা নিয়ে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফেসবুক, চায়ের দোকান ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরগরম হয়ে উঠেছিল। এ যেন বাঘে-মহিষে লড়াই।
হত্যা মামলায় যশোর জেলা ছাত্রলীগের এক নেতার জামিন না দেওয়ায় গত ২৮ এপ্রিল যশোর সার্কিট হাউসে ওই ঘটনা ঘটে। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে শাহীন চাকলাদার উঠে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ ইখতিয়ারুল ইসলামের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। এ সময় সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উঠে দাঁড়ান। তখন শাহীন চাকলাদার জজ সাহেবের কাছে জানতে চান ছাত্রলীগ নেতা রওশন ইকবাল শাহী কেন জামিন পাননি। একজন জনপ্রতিনিধির এমন প্রশ্নে বিব্রত হন জজ সাহেব। বিষয়টি তাঁর এখতিয়ারভুক্ত নয় বলে জানান। শাহীন চাকলাদারকে তিনি বলেন, ‘আপনি এটা বলতে পারেন না।’ এরপর পরিস্থিতি খানিকটা উত্তপ্ত হয়।
একজন বিচারক পাবলিক প্লেসে অনুষ্ঠিত এ ধরণের ইফতার পার্টিতে তিনি অংশ নিতে পারেন কি-না সে বিতর্কের অবসান ঘটাতে বিচারকদের পালনীয় নির্দেশাবলী সম্পর্কে জানতে হবে। বিচারকদের পেশাদারিত্ব ও নৈতিক মানদণ্ড কেমন হবে, কোন কোন বিষয়ে তাদের সচেতন থাকতে হবে, কোন ধরনের আচরণ পরিহার করতে হবে, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাদের কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে- তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে এই আচরণ বিধিতে।
আপিল বিভাগ বলেছেন, এই আচরণবিধি মেনে না চললে তা বিচারকের অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। অভিযোগ পেলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করে তাকে অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে।
একটি ছোট্ট কেস স্টাডি দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ১৯৪৮-৪৯ সালের ঘটনা। আপনারা নিশ্চয়ই তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনীতিক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর নাম শুনে থাকবেন। একজন আদর্শ রাজনীতিক হিসেবে এ উপমহাদেশে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
একদা স্থানীয় এমএলএ মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার এলাকা পাবনায় গেলে সরকারী প্রকৌশলীর বাসভবনে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে বসেন। ধর্মপ্রাণ মাওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজ শেষে সবার সাথে চা পানের ফাঁকে ওই বৈঠকে হাজির সাব ডিভিশনাল মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজ) কে একটা চলমান দেওয়ানী মামলা খারিজ করে দেয়ার জন্য বলেন।
স্থানীয় এমএলএর এহেন কাজ বিচারকাজে মারাত্মক হস্তক্ষেপ উল্লেখে মুন্সেফ সাহেব মাননীয় জেলা জজের মাধ্যমে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করলেন। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সাহেবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করল।
অভিযুক্ত তার আইনজীবী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আদালতে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে আদালতের দয়ার উপর ছেড়ে দেন। শেরে এ বাংলা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর মহান অবদান আর ধর্মনিষ্ঠ রাজনীতিকের আইনের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার কথা জানিয়ে অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য নিবেদন করেন।
বিচারপতি ইলিস রীতিরকম মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর এরকম দুঃখ প্রকাশকে গ্রহণ না করে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ না করে সে বিবেচনায় মাওলানাকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচশ রুপি জরিমানা অনাদায়ে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। (১ ডিএলআর ১৭৮ পৃষ্ঠা)।
এর পূর্বে কুষ্টিয়া আদালতের একজন বিচারককে পুলিশ সুপার কর্তৃক অপমানের ঘটনা আমিই প্রথম লেখনীর মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। ‘জাস্টিস অব দ্যা পিস’ সম্পর্কে বিস্তারিত দেশবাসীকে জানিয়ে অনেকের রোষানলেও পড়েছিলাম। সেসব কথা যাক। বুকে সাহস থাকলে আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর মতো সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের আরেকটি সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সাধারণ মানুষদের মধ্যে পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনুন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com