দীপজয় বড়ুয়া : মামলার পক্ষগণ তাদের নিজ বক্তব্যের সমর্থনে সাক্ষী উপস্থাপন করেন। স্বাভাবিকভাবেই যে পক্ষ কোন সাক্ষীকে উপস্থাপন করেন সেই পক্ষকে সমর্থন করে সাক্ষ্য প্রদান করে থাকেন। কিন্তু কোন সময় দেখা যায় যে, সেই সাক্ষী তার আহবানকারী পক্ষকে সমর্থন না করে তার বিরুদ্ধের পক্ষকে সমর্থন করছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আহবানকারী পক্ষ সেই সাক্ষীকে বৈরী (Hostile Witness) বলে ঘোষণা করতে পারেন এবং অনুমতি চাইতে পারেন।
[12 DLR 578] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সাক্ষী আহবানকারী পক্ষের বিপক্ষে গেলেই তাকে বৈরী বলা যাবে না, কেবলমাত্র যে সাক্ষী আদালতে সত্য প্রকাশ করছে না, এরূপ সাক্ষীকেই বৈরী সাক্ষী ঘোষণা করা যায়।”
[6 BCR 1986 (AD) 212 Mahiruddin Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ঘটনার একমাত্র সাক্ষী যিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি জবানবন্দীকালীন সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য রাখার তাকে বৈরী ঘোষণা জেরা করা হয় যে, তিনি অপরাধী পক্ষ কর্তৃক লাভবান হয়ে মিথ্যা বলছেন, এ উক্তি স্বীকার করেন তথাপি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুসারে প্রদত্ত বিবৃতি বিবেচনাযোগ্য।”
কোন পক্ষ কি তার নিজ সাক্ষীকে জেরা করতে পারে এবং এক্ষেত্রে কি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৪ ধারায় নিজ সাক্ষীকে জেরা করা সংক্রান্ত বিধান করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, মামলার পক্ষগণ সাধারণত তাদের বক্তব্যের সমর্থনে সাক্ষী হাজীর করেন কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় যে পক্ষ সাক্ষী হাজীর করেন উক্ত সাক্ষী সেই পক্ষের সমর্থন না করে বিপক্ষকে সমর্থন করেন। এটি হলো বৈরী সাক্ষী। এই ধরনের সাক্ষীকে আদালতের অনুমতি নিয়ে জেরা করা যায়।
পক্ষগণ ইচ্ছা করলেই নিজ সাক্ষীকে জেরা করতে করতে পারেন না, আদালতের অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি প্রদান আদালতের স্বেচ্ছাধীন ব্যাপার। আদালত যদি মনে করেন যে, আহবানকারী পক্ষের প্রতি সাক্ষীর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে বা তার আচরণ বিরুদ্ধাভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে কিংবা কথাবার্তা শত্রুতামূলক তাহলে সেই সাক্ষীকে জেরা করার জন্য আহবানকারী পক্ষকে অনুমতি দিতে পারেন।
সাধারণত বিপক্ষের সাক্ষীকে যে ধরনের প্রশ্ন করা যায়, বৈরী সাক্ষীকেও সেই ধরনের প্রশ্ন করা যায়। কোন প্রলোভন বা বিবেক তাড়িত হয়ে সত্যের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণে বা অন্য কোন কারণে সাক্ষী অনেক সময় নিজের পক্ষকে সমর্থন না করে অন্য পক্ষের সমর্থনে বিবৃতি প্রদান করেন।
সাধারণত পূর্ব থেকে এই ধরনের সাক্ষীকে বোঝা যায় না। কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর পর ২/৩ টি প্রশ্ন করলেই বৈরী সাক্ষীকে চেনা যায়। অর্থাৎ তাকে প্রশ্ন করা হলে সে নিজের পক্ষে উত্তর না দিয়ে অন্য পক্ষের সমর্থনে উত্তর দিতে থাকে। এ পর্যায়ে নিজের সাক্ষীকে বৈরী সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করতে হয় এবং আদালতের অনুমতি নিয়ে তাকে জেরা করা যায়।
আদালতের রায়
[28 DLR 192 Faruk Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ফরিয়াদী পক্ষ নিজ সাক্ষীকে বৈরী ঘোষণাক্রমে জেরা করতে পারে এবং সেই কারণে উক্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য অসত্য বা মূল্যহীন বলে আদালত গণ্য করতে পারেন না। আদালতকে সাক্ষ্যের গুরুত্ব বিবেচনা করতে হয়।”
[6 BCR(AD) 212 Mahiuddin Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “ঘটনার একমাত্র সাক্ষী যিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি জবানবন্দীকালীন সম্পূর্ণ বিপরীত বক্তব্য রাখায় তাকে বৈরী ঘোষণা করে জেরা করা হয় যে, তিনি আসামীপক্ষ কর্তৃক লাভবান হয়ে মিথ্যা বলছেন, এই উক্তি স্বীকার করেন তথাপি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা অনুসারে প্রদত্ত বিবৃতি বিবেচনাযোগ্য।”
[13 DLR 389 Doud Ali Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সাক্ষী আহবানকারী তার নিজের সাক্ষীকে আদালতের অনুমতি নিয়ে জেরা করতে পারে। সত্য উদঘাটনের জন্য আদালত সুবিবেচনা প্রসূত মতামত দিয়েই বৈরী ঘোষণা বা ঘোষণা ছাড়াই জেরা করার অনুমতি দিতে পারেন এবং উক্ত সাক্ষীকে ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নসহ পূর্ববর্তী বিবৃতির সাথে বর্তমান সাক্ষ্যের অসঙ্গতি দেখানোর জন্য প্রতিপক্ষ যেভাবে প্রশ্ন করতে পারতেন সেভাবে প্রশ্ন করা যেতে পারে।”
নিজের সাক্ষীকে জেরা করার সময় কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়
কোন মামলায় বাদী পক্ষ যদি নিজের পক্ষের সাক্ষীর জবানবন্দী নেয়, তাহলে বিবাদী পক্ষ উক্ত সাক্ষীকে জেরা করার অধিকার লাভ করে। যদি বিবাদী পক্ষ বাদী পক্ষের সাক্ষীকে জের না করে তাহলে আদালত ধরে নিবেন যে, বিবাদী পক্ষ বাদী পক্ষের জবানবন্দী মেনে নিয়েছেন। বাদীর জবানবন্দী নেয়া হয় সাধারণত মামলার প্রাসঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে।
তবে তাকে জেরা করার সময় উক্ত বিষয়ের বাইরেও জেরা করা হয়। এক্ষেত্রে আইনগত বাধা নেই। সুতরাং বলা যায় একজন সাক্ষীকে তার জেরাতে বিবৃত ঘটনার বাইরেও প্রশ্ন করা যায়। তঁবে সাক্ষীকে অপমানজনক প্রশ্ন করা যাবে না। এছাড়া নিম্নোক্তভাবে সাক্ষীকে জেরা করা যায় বা প্রশ্ন করা যায়:
সাক্ষ্য আইনের ১৪৩ ধারা অনুযায়ী- জেরার সময় সাক্ষীকে ইংগিতবাহী প্রশ্ন করা যায়। তবে একাধিক ইংগিতবাহী প্রশ্ন একত্র করে একটি প্রশ্ন আকারে করা যাবে না।
সাক্ষ্য আইনের ১৪৬ ধারা অনুযায়ী- জবানবন্দীর সময় সাক্ষী যে সাক্ষ্য দিয়াছেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায় আবার উক্ত সাক্ষীর সমাজিক মর্যাদা জানার জন্য বা তার বক্তব্যের সত্যতা পরীক্ষার জন্য অন্য প্রশ্ন করা যায়।
সাক্ষ্য আইনের ১৫১ ধারা অনুযায়ী- অপমানজনক বা কুৎসামূলক বা বিরক্তিকর প্রশ্ন করা যাবে না।
বৈরী সাক্ষীর সাক্ষ্যের মূল্যায়ন
অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী নিজ পক্ষ ত্যাগ করে অন্য পক্ষের সমর্থনে সাক্ষ্য প্রদান করে, একে বৈরী সাক্ষী বলে। যদিও আদালতে এই সাক্ষীর গুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে তবুও বৈরী সাক্ষীকে ছোট করে দেখা যায় না। কয়েকটি মামলার নজীর পর্যালোচনা করলে বৈরী সাক্ষীর মূল্যায়ন করা যাবে।
[2 DLR 114 Suruj Miah Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “কোন সাক্ষীকে বৈরী সাক্ষী হিসেবে ঘোষণা করে জেরা করলেই তার বক্তব্য অগ্রাহ্য হবে সাক্ষ্য আইনে এমন কোন নিয়ম নেই। আবার বৈরী সাক্ষীর সম্পূর্ণ সাক্ষ্য বা অংশবিশেষ গ্রহণ করার রীতিও এই আইনে নেই। এক্ষেত্রে আদালতকে বৈরী সাক্ষীর সাক্ষ্যকে পরীক্ষা করে দেখতে হয়।”
[11 DLR 316 Fazlul Haque Vs.The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “এরূপ সাক্ষীর সম্পূর্ণ বা আংশিক সাক্ষ্য বাদ উচিত হবে না বরং উভয় পক্ষের পক্ষে বা বিপক্ষে প্রদত্ত সম্পূর্ণ সাক্ষ্য অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষ্যের মতই মূল্যায়ন করতে হবে।”
[21 DLR 844 Yakub Ali Vs. The State] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, “সাক্ষী শত্রু ঘোষিত হলেই তার প্রদত্ত সাক্ষ্য মিথ্যা হয়ে যায় না।”
তাই বলা যায়- বৈরী সাক্ষীর সাক্ষ্য বিবেচনা করে আদালত যদি তা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন তাহলে গ্রহণ করতে পারেন। আর বিশ্বাসযোগ্য মনে না হলে তা গ্রহণ নাও করতে পারেন। অনুমতি প্রদান আদালতের স্বেচ্ছাধীন ব্যাপার।
আদালত যদি মনে করেন যে, আহবানকারী পক্ষের প্রতি সাক্ষীর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটেছে বা তার আচরণ বিরুদ্ধাভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে কিংবা কথাবার্তা শত্রুতামূলক তাহলে সেই সাক্ষীকে জেরা করার জন্য আহবানকারী পক্ষকে অনুমতি দিতে পারেন।
লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা
সাক্ষ্য আইন- বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া ও বাসুদেব গাংগুলী; সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য- গাজী শামছুর রহমান; আইন শব্দসমূহ- এডভোকেট নাসির উদ্দিন; উইকিপিডিয়া।