হোসেন মো. আনোয়ার: আমাদের সমাজে জমিজমা নিয়ে মামলা মোকদ্দমা খুব বেশিই হয়ে থাকে। প্রতিনিয়তই জমিজমা অর্থাৎ জমিজমার মালিকানার ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের মধ্যে অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে বিবাদ বিদ্যমান থাকে যা নিয়ে রক্তের বন্ধনে গড়া সম্পর্ক যেমন মারামারি ও খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে তেমনি এ নিয়ে অহরহ মামলা হয় এবং বছরের পর বছর ধরে আদালতের বারান্দায় তারা ঘুরে বেড়ান।
এক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন যিনি বোনাফাইড পার্চেজার (প্রকৃত/সরল বিশ্বাসে ক্রেতা) আছেন তিনি। অর্থাৎ তিনি টাকা দিয়ে জমির সাথে ঝামেলাও ক্রয় করেছেন। আজকে ওয়ারিশ সম্পত্তি বা কোন ওয়ারিশ থেকে তার পৈত্রিক সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার কি করা উচিত তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করবো। একজন ক্রেতা ওয়ারিশ সম্পত্তি বা সম্পত্তির মালিক এর প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পত্তি ক্রয়ের পূর্বে খুব ভালো ভাবে দেখে নেবেন-
প্রথমত, ওয়ারিশ সনদপত্র।
দ্বিতীয়ত, পারিবারিক বণ্টননামা রেজিষ্ট্রেশন দলিল।
তৃতীয়ত, নামজারি খতিয়ান।
এই তিনিটি ডকুমেন্টস (কাগজপত্র) যার নিকট থাকবেনা, সম্পত্তি তার দখলে থাকুক বা না থাকুক, পারিবারিক মৌখিক বণ্টননামা হোক বা না হোক আপনি সে সম্পত্তি ক্রয় করা মানেই হয়রানি ক্রয় করলেন। পাশাপাশি অন্যান্য আনুষঙ্গিক কিছু বিষয়ও দেখতে হবে, যেমন বিক্রেতা যে সূত্রে মালিক হয়েছেন তার পূর্বের মালিক বা মালিকগণ কোন সূত্রে মালিক ছিলেন বা হয়েছিলেন তার দলিল ও খতিয়ান যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে (চেইন অব ওনারশিপ)।
অনেকেই মৃত পিতা-মাতার নামের সম্পত্তি অন্যান্য ভাইবোন ও ওয়ারিশদের না জানিয়ে গোপনে বিক্রি করে দেন। এটি অত্যন্ত জঘন্য অপরাধ। কেউ কেউ আছেন যতটুকু অংশ পাবেন তার বেশিও বিক্রি করে ফেলেন এক্ষেত্রে ক্রেতাকে অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং তহশীল অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসে রক্ষিত বালামে ক্রেতার কতটুকু অংশ তার নামে নামজারীকৃত আছে তা যাচাই করে নিতে হবে।
কেউ কেউ আছেন সহ-অংশীদারের ভাল পজিশনের জমি সহ-অংশীদারদের না জানিয়েই বিক্রি করে দেন যা একটি সুস্পষ্ট প্রতারণা। ক্রেতাকে এক্ষেত্রে উল্লিখিত দলিলসমূহ ভ্যাটিং (পরীক্ষা/যাচাই-বাছাই) এর পাশাপাশি অন্যান্য ওয়ারিশদের অবগত করা উচিত এমনকি সম্ভব হলে বিক্রয় দলিলে অন্যান্য ওয়ারিশদের সাক্ষী করা উচিত।অন্যান্য ওয়ারিশদের কোন আপত্তি থাকলে উক্ত সম্পত্তি ক্রয় থেকে বিরত থাকাই অধিকতর ভালো।
কোন কোন ওয়ারিশ এমন আছেন যারা অন্যান্য ওয়ারিশদের অংশ ও নিজের মালিকানাধীন বলে বিক্রি করে দেন এক্ষেত্রেও ক্রেতাকেই সতর্ক থাকতে হবে এবং সম্পত্তি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল আইনগত প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। কেউ কেউ আছেন পারিবারিক সম্পত্তির মৌখিকভাবে ভাগের অংশ তাড়াহুড়ো করে অন্যান্য ওয়ারিশদের অবগত না করেই বিক্রি করে দেন এক্ষেত্রেও ক্রেতাকে একই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা আপনি বোনাফাইড পার্চেইজার এই ঢাল আপনাকে সবসময় প্রটেকটশন নাও দিতে পারে। উল্লিখিত প্রতিটি কাজ আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যা অহরহ আপনজনদের মধ্যে বিবাদ কলহ ও মনোমালিন্য তৈরি করে থাকে।
সম্পত্তির দলিল খুব গুরুত্বপূর্ণ, মনে রাখতে হবে সম্পত্তির মৌখিক ভাগ কোন দলিল নয় তাই মৌখিক বণ্টনের কোনো মূল্য নেই।যেমন মৌখিক কথার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, ধরুন একজন মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে (পারিবারিক) মৌখিক ভাগ করা জমি ভোগ-দখল করে আসছেন। জমিটার মূল্য অন্যান্য জমির চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় তারই এক ভাই জমিটির অংশ দাবি করলেন। এর ফলাফল বা সমাধান কি?
যে যাই বলুক বা মৌখিক ভাগ করুন না কেন পরবর্তীতে অপর ভাই-বোন বা ওয়ারিশ তা মানতে রাজি নাও হতে পারেন বা মানতে বাধ্যও নন। ভাই-বোন বা অন্যান্য ওয়ারিশ বলতেই পারেন যে মৌখিক ভাগ মানি না এবং এক্ষেত্রে উক্ত সম্পত্তি পুনরায় বণ্টন করতে বাধ্য করতেই পারেন।
এক্ষেত্রে ওয়ারিশগণ মৌখিক ভাগ না করে পারিবারিক বণ্টননামা রেজিষ্ট্রেশন দলিল করে নিলে এ দাবি কখনোই আইনসম্মত হতো না। তাই পারিবারিক সম্পত্তি বন্টন পরবর্তী বণ্টননামা রেজিষ্ট্রেশন দলিল সম্পাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওয়ারিশ সনদ, বণ্টননামা রেজিষ্ট্রেশন দলিল যার আছে তার সম্পত্তিতে কখনোই কোনো ওয়ারিশ বিবাদ সৃষ্টি করতে পারেনা কেননা ওয়ারিশ সনদপত্র দ্বারা প্রমাণ হয় যে সনদে উল্লেখিত প্রত্যেক ওয়ারিশ উক্ত সম্পত্তির মালিক।
এক্ষেত্রে ওয়ারিশ সনদ সঠিক কিনা অর্থাৎ প্রত্যেক ওয়ারিশের নাম সঠিকভাবে সনদে উল্লেখ আছে কিনা এবং বণ্টননামা দলিলে প্রত্যেক ওয়ারিশের স্বাক্ষর নাম-ঠিকানা সঠিকভাবে উল্লেখ করা আছে কিনা তা ভালোভাবে দেখতে হবে।
আরেকটি জঘন্য বিষয় আমাদের সমাজে চলমান আছে, আর তা হচ্ছে অনেকেই সম্পত্তিতে বোনের অংশ বোনকে না দিয়ে বিক্রি করে দেন। যিনি বিক্রি করেন তিনি যেমন আইনগত ও নৈতিকভাবে গর্হিত অপরাধ করলেন যিনি ক্রয় করেন তিনিও এতে পরবর্তীতে বিপদে পড়েন বা আইনগত বিবাদে অর্থাৎ আদালত পর্যন্ত বছরের পর বছর ঘুরতে হতে পারে।
আমি নিজে চট্টগ্রামের বোয়ালখালির একটি মামলায় অংশগ্রহণ করেছি, আপিল বিভাগ পর্যন্ত মুভ করা এ মামলায় বোনের সম্পদ ভাই কতৃক বিক্রির কোন কার্যকারিতা নেই মর্মে আদেশ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি জনাব আব্দুল ওয়াহাব মিয়া স্যার এবং দীর্ঘবছর পর পুনরায় বাটোয়ারা মোকদ্দমা করার ডিক্টাম (আদেশ) দিয়েছিলেন।
এক্ষেত্রে সম্পত্তির ক্রেতা সম্পত্তি বিক্রেতার কাছ থেকে জেনে নেওয়া উচিত বিক্রেতা কোন সূত্রে সম্পত্তির মালিক হন বা হয়েছেন এবং সেইসব ডকুমেন্ট পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ভ্যাটিং (পরীক্ষা) করে তবেই ক্রয় করা উচিত।
পৈতৃক সম্পত্তি হলে বা ওয়ারিশ সম্পত্তি হলে ক্রয়ের পূর্বে ওয়ারিশ সনদ, রেজিষ্ট্রেশন করা বণ্টননামা দলিল, নামজারি খতিয়ান ও বিক্রেতা বা বিক্রেতাদের নামে খাজনা রশিদ দেখে নেয়া অপরিহার্য। এগুলো না দেখে ক্রয় করলে অন্যান্য ওয়ারিশরা পরবর্তীতে বিবাদ সৃজন করার চেষ্টা করতেই পারেন। সুতরাং টাকা খরচ করে সম্পত্তি কিনুন ঝামেলা নয়।
লেখক: চিফ কো-অর্ডিনেটর, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (আইসিএলএইচআর) এবং আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।