সাব্বির এ মুকীম : বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একটি মাস্টারপিস রায় ৬৯ ডিএল আর এর ২৬৮ পৃষ্ঠা হতে ছাপা আছে। বিচারপতি সরকার তাঁর অনবদ্য জুডিসিয়াল ক্রাফ্ট্যসম্যানশীপ এর আরও ১টি নজীর আমাদের সামনে এই রায়ে রেখেছেন। বেশ অকিঞ্চিৎকর, আইনের এলিট মঞ্চে প্রায় ব্রাত্য বিষয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা এই রায়ের বিষয়বস্তু। সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত যে, ১৪৫ ধারার নালিশগুলো অতিরিক্ত জেলা হাকিম বা এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এর আদালতে দায়ের হয়।
আলোচ্য মামলায় এডিএম কোর্ট কে প্রদত্ত গাইডলাইন
এডিএম কোর্টে ১৪৫ ধারার মামলার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের অসংখ্য রায়ে বারেবারে প্রচার হয়ে একটি আইনগত উপপাদ্য তৈরী আছে যে- সিভিল কোর্টে মামলা থাকলে এডিএম কোর্টে মামলা চলে না। তবে বক্ষ্যমাণ রায়ের ২৩ তম অনুচ্ছেদে ১৪৫ ধারার মামলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা হাকিম এর জন্য যে গাইডলাইন প্রদান করা হয়েছে, তাতে লেখা আছে-
(১) সিভিল মামলা চলমান থাকলেও সে মামলায় নালিশী ভূমির দখল সংক্রান্ত কোনো আদেশ না হলে, সে মামলার যে কোনো পক্ষ সিভিল মামলা চলমান অবস্থাতে ই নালিশী ভূমি নিয়ে ১৪৫ ধারায় বিজ্ঞ জেলা হাকিমের কাছে দরখাস্ত করতে পারবে।
(২) ১৪৫ ধারায় দরখাস্ত পাওয়ার পর বিজ্ঞ হাকিম তদন্তের মাধ্যমে অবশ্যই জানার চেষ্টা করবেন, নালিশী ভূমি নিয়ে কোনো সিভিল মামলা চলমান আছে কি না।
(৩) তদন্ত প্রতিবেদন বা অন্যকোনো ভাবে বিজ্ঞ হাকিম যদি অবগত হন যে নালিশী ভূমি নিয়ে সিভিল মামলা চলমান, তবে তিনি ১৪৫ ধারায় আবেদনকারী পক্ষ কে সিভিল কোর্ট থেকে ইনঞ্জাংশন এর আদেশ আনতে নির্দেশ দিবেন।
(৪) তবে যদি অতিরিক্ত জেলা হাকিমের কাছে মনে হয় যে বিদ্যমান অবস্থা এতোই ঝুঁকিপূর্ণ মানে ( ১৪৫ ধারার মামলার নিয়মিত ভাষায়) শান্তিভঙ্গের আশংকা খুবই প্রবল, তবে বিজ্ঞ হাকিম ১৪৫ ধারায় আওতায় যে কোনো আদেশ দিতে পারবেন।
এই গাইডলাইন থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, এডিএম কোর্টে যেকোনো অবস্থাতেই ১৪৫ ধারার মামলা করা যাবে এবং ১৪৫ ধারার মামলায় তদন্ত আদেশে পুলিশের প্রতি নির্দেশে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে যে, সিভিল কোর্টে নালিশী ভূমি নিয়ে মামলার খোঁজ লাগাতে হবে। আর সিভিল কোর্টে মামলা চলমান থাকলেই এডিএম কোর্ট ১৪৫ ধারায় কাজ করতে পারবেন না, এমন নয়, তবে এডিএম কোর্টের প্রথম দায়িত্ব হলো সিভিল কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞার আদেশ আনার জন্য দরখাস্তকারীকে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়া।
মূল মামলার ঘটনা
সংশ্লিষ্ট সবাই জানে, ১৪৫ ধারার নালিশগুলোতে ফরিয়াদী ১ম পক্ষ হিসেবে এবং অভিযুক্ত ২য় পক্ষ হিসেবে অবিহিত হয়। আলোচ্য রায়ের ঘটনা হলো:-
১ম পক্ষের দাবী পৈত্রিক ওয়ারিশ সূত্রে পেয়ে দোকান দিয়ে নালিশী ভূমিতে ১ম পক্ষ দখলকার ছিলো। ২য় পক্ষের হুমকী-ধামকীর প্রেক্ষিতে ১ম পক্ষ নালিশী ভূমি হতে বেদখলের আশংকায় সিলেটের কানাইঘাট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) লিপি করে। তবুও ২য় পক্ষ নালিশী দোকানে জোর পূর্বক তালা মেরে দেয় ও চাবি নিয়ে যায়।
পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ২য় পক্ষ থেকে তালার চাবি নিয়ে ২য় পক্ষ কে সেখান হতে বিদায় করে। ১ম পক্ষ বিজ্ঞ জেলা হাকিমের আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় আবার লিখছি ১৪৫ ধারায় নয় বরং ১৪৪ ধারায় কানাইঘাট থানার ২০১৪ সনের ২১ নং বিবিধ মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ হাকিম স্থানীয় থানাকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেন। তদন্ত প্রতিবেদন পেয়ে তা বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞ হাকিম নালিশটি খারিজ করে দেন এই জন্য যে তাঁর মতে নালিশ টি দেওয়ানি চরিত্রের বিরোধ, এই বিরোধে ১৪৪ধারার কোনো উপাদান নাই।
১ম পক্ষ একদিকে সিলেটের কানাইঘাটের বিজ্ঞ সহকারি জজ আদালতে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনায় ২০১৪ সালের ৩১ নং দেওয়ানি মোকাদ্দমা দায়ের করে। এই সিভিল মামলা চলমান অবস্থাতেই ১ম পক্ষ আবার ১৪৪ ধারার মামলায় বিজ্ঞ এডিএম কোর্টের খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে- প্রায় ২বছর কালক্ষেপণ করে- সিলেটের বিজ্ঞ দায়রা জজ আদালতে ২০১৬ সনের ২৭৭ নং ফৌজদারি রিভিশন দায়ের করে। বিজ্ঞ দায়রা আদালত ১ম পক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন।
মূল মামলার ২য় পক্ষ বিজ্ঞ দায়রা জজ আদালতের রিভিশন মঞ্জুর আদেশে বিক্ষুব্ধ হয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ”৫৬১ এ” ধারায় মূল মামলা বাতিলের প্রার্থনায় ২০১৭ সালের ৬০৩৭ নং ফৌজদারি বিবিধি মামলাটি বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশনে দায়ের করেন। সে মামলায় বিচারপতি মোঃ রেজাউল হক এর নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে বিগত ১৪/০৩/২০১৭ ইং তারিখে আলোচ্য রায় প্রদান করেন, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের রায়ের অথর জাজ ছিলেন।
হাইকোর্টে দরখাস্তকারী মূল মামলার ২য় পক্ষের যুক্তি
সংক্ষুব্ধ ২য় পক্ষের দৃষ্টিতে তর্কিত ফৌজদারি রিভিশনে বিজ্ঞ দায়রা জজ মূল ১ম পক্ষের রিভিশন মঞ্জুর করতঃ বিজ্ঞ এডিএম কোর্টের আদেশ পরিবর্তন করে পাল্টে দেন। মূল মামলার ২য় পক্ষ বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশনে নীচের যুক্তিগুলো পেশ করেন, যথা-
(১) বিজ্ঞ রিভিশন আদালত ১৪৪ ধারার প্রায়োগিকতা, অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(২) ১৪৪ ধারার আদেশের ক্ষেত্রে সে আদেশে সুস্পষ্ট এবং বড় ধরণের বেআইনী কিছু না থাকলে উচ্চ আদালতের অজস্র সিদ্ধান্ত মোতাবেকই রিভিশন গ্রহণ না করাই যে বিধান- তা বিজ্ঞ রিভিশন আদালত হয়তো জানতেন না। অর্থাৎ রিভিশন গ্রহণ করা যায় কি যায় না তা ঠিক করতে যেসব বিষয় ধর্তব্য ছিলো, বিজ্ঞ রিভিশন আদালত সেসব বিষয় ধর্তব্যে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
(৩) সিভিল কোর্টে চলমান মামলার ভূমি নিয়ে এডিএম কোর্টে মামলা চলে না মর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত আইনী উপপাদ্যটি প্রয়োগ করতে বিজ্ঞ রিভিশন আদালত ব্যর্থ হয়েছেন। [রায়ের ৩য় অনুচ্ছেদ]
হাইকোর্টে দরখাস্তকারী মূল মামলার ১ম পক্ষের যুক্তি
অন্যদিকে হাইকোর্ট ডিভিশনে এই মামলার প্রতিপক্ষ তথা মূল মামলার ১ম পক্ষ পাল্টা যুক্তি দেন যে, বিজ্ঞ রিভিশন আদালত তর্কিত রায়ে নিম্ন আদালতে আদেশ পরিবর্তন করে পাল্টে দেন নাই। বিজ্ঞ রিভিশন আদালত নিম্ন আদালতের রায় বহাল ই রেখেছেন কেবল যোগ করেছেন পুলিশ যেনো দোকানে পুলিশের কাছে রক্ষিত ২য় পক্ষের মারা তালার চাবি ১ম পক্ষের হাতে তুলে দেয়। [ রায়ের ৫ম অনুচ্ছেদ]
মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশ
উভয় পক্ষের যুক্তি এবং নথীর আইনগত বিবেচনায় নিয়ে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন মামলাটি মঞ্জুর করেন এবং মূল মামলাটি বাতিল করে দেন। [রায়ের ২১তম অনুচ্ছেদ]
হাইকোর্ট ডিভিশনের গঠিত বিচার্য বিষয়
সে মামলার এই আলোচ্য রায়ের ৭ম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার ৩টি বিচার্য্য বিষয় নির্ধারণ করেন, যথা-
(১) যেহেতু মূল নালিশে দরখাস্তকারী ১৪৫ ধারায় না করে ১৪৪ ধারায় দরখাস্ত দায়ের করেছিলো, তাই দরখাস্তটি কি ১৪৪ ধারায় চলবে নাকি ১৪৫ ধারার দরখাস্ত হবে?
(২) যদি পুরো নালিশ বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে দরখাস্তটি আসলে ১৪৫ ধারার দরখাস্ত, দরখাস্তে ১৪৪ ধারা দেখানো ভুল হয়েছে, তবে বিজ্ঞ হাকিম কি ১৪৪ ধারার নালিশটি ১৪৫ ধারার নালিশ হিসেবে নিতে পারবেন কিনা?
(৩) বিজ্ঞ হাকিমের রায়ের পর ২ বছর কালক্ষেপণ করে সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১ম পক্ষের রিভিশন শোনার এখতিয়ার বিজ্ঞ রিভিশন আদালত রাখেন কিনা?
এছাড়া রায়ের ২০ তম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার সিদ্বান্ত দেন, মূল মামলার ১ম পক্ষর যুক্তির আলোকে বিজ্ঞ রিভিশন আদালতের আদেশ নিম্ন আদালতের আদেশ কে পাল্টে দিয়েছে নাকি বহাল রেখেছে তা এই মামলায় হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচার্য বিষয় নয়।
১ নং বিচার্য বিষয় নিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের সিদ্ধান্ত
আলোচ্য রায়ের ১৩তম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার সিদ্বান্ত দেন যে আলোচ্য মূল দরখাস্তটি ১৪৪ ধারায় করাটা ভুল হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে গিয়ে বিচারপতি সরকার ১৪৪ ধারার লিপি এবং ১৪৪ ধারা নিয়ে উপমহাদেশের ১ম উচ্চ আদালতীয় সিদ্ধান্ততথা গোপী মোহন মল্লিক বনাম তারামনি চৌধুরাণী আইএলআর ৫, কলিকাতা ৭ মামলায় ১৮৭৭ সালে দেয়া রায় সহ আরও বেশ কিছু রায়ের সাধারণ সারমর্ম পর্যালোচনা করেন। বিজ্ঞ আদালত ১৪৪ ধারায় “may” শব্দটির উপস্থিতিকে বিচেনায় নিয়ে দেখান যে ১৪৪ ধারা পুরোপুরি ম্যাজিস্ট্রেট এর ডিসক্রেশনারি ক্ষমতার ধারা। [ রায়ের ৯ম অনুচ্ছেদ]
এই রায়ের ১০ম অনুচ্ছেদের লিপি হতে বক্ষ্যমাণ লেখার শুরুতে এই রায় নিয়ে ব্যবহার করা রিটোরিকের উপযুক্ততা অনুভব করেছি। সেই ১০ম অনুচ্ছেদে ফৌজদারি কার্যবিধির সূচীপত্র বিবেচনায় নিয়ে সেটার ব্যাখ্যা লিখে শেষে বিচারপতি সরকার লেখেন- [ফৌজদারি কার্যবিধির] ৮ম, ১০ম ও ১২ তম অধ্যায় এবং ১১ম অধ্যায়ের বিধানগুলো তখনই প্রয়োগ হয় যখন শান্তিভঙ্গের আশংকায় কোনো বেআইনী সমাবেশ অথবা কোনো ৫জন বা ততোধিক ব্যাক্তির সমাবেশ ভেঙ্গে দেয়ার দরকার পড়ে। এরমধ্যে আবার পরিস্থিতি যখন এতোই গুরুতর যে [ফৌজদারি কার্যবিধির] ৮ম, ১০ম ও ১২ তম অধ্যায় প্রয়োগ করে প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা সদূর পরাহত হয় কেবল মাত্র তখনই [ফৌজদারি কার্যবিধির] ১১তম অধ্যায়ের ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায়। উল্লেখ্য ১৪৪ ধারা ফৌজদারি কার্যবিধির ওই ১১তম অধ্যায়তে অন্তর্ভুক্ত ইনফ্যাক্ট ১১তম অধ্যায়ে ১টি মাত্র ধারা আছে সেটি এই ১৪৪ ধারা।
১৪৪ ধারার প্রতিকার কেবল ৬০ দিন কার্যকর থাকে কিন্তু আলোচ্য ঘটনা জমিজমা সংক্রান্ত এবং বহুদিন ধরে চলা বিরোধ। সবচে বড়ো কথা বিদ্যমান পরিস্থিতি এতোটা আশংকাজনক নয় যে [ফৌজদারি কার্যবিধির] ৮ম, ১০ম, ১২তম ও ১৩ তম অধ্যায় কে বাদ দিয়ে সরাসরি ১১তম অধ্যায় তথা ১৪৪ ধারার শরণ নিতে হবে।
২নং বিচার্য বিষয় নিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের সিদ্ধান্ত
আলোচ্য রায়ের ১৭ তম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার সিদ্বান্ত দেন যে এটা সুস্পষ্টে- আলোচ্য নালিশ ১৪৫ ধারার নালিশ তাই দরখাস্তটিকে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৫ ধারার দরখাস্ত হিসেবে বিবেচনায় নেয়ার দরকার ছিলো।
এই সিদ্বান্তে উপনীত হতে গিয়ে বিচারপতি সরকার ১৪৫ ধারার লিপি পর্যালোচনা করেন। বিজ্ঞ আদালত ১৪৪ ধারায় “Shall” শব্দটির উপস্থিতিকে বিচেনায় নিয়ে দেখান যে ১৪৫ ধারার দরখাস্তের প্রেক্ষিতে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে শান্তি ভঙ্গের আশংকার উপাদান থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট ”প্রাথমিক আদেশ” দিতে বাধ্য। সে প্রাথমিক আদেশের রকম ২ প্রকারের হতে পারে, যথা-
(১) ম্যাজিস্ট্রেট বিবদমান পক্ষগণকে বিরোধ নিয়ে লিখিত বক্তব্য প্রদান করতঃ শুনানী করতে বলবেন, অথবা
(২) শান্তিভঙ্গের আশংকার কারণে ইঞ্জাংকশনের আকারে নালিশী ভূমিতে উভয় পক্ষে কে স্থিতিবস্তা বজায় রাখার আদেশ দিবেন, রিসিভার নিয়োগ করবেন। [ রায়ের ১৫তম অনুচ্ছেদ]
প্রাথমিক আদেশের পর মামলা নিষ্পত্তি করতে ম্যাজিস্ট্রেট কি করবেন তার আইনগত সংক্ষিপ্ত বিবরণ রায়ের ১৬তম অনুচ্ছেদে লেখা হয়। বিচারপতি সরকার দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লেখেন আলোচ্য মূল দরখাস্তটি ১৪৪ ধারায় করা ১ম পক্ষের উকিলের সুস্পষ্ট ভুল হয়েছে। [[…] and his lawyer had wrongly mentioned the section ( i.e. Section-145) in their application ]
৩নং বিচার্য বিষয় নিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের সিদ্ধান্ত
আলোচ্য রায়ের ১৯ তম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার সিদ্বান্ত দেন যে, বিজ্ঞ হাকিমের রায়ের পর ২বছর কাল ক্ষেপন করে সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিশন টা বিজ্ঞ রিভিশন আদালতের শোনা ঠিক কাজ হয়নি।
এই সিদ্বান্তর আলাপে বিচারপতি সরকার মূল মামলার ১ম পক্ষের তর্কিত রিভিশন অসদুদ্দেশ্য করেছিলো বলে মনে করেন। মনে করার পেছনের যুক্তি হিসেবে তিনি লেখেন, অসদুদ্দেশ্য না থাকলে রিভিশন দরখাস্ততেই ১ম পক্ষ উল্লেখ করতো নালিশী ভূমি নিয়ে সিভিল কোর্টে মামলা চলমান আছে। যদি সিভিল মামলার তথ্য প্রকাশ করা হতো তাহলে হয়তো বিজ্ঞ দায়রা জজ আদালত একেবারেই নতুন করে ১৪৪ ধারা বা ১৪৫ ধারার প্রয়োগ ব্যতীত ই তর্কিত রিভিশন টি শোনা দূরের কথা, তর্কিত রিভিশনটি গ্রহন ই করতেন না।
আবার ১৮ অনুচ্ছেদের শেষে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন লেখেন, ১৪৪ ধারা ও ১৪৫ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট কে প্রদত্ত ক্ষমতা খুব ই বিশেষ ধরণের ক্ষমতা যা শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে বৃহত্তর স্বাধীনতা সহ প্রদান করা হয়েছে। তাই এসব ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট এর সিদ্বান্ত চ্যালেন্জ করা হলে -তর্কিত সিদ্বান্তে বড়ো ধরণের ব্যতয় না থাকলে তাতে রিভিশন আদালতের হস্তক্ষেপ করা একেবারেই উচিৎ নয়।
মূল মামলার আদেশের পর ২বছর কাল ক্ষেপন করে দায়ের করা রিভিশন দরখাস্ত গ্রহন করায় বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন তর্কিত রিভিশন গ্রহনকারী সিলেটের দায়রা জজ এর প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন লেখেন- […] Therefore, entertainment of revisional application after such a long period of two years by the Learned Session Judge, Sylhet without judiciously scrutinizing the facts as to whether any civil suit is pending over the disputed property appears to us to be a fatal failure of justice.
“সিভিল কোর্টে মামলা থাকলে এডিএম কোর্টে মামলা চলে না” উপপাদ্যের ব্যাতিক্রম
সুস্পষ্টভাবে ব্যাতিক্রম হিসেবে উল্লেখ না করলেও আলোচ্য রায়ের ১৮ অনুচ্ছেদের দীর্ঘ বিবরণ পাঠের সারমর্মে আলোচ্য উপপাদ্যের ব্যাতিক্রম এর আলাপ মর্মে নেয়া অযৌক্তিক হবেনা। ১৮তম অনুচ্ছেদে বলা হয়, ম্যাজিস্ট্রেট এর আদেশের পর ১ম পক্ষ সিভিল কোর্টে মামলা করায় এটা স্পষ্ট যে, ম্যাজিস্ট্রেট এর সিদ্বান্তে বিক্ষুব্ধ নয় বরং ১ম পক্ষ সন্তুষ্ট ই ছিলো।
কিন্তু দীর্ঘ ২বছর কাল অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ ১ম পক্ষ তর্কিত রিভিশন দায়ের করে। তাই ১ম পক্ষ যখন সঠিক ফোরামে মানে দেওয়ানি আদালতে বিরোধটি নিষ্পত্তির চেয়েছিলো, সে অবস্থায় আলোচ্য বিরোধ সংশ্লিষ্ট ১টি পার্শ্ব বিষয় নিয়ে তর্কিত রিভিশনটি দায়ের করেছিলো। বিরোধীয় দোকানে ২য় পক্ষের লাগানো তালার পুলিশের কাছে সংরক্ষিত চাবিই সেই পার্শ্ব বিষয় বলে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন রায়ের ২০তম প্যারায় শেষ লাইনে মনে করেন।
বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন মনে করেন, যে ১ম পক্ষ বরং সিভিল কোর্টে ২য় পক্ষের উপর নিষেধাজ্ঞার আদেশের আবেদন করে দরখাস্ত দিতে পারতো। আর পরিস্থিতি যদি সত্যিই ভয়ানক রকম আশংকাজনক হতো, তবে ১ম পক্ষের সম্পূর্ণ অধিকার ছিলো বিজ্ঞ জেলা হাকিমের কাছে নতুন করে ১৪৫ ধারার নালিশ দায়ের করার যা ১ম পক্ষ করে নাই।
এই সারমর্ম এবং রায়ের ২৩ অনুচ্ছেদের গাইড লাইন মোতাবেক বলা যায় বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন “সিভিল কোর্টে মামলা থাকলে এডিএম কোর্টে মামলা চলে না” উপপাদ্যের ব্যাতিক্রম স্বীকার করে নিয়েছেন।
সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদেরে প্রয়োগ
আলোচ্য রায়ের ২২তম অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার পর্যবেক্ষণ দেন যে দেশের দায়রা আদালতগুলোতে ১৪৪/১৪৫ ধারা সংক্রান্ত রিভিশনে উপচে পড়ছে। সে প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অর্পিত দায়িত্বের পালন এর অংশ হিসেবে ১৪৪/১৪৫ ধারা সংক্রান্ত রিভিশনের ক্ষেত্রে দায়রা আদালতের জন্য পালনীয় ১টি গাইড লাইন প্রদান করেন। যেথা-
(১) সবার প্রথমে রিভিশ দরখাস্তে বিজ্ঞ দায়রা আদালত লক্ষ করবেন যে প্রার্থী যথা সম্ভব দ্রুত রিভিশন দায়ের করতে পেরেছে কিনা। আর যদি বিলম্ব হয় তবে সে বিলম্বের পেছনে আসলেই যথোপযুক্ত গ্রহণযোগ্য কারণ আছে কিনা।
(২) রিভিশন দরখাস্ত ভালো করে নিরীক্ষা করে দায়রা আদালত দেখবেন যে তর্কিত ভূমি নিয়ে কোনো সিভিল মামলা চলমান আছে কিনা। যদি সিভিল মামলা চলমান থাকে তবে দায়রা আদালত সে রিভিশন গ্রহণ করান বেলায় কঠোর থাকবেন- কেবল তখনই রিভিশন গ্রহণ করবেন যে বিদ্যমান পরিস্থিতি আসলেই এতো আশংকাজনক মনে হয় যে দায়রা জজের হস্তক্ষেপ অত্যাবশ্যক।
(৩) রিভিশন দরখাস্ত গ্রহন করার সময় বিজ্ঞ দায়রা জজ সুনিশ্চিত হবেন যে তর্কিত আদেশে ম্যাজিস্ট্রেট সুস্পষ্টভাবে আইনের বড়োসড়ো ব্যাতয় ঘটিয়েছেন।
এই গাইডলাইনের ধারাবাহিকতাতেই বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন আগেই আলাপ করা বিজ্ঞ জেলা হাকিমদের জন্য ১৪৪/১৪৫ ধারার মামলা সংক্রান্ত গাইড লাইন প্রদান করেন।
হাইকোর্ট ডিভিশনের অন্যান্য নির্দেশ
বক্ষ্যমাণ রায়ের ২৪ অনুচ্ছেদে বিচারপতি সরকার লেখেন যে, আমাদের দেশের জেলা ও নির্বাহী হাকিমগণ ১৪৪/১৪৫ ধারার মামলাগুলোতে আইনের সঠিক ব্যহার করতে পারছেন না। তাঁদের এ ব্যর্থতার ফলেই দায়রা আদালতে রিভিশনগুলো দায়ের হচ্ছে। তাঁদের এই ব্যর্থতার কারণ হলো বিজ্ঞ জেলা ও নির্বাহী হাকিমগণ এই ১৪৪/১৪৫ ধারা নিয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষন প্রাপ্ত হন না। এই আলাপের শেষে বিজ্ঞ হাইকোর্ট ডিভিশন নির্দেশ দেন যেনো- বাংলাদেশে সুপ্রীম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল
(১) এই রায়টির অনুলিপি বাংলাদেশে সকল বিজ্ঞ দায়রা জজগণের নিকট প্রেরণ করেন, এবং
(২) রায়ের অনুলিপি সাথে জেলা ও নির্বাহী ম্যাজিসস্ট্রেগণের জন্য ১৪৪/১৪৫ ধারার উপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার আদেশ বাংলাদেশ প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা ইনিস্টিটিউট (বিয়াম) এর মহাপরিচালকের নিকট প্রেরণ করেন।
লেখক : আইনজীবী, কুমিল্লা জজ কোর্ট।