সাইফুল ইসলাম পলাশ:
“মোর সাজা হইচে, মুই জেল খাটপা চাহাচু (আমার সাজা হয়েছে। আমি জেল খাটতে চাই)” – আচমকা এজলাসে এমন কথা শুনে আমার ভ্রু জোড়া এক হয়ে গেল। ময়লা লুঙ্গি পড়া আসামী দফিজ একটি কাপড়ের টোপলা নিয়ে আদালতে হাজির। তার শার্টের উপরের বোতাম ছেড়া। পায়ের স্যান্ডেলের ফিতা দু’টো দুই রঙের। অবাক বিস্ময়ে পেশকার আল আমিনের দিকে তাকালাম। পেশকার বললেন, আসামীর মাদক সেবনের মামলায় ৮ দিনের জেল হয়েছে। আজ স্যারেন্ডার করতে এসেছে।
ঘটনাটা সম্ভবত ২০১১ সালের। আমি তখন পঞ্চগড় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। আসামীর বিরুদ্ধে গাজা সেবন করে রাস্তায় মাতলামি করার অভিযোগ। তৎপ্রেক্ষিতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরিবারের লোক জানতে জানতে ৩ দিন হাজতেই কেটে যায়। কথা ছিল পরের তারিখে সে দোষ স্বীকার করবে। তাহলে ৫০ টাকা জরিমানা দিলেই মামলা শেষ।
পরের তারিখে তিনি আর আসেননি। তারপরের কয়েকটি তারিখে গরহাজির। ফলে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হয় ওবং তার অনুপস্থিতিতে বিচার সম্পন্ন হয়।
রায়ে লিখলাম,” আসামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সকল সাক্ষী পরস্পর পরস্পরকে সমর্থন করে এক ও অভিন্ন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আসামীপক্ষ জেরা না করায় সাক্ষীদের সাক্ষ্য সমূহ অক্ষত রয়েছে। আসামী পলাতক থাকায় তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তাই তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদান করা সমীচীন।”
এই কথা লিখে জরিমানার বিকল্প হিসেবে সর্বোচ্চ ০৮ দিনের সাজা দিলাম। প্রথম প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে এরকম সাজা দিয়ে আত্মতৃপ্তি কাজ করত। মনে হত, এরা আইন-কানুন মানে না। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হওয়া দরকার!
সেদিন যখন দণ্ডিত আসামী সাজা খাটার জন্য এসেছেন তখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার উকিল সাহেব কোথায়?
– স্যার, মোর উকিল নাই।
মামলার বিষয়ে জানলেন কিভাবে?
– এলাকার এক ভাই কহিল, মোর বলে ৮ দিনের সাজা হয় আছে। উমরা থানা তে ছেচা (সত্য) খবর লে আইচে (নিয়ে এসেছে)।
তারপর? এতদিন আসেননি কেন?
– স্যার, বাহিরত গেইছিনু হাজিরা খাটপা তানে। কাজ না করিলে খাম (খাব) কি তে? আগুত (আগেতো) পেট, তারপর কেইস!
আজকে কেন আসলেন?
– স্যার, কিছু মনে কইরেন না। নেশা কইছুনু। কোট সাজা দিছে। দেশের আইনতো মানবায় (মানতে) হবে। সাজাডা খাটে দু (দেই)।
তার এই কথার পর মূহুর্তেই নিজেকে শূণ্য মনে হল। শুধু পলাতক হওয়া মানেই আসামী আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ধারণাটা ভুল। এই অশিক্ষিত লোকটির মত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর কাউকেই জীবনে দেখিনি। বুঝলাম, নানা কারণে মানুষ পলাতক থাকতে পারে। একজন অপরাধীর শাস্তি হবে অপরাধের প্রকৃতি, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা, ভিকটিমের প্রতি হিংস্রতা, আসামীর পূর্ব অপরাধ, অপরাধের পূর্ব পরিকল্পনা, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায়। শুধু পলাতক থাকার কারণে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করা সমীচীন নয়।
যাচাই-বাছাই করে সাজা পরোয়ানামূলে তাকে কারাগারে পাঠালাম। পুলিশ হাতকড়া লাগিয়ে তাকে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে আসামী বললেন, ” স্যার.. ভালো রহেন”।
নিমিষেই নিরক্ষর আসামীর শিক্ষা, উপলব্ধি ও ব্যবহারের কাছে নিজের শিক্ষা ও উপলব্ধি তুচ্ছ মনে হলো। মনে হলো, নীল ডেমির উপরে রায়ের লেখাগুলো আমাকে উপহাস করছে। আর বলছে, “উচিত সাজা হয়েছে”।
পুনশ্চ, কয়েক দিন পর দফিজ এজলাসে হাজির। নাহ! পুলিশ তাকে নতুন করে ধরে আনেননি। ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ৩৪(৬) ধারায় সর্বোচ্চ সাজা খেটে আদালতকে সালাম দিতে এসেছেন।
এই মামলায় অস্বচ্ছল ময়লা দফিজের কত সহজ সরল স্বীকারোক্তি আর উপলব্ধি! এদেশের অধিকাংশ দফিজ, মফিজরা আইনের প্রতি এভাবেই শ্রদ্ধাশীল থাকে। কিন্তু এসি রুমে থাকা পি. কে হালদাররা দেশের হাজার কোটি টাকা লোপাট করে। আর আইন-আদালত থেকে পলাতক হয়ে কলকাতা, কানাডায় গিয়ে বসত গড়ে।
বি.দ্র. মামলার ঘটনা সত্য। আসামীদের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।
লেখক: সাইফুল ইসলাম পলাশ; যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ, কুড়িগ্রাম।