২০০৭ সালের ঘটনা। লক্ষ্মীপুরের রামগতির আব্দুল ওদুদ খান সৌদি আরব যাওয়ার আগে ৫টি গরু ও ৮টি মহিষ তার শ্বশুর নূর মোহাম্মদের জিম্মায় রেখে যান। প্রায় ১১ বছর পর দেশে ফিরে সেগুলো ফেরত চাইলে শ্বশুর তা দিতে অস্বীকার করেন। আর এখানেই বাধে বিপত্তি।
এ নিয়ে শুরু হওয়া দ্বন্দ্ব নিরসনে গ্রামে কয়েক দফা সালিশ হয়। যৌক্তিক সমাধান না পাওয়ায় জামাই-শ্বশুরের কোন্দল গড়ায় বিচারিক আদালত থেকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ পর্যন্ত।
শেষমেশ অবশ্য গরীব অসহায় দরিদ্রদের সেবা দেওয়ার জন্য সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড বিষয়টির একটি সুন্দর সমাধান দিয়েছে। নিজেদের দ্বন্দ্ব ও মনোমালিন্য ভুলে শ্বশুর ও জামাই তাতে খুশি হয়ে ফিরেছেন বাড়ি।
সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কার্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা দীর্ঘ সালিশি বৈঠক শেষে বৃহস্পতিবার (২৩ জুন) বিষয়টি নিষ্পত্তি ও সমাধান হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে লক্ষ্মীপুরের রামগতির আব্দুল ওদুদ বিদেশ যান। সেখানে যাওয়ার আগে তার কেনা ৫টি গরু ও ৮টি মহিষ লালন-পালনের জন্য দিয়েছিলেন শ্বশুরকে।
লালন-পালনের সুবাদে গবাদি পশুগুলো সংখ্যায় বেড়েছে। ১৩টি গরু-মহিষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭-এ। এর মধ্যে ২০ টি মহিষ ও ৭টি গরু হয়েছে। অবশ্য তিনটি মহিষ পরবর্তীতে মারা যায়।
এক দশকেরও বেশি সময় পর বিদেশ থেকে দেশে ফেরেন ওদুদ। ফেরত চান তার গবাদি পশুগুলো। কিন্তু সেগুলো দিতে অস্বীকৃতি জানান শ্বশুর নূর মোহাম্মদ। এরপর শুরু হয় দ্বন্দ্ব।
এ নিয়ে গ্রামে কয়েক দফা সালিশ হয়, কিন্তু তাতে কোনো সমাধান হয়নি। একপর্যায়ে জামাই সেগুলো উদ্ধারের জন্য লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আদালতে পিটিশন মামলা করেন।
এডিএম কোর্ট জামাই-শ্বশুরের বিরোধের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেন রামগতি থানা পুলিশ। একই সঙ্গে গবাদিপশুগুলোও উদ্ধার করে জিম্মায় নেয় পুলিশ।
পুলিশ তদন্ত করে গরু-মহিষ জামাইয়ের বলে সত্যতা পেলে জামাইকে তা বুঝিয়ে দিতে শ্বশুরের প্রতি নির্দেশ দেন আদালত। তবে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গরু ও মহিষ নিজের দাবি করে আবেদন করেন নূর মোহাম্মদ। এরপর এডিএম কোর্টের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে শ্বশুর লক্ষ্মীপুর দায়রা আদালতে যান।
পরবর্তীকালে দায়রা আদালত স্থানীয় একজন অধ্যক্ষের মাধ্যমে এ বিষয়ে আরেকটি তদন্তের নির্দেশ দেন। সে তদন্তেও ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর গরু-মহিষ জামাইয়ের বলে সত্যতা মেলে। লক্ষ্মীপুরের দায়রা জজ মো. রহিবুল ইসলাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দেওয়া ওই আদেশ বহাল রাখেন।
তবে শশুর এখানেই থেমে থাকেননি। দায়রা আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আসেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেন তিনি।
মামলার বিষয়বস্তু শোনার পর হাইকোর্টের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সালিশের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য উভয় পক্ষকে নির্দেশ দেন।
দায়িত্ব দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসকে। ওই নির্দেশের পর বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা থেকে বিবাদমান দুই পক্ষ ও তাদের আইনজীবীদের নিয়ে সালিশে বসে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা অতিরিক্ত জেলা জজ ফারাহ মামুন ও সমন্বয়কারী রিপন পৌল স্কু।
বৈঠকে দুই পক্ষই তাদের মতামত তুলে ধরেন। গরু-মহিষ নিয়ে জামাই শ্বশুরের বিরোধের বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসে কয়েক ঘণ্টা দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়। ওই সালিশি বৈঠকের পরই বিরোধ নিষ্পত্তি হয় জামাই-শ্বশুরের।
দীর্ঘ আলোচনার পর উভয়পক্ষের সম্মতিতে সালিশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১৭টি মহিষের মধ্যে ৫টি বড় ও ৪টি ছোট মহিষ পাবেন ওদুদ। আর ৬টি বড় ও ২টি ছোট মহিষ নেবেন শ্বশুর।
সবশেষে জামাই-শ্বশুর উভয়ই লিগ্যাল এইড অফিসে হওয়া সিদ্ধান্ত মেনে হাসি-খুশি হয়ে বাড়ি ফেরেন। এখন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চকে বিরোধ নিষ্পত্তির এ সিদ্ধান্ত অবহিত করা হবে। ব্যতিক্রমধর্মী এ মামলা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার খোরাক যোগায়।