পুলিশের ভুলে আসামি না হয়েও নির্দোষ ব্যক্তির কারাভোগের ঘটনায় ৯ জন ভুক্তভোগীকে আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
এর মধ্যে যশোরের সজলপুরেট জামতলা এলাকায় দুজনের একই নাম হওয়ায় একটি মামলায় বেআইনিভাবে গ্রেফতার ও কারাগারে রাখার ঘটনায় একজনকে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় আরও আটজনকে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আটজন ব্যক্তির নামের ভুলে অবৈধ কারাবাসের অভিযোগের শুনানি হয়। শুনানিতে কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জবাব ও প্রতিবেদনে সন্তুষ্ট হতে পারেনি।
কমিশনের সুপারিশ নিম্নরূপ
(১) নামের ভুলে মিজানুর রহমান ওরফে তোতলা মিজানের গ্রেফতার এবং পরবর্তীতে মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তার বা ক্ষতিপূরণ দিবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
(২) বাকি ৮ জনের (কারোর কারাবাস ২ সপ্তাহ, কারোর ৩ মাস) প্রত্যেককে ৫০ হাজার তাকে করে আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছে কমিশন।
(৩) এই সুপারিশ কার্যকর করে কমিশন কমপ্লায়েন্স দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
(৪) কোনো অপরাধীর বা ব্যক্তির নামের আগে কোনো ধরণের অমর্যাদাকর পদবি (যেমন কান কাটা, তোতলা মিজান, চাক্কু মামুন ইত্যাদি) নাম পুলিশ যাতে ব্যবহার না করে তার জন্য কমিশন নির্দেশনাও দিয়েছে।
(৫) কোনো ব্যাক্তি বা অপরাধীকে গ্রেফতার করার পূর্বে পালিশ যেন অবশ্যই এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্রের সাথে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নাম পরিচয় মিলিয়ে নেয় সে বিষয়েও কমিশন নির্দেশনা দিয়েছে।
(৬) আর্থিক সহায়তা দেয়ার সাথে সাথে যেসব পুলিশ কর্মকর্তার গাফিলতিতে এইরূপ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বাবস্থাগ্রহণসহ তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমাদানের সুপারিশ করা হয়েছে।
পেছনের কথা
এর আগে ‘নামে নামে যমে টানে’ শিরোনামে একটি পত্রিকাইয় প্রকাশিত খবর সংযুক্ত করে দশজন নিরাপরাধ এবং নিরীহ ব্যক্তির অবৈধ কারাভোগের জন্য ক্ষতিপূরণসহ প্রতিকার চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন সিসিবি ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেন।
২০২১ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি করা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিবকে এ বিষয়ে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বলেন মানবাধিকার কমিশন। দীর্ঘদিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৪৪ পাতার প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে প্রকৃত অপরাধীর নামের সাথে নিরীহ ব্যক্তির নামের মিল থাকার কারণে ৮ জনের অবৈধ কারাবাস প্রমাণিত হয়।
পরবর্তীতে পুলিশের ভুলে আসামি না হয়েও নির্দোষ ব্যক্তির কারাভোগের বিষয়ে তদন্ত পূর্বক সর্বশেষ কমিশনে দাখিল করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের যে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও তাদের পরিবারকে কেন কমিশনের আইনের ধারা ১৯(২)তে যথাযথ সাময়িক সাহায্য মঞ্জুর করা হবে না তার ব্যাখ্যার জন্য জননিরাপত্তা সংক্রান্ত উপযুক্ত প্রতিনিধিকে আইনজীবীর মাধ্যমে মানবাধিকার কমিশন ডাকেন।
ওই প্রতিবেদনটি গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর মানবাধিকার কমিশনের শুনানির জন্য উপস্থাপন করা হয়। নির্ধারিত দিনে এ বিষয়ে শুনানি হয়নি। পরে চলতি বছরের গত ১০ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ও সিসিবি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ব্যারিস্টার আব্দুল হালিমের উপস্থিতিতে শুনানির কথা থাকলেও সেদিনও শুনানি হয়নি।
এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি শুনানির দিন ঠিক করেন। তারই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে শুনানির শেষ করা হয়েছে মানবাধিকার কমিশনে। শুনানি শেষে ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ ৬ দফা সুপারিশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
এ বিষয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম বলেন, দীর্ঘদিন পর সিসিবি ফাউন্ডেশনের অভিযোগ শুনানি হলো। এতে বলা হয়েছে, নামের ভুলে মিজানুর রহমান ওরফে তোতলা মিজানের গ্রেফতার এবং পরবর্তীতে মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তার বা ক্ষতিপূরণ দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাকি আটজনের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করেছে কমিশন।
তিনি আরো বলেন, যে নামমাত্র ক্ষতিপূরণের সুপারিশ করা হয়েছে তা সিম্বলিক এবং এই সুপারিশ করা হয়েছে যাতে পুলিশ ভবিষ্যতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী এ ধরণের কাজ করতে সাহস না পায়।