শরীফ আবদুল্লাহ: ‘ইন্ডিয়ানা প্রদেশ বনাম জজ জোসেফ পালমার’ মামলাটি দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ব্যতিক্রম ৩০০(১) অথবা ৩০২ কিংবা ৩০৪(খ) বা ২৭৯ ধারার যেকোনো একটি প্রয়োগসাধ্য হতে পারতো। ‘দ্য জাজ (The Judge)’ সিনেমাটিতে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়নি জজ জোসেফ পালমারকে কোন ধারায় সাজা দেয়া হয়েছে। তবে যেহেতু জজ জোসেফ পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছিল যে হয়তো সে ব্লাকওয়েলকে হত্যা করেছে তাই দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার মামলা এটি। তবে পুরো সিনেমাটিতে জজ জোসেফ মনে করতে পারেনি আদৌ সে ব্লাকওয়েলকে হত্যা করেছে কিনা?
মূলত ব্লাকওয়েল একজন আসামী ছিলো যাকে হপ স্টিভেনস মেয়েটিকে খুন করার জন্য জজ জোসেফ পালমার ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলো। হপ স্টিভেনস ছিলো ষোল বছরের একটি মেয়ে এবং ব্লাকওয়েলের পছন্দের। তবে ব্লাকওয়েল ছিলো বয়স্ক একটি লোক। সে একদিন ৩৮ ক্যালিবার বন্দুক নিয়ে হপ মেয়েটির জানালায় গুলি করে কারণ হপ অন্য একটি ছেলেকে পছন্দ করেছিল বলে। যার ফলে জজ জোসেফ তাকে প্রথমবার মাত্র ৩০ দিনের শাস্তি দিয়েছিল। কারণ ব্লাকওয়েল ক্ষমা চেয়েছিলো এবং তিনি মদ্যপ হয়ে হপের জানালায় গুলি করেছিল এবং আর করবে না বলে ওয়াদা করে। জজ জোসেফ পালমার আসামী ব্লাকওয়েলকে বিশ্বাস করে ৩০ দিনের সর্বনিম্ন শাস্তি দেয়।
তবে ব্লাকওয়েল জেল থেকে বের হয়েই হপ স্টিভেনসকে একটি ডোবায় ফেলে দুই পা দিয়ে তার বুকের উপর চেপে ধরে মেরে ফেলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জজ জোসেফ পুনরায় ব্লাকওয়েলকে শাস্তি দেয় যার মেয়াদকাল ২০ বছর ছিল। আর ২০ বছর সাজা খেটে যখন ব্লাকওয়েল জেল থেকে বেরিয়ে আসে তার কয়েকদিনের মাথায় জজ জোসেফ পালমার খুনী ব্লাকওয়েলকে হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং সে তার বিচারিক ক্ষমতা হারিয়ে আসামীর স্থানে চলে আসে।
বিচারকদের আসামী হিসেবে আদালতের মুখোমুখি হওয়া এই সিনেমাতেই প্রথম নয়। প্রায় সময়ই নিউজে আমরা শুনতে পাই প্রফেশনাল মিসকন্ডাক। অর্থাৎ ন্যায় বিচারকগণ মাঝেমধ্যেই আইনের প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে মনগড়া শাস্তি দিয়ে থাকে। এমন আলোচিত ঘটনার মধ্যে একটি ‘Marquita Johnson Vs Judge Les Hayes’ মামলাটি শুধুমাত্র ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করার জন্য জনসনকে ৪৯৬ দিন জেলে থাকতে হয়েছিল। তবে খুন কিংবা জালিয়াতি অপরাধে বিচারকেরা আদালতের সম্মুখীন হয়েছে এমন ঘটনা সংখ্যালঘু।
কিন্তু কানাডার আদালতে ‘State Vs Judge Jacques Delisle Case 2011’ একটি উল্লেখযোগ্য মামলা যেখানে জ্যাকিস ডিলাইসেল (Jacques Delisle) তার স্ত্রীকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়। জজ জ্যাকিস ক্যানাডার ইতিহাসে প্রথম বিচারক যিনি হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাকে ১৪ই জুন ২০১২ সালে স্ত্রী হত্যা মামলায় সাজা দেয়া হয়।
পরবর্তীতে সে আপীল করলে দেখা যায় জজ ডিলাইসেল সম্পূর্ণভাবে ট্রায়েলের সম্মুখীন হননি। মূলত তার স্ত্রী পিস্তল দিয়ে আত্মহত্যা করেছে যদিও জজ ডিলাইসেল পিস্তলটি তার স্ত্রীর আশেপাশে রেখে তাকে আত্মহত্যা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। মামলাটি ৭ই এপ্রিল ২০২১ তারিখে ফেডারেল জাস্টিস মিনিস্টার ডেভিড লামেটি নতুন করে মামলাটির ট্রায়েল/বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন এবং পূর্বের সকল সাজা স্থগিত করে দেন।
বাংলাদেশে এইতো সেদিন যশোর কোর্টে নীলফামারীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানাকে আসামী করে তার স্ত্রী ফারজানা যৌতুকের মামলা করে। কিন্তু বিষয়টি বিচারাধীন ফলে ওই বিচারক সত্যিই দোষী কিনা এখনই বলার অবকাশ নেই। তবে এমন ঘটনা হয়তো আরও পাওয়া যাবে আরেকটু ঠিকঠাক মতো স্টাডি (গবেষণা) করলে।
তবে ‘The Judge’ সিনেমাটিতে ‘ইন্ডিয়ানা প্রদেশ বনাম জোসেফ পালমার’ মামলায় জজ সাহেব কোন ধারায় অভিযুক্ত হয়ে শাস্তি পেয়েছেন সেটা স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরা হয়নি। যদি সে বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালিয়ে ব্লাকওয়েলকে মেরে ফেলে তবে ৩০৪(খ) ধারাটি প্রয়োগযোগ্য হবে, কিন্তু তিনি যদি ব্লাকওয়েলকে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে শুধু আঘাত করতো তবে ২৭৯ ধারাটি যুক্ত হতো। যেহেতু ব্লাকওয়েল মারা গেছেন তাই ২৭৯ ধারাটি আসবে না।
তবে আগেই বলেছি, জজ জোসেফ স্বীকার করেছেন তিনি হয়তো ব্লাকওয়েলকে হত্যা করেছেন তাই ৩০২ ধারাটিই প্রয়োগযোগ্য হয়েছে। কিন্তু যদি ডিফেনডেন্ট ল’ইয়ার (বিবাদী পক্ষের আইনজীবী) প্রমাণ করতে পারে জজ জোসেফ উত্তেজনা বসত ব্লাকওয়েলকে খুন করেছে তবে ৩০০ ধারার ব্যতিক্রম ১ এর মধ্যে হত্যাটি চলে যাবে। যেখানে বলা হয়েছে, উত্তেজিত হয়ে কাউকে হত্যা করে ফেললে সেটি সাধারণ ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়বে।
‘দ্য জাজ (The Judge)’ সিনেমাটিতে আসামী জজ জোসেফের পক্ষে ডিফেনডেন্ট ল’ইয়ার হিসেবে ট্রায়াল করেন তার ২য় পুত্র হেঙ্ক। হেঙ্ক হচ্ছেন শিকাগো শহরের একজন চৌকস আইনজীবী। যিনি তার মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে গ্রামের বাড়ি ফিরে আসেন বহুদিন পর। এডভোকেট হেঙ্কের বাবা জজ জোসেফ মদ্যপ অবস্থায় একটি গাড়ি এক্সিডেন্ট করার শাস্তি হিসেবে তাকে ভেন্ডারবাগ কিশোর জেলে পাঠায় ১৭ বছর বয়সে। যেটা হেঙ্ককে প্রচণ্ড পিড়া দেয় এবং সে ল’ পড়ে প্র্যাকটিস শুরু করে শিকাগো শহরে। মা মারা যাওয়ার সংবাদ শুনে সে গ্রামে আসে এবং তার বাবার মামলায় যুক্ত হয়। সে জানতে পারে তার বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত ও কেমো নিচ্ছে। অথচ পরিবারের অন্য দুই ভাই এ বিষয়ে কিছু জানে না।
এদিকে মামলাটি জটিল হতে থাকে যখন জজ জোসেফের গাড়িতে ব্লাকওয়েলের DNA (Deoxyribonucleic Acid) পুলিশ ফাইন্ড আউট করে। এছাড়াও পুলিশ একজন Eye Witness খুঁজে পায় যে দেখেছে জজ জোসেফকে গাড়ি চালিয়ে যেতে। সাধারণত বাংলাদেশে ‘ডিওক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) বিল ২০১৪’ পাস হলেও এখনো এটি আইন হয়ে উঠেনি। কচ্ছপ গতিতে হাটছে। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ফরেনসিক ডিএনএ প্রফাইলিং ল্যাবরেটরি আছে। যেটি তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ডে ও রানা প্লাজা ধ্বসে অজ্ঞাতনামা লাশ গুলোর পরিচয় নির্ণয় করতে হেল্ফ করেছে। এছাড়াও সিআইডি ডিএনএ টেস্টের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
অন্যদিকে সাক্ষ্য আইনের ১১৮ ধারা মতে Eye Witness অর্থাৎ চাক্ষুষ সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে পারে। আর যে ঘটনা চোখে দেখে না অন্যের কাছ থেকে কানে শুনে তাকে Hearsay Witness বলে। মূলত ‘দ্য জাজ’ সিনেমাটিতে যে বিষয়টি বেশি পরিলক্ষিত সেটা হচ্ছে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২ এর ১৩৭ ধারা। অর্থাৎ জবানবন্দি, জেরা ও পুনঃজবানবন্দী। সিনেমেটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পর্কে একটি বিস্তর ধারণা দিয়েছে। যেমন, সাক্ষ্য আইনের ১৪০ ধারা অর্থাৎ চরিত্র সম্পর্কিত সাক্ষীকে জেরা করা ও তার পুনঃজবানবন্দি নেয়া যেতে পারে। যেটা স্পষ্ট দেখা গেছে যখন প্রসিকিউশন এডভোকেট ডোয়াইট ডিকহাম জজ জোসেফকে তার চরিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেরা করে এবং ডিফেনডেন্ট হেঙ্ক পরবর্তীতে জজ জোসেফের আবার পুনঃজবানবন্দি গ্রহণ করে।
এছাড়াও প্রসিকিউশন সিনেমাটিতে ১৪৬ ধারার প্রয়োগ যথাযথ ভাবে করেছে। যার ফলে আসামী জোসেফের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা তৈরি হয় এবং যার ফলে সে ব্লাকওয়েলকে খুন করেছে কিনা তা মনে না পড়া স্বত্ত্বেও পরোক্ষভাবে দোষ স্বীকার করে নেয়।
ডিফেনডেন্ট হেঙ্ক এটা প্রমাণ করতে চায় আসামী ক্যান্সারে আক্রান্ত বিধায় তাকে নিয়মিত কেমো নিতে হয় যার ফলে সে ‘কেমো ব্রেইন’ রোগে আক্রান্ত, তাই আসামী খুব তাড়াতাড়ি উত্তেজিত হয়ে এবং স্মৃতিশক্তি ভুলে যায়। যদি সে ব্লাকওয়েলকে হত্যা করেও থাকে সেটা সে উত্তেজনা বসত করেছে এবং ভুলে গিয়েছে।
তবে উক্ত সিনেমায় সিসি ক্যামেরা ফুটেজ মামলাটির নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাইরের দেশগুলোতে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ কিংবা ছবি এভিডিয়েন্স হিসেবে ব্যবহারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে বহু আগেই। কিন্তু আমাদের দেশে ভিডিও ফুটেজ এভিডিয়েন্স হিসেবে স্পষ্ট লিখিত না থাকলেও দেশের অনেক মামলার নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যেমন- রিফাত হত্যা মামলা, বিশ্বাজিৎ হত্যা কিংবা নুসরাত হত্যা, অথবা খাদিজা হত্যাকাণ্ডে। সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলাতেও ভিডিও ফুটেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষ আইন ছাড়া ভিডিও ফুটেজ যে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোথাও বলা নেই তবে, সাক্ষ্য আইনের ৩ ধারায় ডকুমেন্টস এর সংজ্ঞা পড়লে কিংবা দণ্ডবিধির ২৯ ধারা অথবা জেনারেল ক্লজেস এক্ট্যের ৩(১৬) পড়লে ভিডিও ফুটেজ যে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় সেটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ১৬৫ ও ১৬১ ধারা পড়লে আরো স্পষ্ট হয়। যেখানে ১৬৫ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার আলামত হিসেবে যে কোনো কিছু জব্দ করতে পারবে। এছাড়া ‘Judicial Interpretation’ সাক্ষ্য আইনে অন্যতম ভূমিকা রাখছে।
অবশেষে ‘দ্যা জাজ (The Judge)’ পুরো সিনেমাটি দেখে একজন জাদরেল উকিল ও একজন দৃঢ় মনোবল সম্পূর্ণ বিচারককে আমি খুঁজে পেয়েছি। তবে ব্লাকওয়েল যদি অনারেবল জাজ জোসেফ পালমারকে না বলত যে, ‘আমার খুন করা ষোল বছরের প্রেমিকা হপ এবং তোমার সদ্য মারা যাওয়া ভালোবাসার স্ত্রী’র কবরের দূরত্ব খুব একটা দূরে নয়। আমি চাইলেই ঐ দুইজনের কবরের উপর প্রসাব করতে পারবো’ তাহলে হয়তো সিনেমাটিতে আরো একজন খুনি আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারত।
লেখক: আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।