শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: আইন পেশা হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতমসব অভিজাত পেশারমধ্যে অন্যতম। আইনজীবীরা জাতির বিবেক ও দর্পণ এবং দিকনির্দেশক। প্রাচীনযুগ থেকে বলা হয়, ‘সেই শহরে বসবাস করা নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যে শহরে কিনা একজনও আইনজীবী নেই।’ আরও বলা হয়, সমাজে একজন ডাক্তারের পর যদি আরও একজন ব্যক্তির প্রয়োজন হয় তা নিঃসন্দেহে একজন আইনজীবী। এ পেশার মানুষগুলোর নামের আগে ‘বিজ্ঞ’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ ‘বিজ্ঞ আইনজীবী’ বলার মাধ্যমে এ পেশার আভিজাত্যকে ফুটিয়ে তোলা হয় নিপুণ সৌন্দর্যে। তাই বলা হয় Lawyers are learned, judges are honorable. বাঙ্গালি আইনজীবীদের অতীত ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল।
এককালে ব্রিটিশ-শাসিত পাক্-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যখন সুশিক্ষিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়েছিল, সেই দুর্যোগময় সংকটকালে এই উকিল বা আইনজীবী সম্প্রদায় থেকেই নেতৃত্বের উদ্ভব হয়েছিল। সেদিন এবং আজও অন্যায় শক্তির নির্মম ও প্রচন্ড মোকাবেলায় যাদের নির্ভীক ও বলিষ্ঠ কন্ঠ সোচ্চার তারা বহুলাংশই এসেছেন আইনজীবী সম্প্রদায় থেকে।
জানা যায়, আইন পেশা চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আইনের সূতিকাগার প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সে সর্বপ্রথম আইন পেশার চর্চা শুরু হয়। বাংলাদেশে এ পেশার ইতিহাস পুরনো ও গৌরবময়। প্রাচীনকালে এদেশে আইন পেশার প্রচলন থাকলেও তা আধুনিককালের মতো সুসংগঠিত ছিলনা। প্রাচীনকালে ছোট ছোট রাজ্যের রাজারা নিজেই বিচারকাজ পরিচালনা করতেন। রাজার আদেশ সবাই আইন হিসেবে মান্য করতেন। অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ও মন্ত্রীমণ্ডলী রাজার বিচারকাজে সাহায্য করতেন। মুসলিম শাসনামলে ইসলামি শরিয়াহ আইনে বিশেষজ্ঞ কাজী (বিচারক) ও মুফতি (আইনজীবীরা) বিচারকাজ পরিচালনা করতেন এবং একই ভূমিকা পালন করতেন হিন্দু পণ্ডিতরাও। তখন আইন পেশার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলনা। মুসলিম শাসনামলে বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়। এ সময়ে আইনজীবীরা উকিল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তখনো উকিলদের সনদপত্র দেওয়ার বিধান গড়ে ওঠেনি।
বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া শাসনামলে আধুনিক ধারার আইন পেশার চর্চা শুরু হয়। উনিশ শতকের ঢাকার পেশাজীবীগ্রন্থে লেখক মুন্সী আরমান আলী লিখেছেন, ‘১৭৭৩ সাল থেকে বাদী ও বিবাদীপক্ষে ‘উকিল বা আইনজীবী নিয়োগের পন্থা বিচার ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়।’ এসময় বিভিন্ন জায়গায় আদালত প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথমদিকে ইংরেজ উকিলরা মামলা পরিচালনা করলেও পরে পেশাটি বাঙালিদের হাতে আসে। উকিল নির্বাচনে প্রথমদিকে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিলনা। আগ্রহী, শিক্ষিত, যোগ্য, সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা এ পদের জন্য মনোনীত হতো।
‘বাংলাপিডিয়া’-তে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক লিখেছেন ‘১৭৭৪ সকলে এক রাজকীয় সনদের বলে কলকাতার সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সনদের ১১ নং অনুচ্ছেদে কলকাতা সুপ্রিম কোর্টকে অ্যাডভোকেট ও অ্যাটর্নিদের সনদ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। উক্ত সনদ ছাড়া আদালতে কেউ মামলা পরিচলানা করতে পারতেন না। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের সনদ বাতিল করতে পারতো।’
গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কোম্পানির বিচারকাজের সুবিধার্থে ১৭৯৩ সালে আইনের মাধ্যমে ইংরেজ আদলে আইন পেশার সূচনা করেন। ১৭৯৩ সালে এ ব্যবস্থা কর্নওয়ালিস কোড-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৯৩ সালের প্রবিধান-৭-এর আওতায় সদর দেওয়ানি আদালতে অথবা তার অধীনস্ত আদালতে আইন ব্যবসায়ের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের উকিল হিসেবে সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। সাধারণত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষিত সৎ হিন্দু ও মুসলিম আইনজ্ঞদেরকে সদর দেওয়ানি আদালত বা কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত অধীনস্ত আদালতে মামলা পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হতো।
১৮১৪ সালে প্রবিধান ২৭-এর মাধ্যমে জেলা আদালতগুলোকে ঐসব আদালতে আইন ব্যবসায়ের জন্য উকিলদের সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৮৩৩ সালের প্রবিধান ১২-এর আওতায় সদর দেওয়ানি ও নিজামত আদালতে আইন ব্যবসার জন্য উকিলদের সনদপত্র প্রদানের বিধান রাখা হয়। ১৮৪৬ সালে লিগ্যাল প্রাকটিশনার্স অ্যাক্টে অ্যাডভোকেটদের যোগ্যতা ও কার্যাবলি নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়।
ওকালতির জন্য তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় যোগ্যতা অর্জনকারী ব্যক্তিদের সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা ১৮৫০ সালে প্রবর্তন করা হয়। এ ক্ষেত্রে আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উকিল হিসেবে নিয়োগের জন্য এধরনের তালিকাভুক্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো না। ১৮৬২ সালে সুপ্রিম কোর্ট, সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত আদালত তুলে দিয়ে কলকাতায় কোর্ট উইলিয়ামে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। এ আদালত অ্যাডভোকেট, অ্যাটর্নি, উকিল, কৌঁশুলিও মোক্তারদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লাভ করে। উল্লেখ্য অ্যাডভোকেটরা ছিলেন ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড থেকে পাস করা ব্যারিস্টার অথবা স্কটল্যান্ডের ফ্যাকাল্টি অব অ্যাডভোকেটস-এর সদস্য।
১৮৬৫ সালে লিগ্যাল প্রাক্টিশনার্স অ্যাক্টের বিধান মতে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের উকিল, মোক্তার বা রাজস্ব এজেন্টদের আইন ব্যবসায়ের জন্য সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা হয়। ১৮৭৬ সালের লিগ্যাল প্রাক্টিশনার্স অ্যাক্টের আওতায় হাইকোর্টকে উকিল, মোক্তার ও রাজস্ব এজেন্টদের সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। উকিলরা সকল অধীনস্ত দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত এবং রাজস্ব দপ্তরগুলোতে আইন ব্যবসা করতে পারতেন; আর মোক্তারা শুধু ফৌজদারি আদালতে এবং রাজস্ব এজেন্টরা কেবল রাজস্ব দপ্তরে আইন ব্যবসার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। প্রথম অবস্থায়, অ্যাডভোকেটরা কলকাতা হাইকোর্টের মূল বিভাগে হাজিরা দিতে ও ওকালতি করতে পারতেন এবং ওই আদালতের আপিল বিভাগ ও অন্যান্য অধস্তন আদালতে ওকালতি করার অনুমতি পেতেন। কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন দেশিয় আইনজীবীদের মধ্য থেকে তালিকাভুক্ত কলকাতা হাইকোর্টের উকিলদের ওই আদালতে মূল বিভাগে কাজ করার অধিকার ছিলনা। তাই দেশে একটি সর্বভারতীয় বার গঠন এবং অ্যাডভোকেট ও উকিলদের মধ্যে পার্থক্য নিরসনের দাবি ওঠে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্যার এডওয়ার্ড চ্যাম্পিয়ারকে সভাপতি করে ১৯২৩ সালে ঐ কমিটি প্রতিবেদন পেশ করে। এ প্রেক্ষিতেই ১৯২৬ সালে ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল অ্যাক্টের মাধ্যমে অ্যাডভোকেট এবং উকিলদের মধ্যকার এ পার্থক্যের অবসান ঘটে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৫ সালের লিগ্যাল প্রাক্টিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্টের মাধ্যমে অ্যাডভোকেট ও অন্যান্য আইন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরাজমান পার্থক্যের নিরসন করে দু-শ্রেণির তালিকাভুক্তির বিধান করা হয়। এর একটি শ্রেণি হাইকোর্ট এবং অন্যরা অধীনস্থ আদালতগুলোতে আইন ব্যবসার অধিকার লাভ করেন। এ আইনে উকিল, মোক্তার ও রাজস্ব এজেন্ট অভিধা বিলোপ করে এদের নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেট পদবি প্রদান করা হয়। নিম্ন আদালতের একজন অ্যাডভোকেট কয়েক বছর আইন ব্যবসার পর হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারতেন।
১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ লিগ্যাল প্রাক্টিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ৪৬ নং আদেশ)-এর বিধান অনুসারে অ্যাডভোকেটগণ তালিকাভুক্ত হয়ে আসছেন এবং উক্ত বিধান দ্বারা তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বাংলাদেশের আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এই উপমহাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা রেখে ইতহিাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের বেশিরভাগই ছিলেন পেশায় আইনজীবী। এমনকি ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে আইন পেশাজীবীদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে আইনজীবীগণ ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছেন।বাংলাদেশের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আইনজীবীরা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: গবেষক