ব্যারিস্টার খন্দকার মোহাম্মদ মুশফিকুল হুদা : রিট (Writ) শব্দের অর্থ হল আদালত বা যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ঘোষিত বিধান বা আদেশ। সংবিধানে দেশের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা বলা হয়েছে। আর নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রকে।
ফলে কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে প্রতিকার চাওয়া যায়। আর এইরূপ আবেদন পেলে উচ্চ আদালত (হাইকোর্ট) সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে মৌলিক অধিকার বলবত করার আদেশ দিতে পারেন।
তবে এই আবেদন করার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। রিট পিটিশনার বা আবেদনকারী সম্পর্কিত, রেসপন্ডেন্ট বা বিবাদী সংক্রান্ত, আবেদনে কোন কোন বিষয় চ্যালেঞ্জ করা যাবে ইত্যাদি। আজকের আলোচনায় এসব বিষয়ে সম্যক ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
রিট পিটিশনার বিষয়ে
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে রিট আবেদনকারী কে হবেন। এটি নিশ্চিত হওয়ার পর রিট পিটিশনারের অধিকার কি এবং কীভাবে তিনি সংক্ষুব্ধ সে বিষয়গুলো আবেদনে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।
রিট রেসপন্ডেন্ট বিষয়ে
দ্বিতীয় ধাপে ঠিক করতে হবে রিটের বিবাদী কে বা কারা হবেন। এক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগ, মন্ত্রণালয়ের বিভাগের দায়ী সরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারদের পদবি উল্লেখ করতে হবে।
যা চ্যালেঞ্জ করা যাবে
রিট আবেদনে আইন (Statute); বিধিমালা (Rules); প্রবিধিমালা (Regulations); নীতিমালা (Principles); কৌশল (Policies); আদেশ (Order); নির্দেশনা (Direction); সিদ্ধান্ত (Decision); নিষ্ক্রিয়তা (Inaction); ছুট বা বাদ দেয়া (Omission); স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা (Discretionary Power) এই বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জ করা যাবে।
রিট মোকাদ্দমা দায়েরের পূর্বে কার্যক্রম (Pre-Action Protocol)
রিট মোকদ্দমা দায়েরের পূর্বে আইন দ্বারা নির্ধারিত কার্যক্রম থাকলে তা সম্পন্ন করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে কিনা; আইন দ্বারা নির্ধারিত কার্যক্রম বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থার আইনসঙ্গত ফলাফল এসেছে কিনা; রিটকারী সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি কোন পত্রের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে তর্কিত বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কোন আবেদন করেছেন কিনা; আইনজীবীর মাধ্যমে বিবাদীদের (Respondent) কোন ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশ (Demand of Justice Notice) করা হয়েছে কিনা এসব বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
সাংবিধানিক বিষয় প্রস্তুতি
এরপর খেয়াল রাখতে হবে সংবিধান বিষয়ে। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৪৪ (১) তৎসহ অনুচ্ছেদ নং ১০২ মোতাবেক রিট মোকাদ্দমা দায়ের হচ্ছে মর্মে বক্তব্য; বাংলাদেশ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে উল্লেখিত অনুচ্ছেদ নং ২৭ থেকে অনুচ্ছেদ নং ৪৩ পর্যন্ত উল্লেখিত কোন মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা; সংবিধানের তৃতীয় ভাগে উল্লেখিত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে একই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের কোন অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা প্রযোজ্য দেখে নেয়া হয়েছে কিনা; সংবিধানের ব্যাখ্যা বিষয়ে রিট দায়ের করা হলে সংবিধানের প্রস্তাবনা; অনুচ্ছেদ নং ৭, ৭ক, ৭খ ও ৮ প্রযোজ্য কিনা, কোন আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত (Ultra Vires) চ্যালেঞ্জ করা হয়ে থাকলে নির্দিষ্ট করতে হবে আইনটি কোন প্রকারের, যথা: এটি কি সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ৬৫ (১) মোতাবেক প্রণীত Statute তথা আইন কিংবা এটি কি সংবিধানের অধীন অনুচ্ছেদ নং ৬৫ (১) ভিন্ন সংবিধানের অন্য কোন অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত Delegated Legislation কিনা; আইনটি কি সংবিধানের Basic Structure Doctrine এ উল্লেখিত Basic Structure লঙ্ঘনের বিষয়ে কিনা; সংবিধানের অনুচ্ছেদ নং ১৪২ মোতাবেক আনীত সংবিধানের কোন সংশোধন কিনা, যা সংবিধানের প্রস্তাবনা, অনুচ্ছেদ নং ৭, ৭ক, ৭খ, তৃতীয় ভাগের উল্লেখিত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন কিনা এইসব বিষয় আবেদনে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।
রিটের ধরণ কি এবং কি আদেশ প্রদান করা হয়
রিট মূলত ৫ ধরণের হয়ে থাকে। যথা : (১) Writ of Habeas Corpus (হেবিয়াস কর্পাস); (২) Writ of Mandamus (ম্যান্ডামাস); (৩) Writ of Prohibition (প্রহিবিশন); (৪) Writ of Certiorari (সারসিওরারি) এবং (৫) Writ of Quo-Warranto (কো-ওয়ারেন্টো)।
এরমধ্যে হাবিয়াস কর্পাস রিট (Habeas Corpus Writ), তৃতীয় নং ভাগের অনুচ্ছেদ নং ১০২ (২) (খ) (অ) এর মাধ্যমে মহামান্য আদালত আইন ও বিধিবিধানের বাইরে কোন ব্যক্তিকে প্রজাতন্ত্রের কোন সংস্থা বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তি কর্তৃক বেআইনি আটক রাখা হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করেন এবং যথাযথ আদেশ প্রদান করে থাকেন।
ম্যানডামাস রিট (Mandamus Writ), তৃতীয় নং ভাগের অনুচ্ছেদ নং ১০২ (২) (ক) (অ) এর দ্বিতীয় অংশ এর মাধ্যমে মহামান্য আদালত আইন কর্তৃক নির্ধারিত কর্তব্য পালনের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে থাকেন।
প্রহিবিশন রিট (Prohibition Writ), তৃতীয় নং ভাগের অনুচ্ছেদ নং ১০২ (২) (ক) (অ) এর প্রথম অংশ আইন দ্বারা আইন কর্তৃক বারিত কার্যক্রম চালনা থেকে বিরত থাকার জন্যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়ে থাকে।
সারসিওরারি রিট (Certiorari Writ), তৃতীয় নং ভাগের অনুচ্ছেদ নং ১০২ (২) (ক) (আ) যাহাতে পূর্ববর্তী সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, অধস্তন আদালত, ট্রাইবুনালের এবং কোয়াশি-জুডিশিয়ারি ইতিমধ্যে দেয়া সিদ্ধান্ত বা আদেশ বা কর্মকান্ডকে ইত্যাদি কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং কেন যথাযথ আদেশ দেয়া হবে মর্মে মহামান্য হাই কোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন।
কো-ওয়ারেন্টো রিট (Quo-Warranto Writ), তৃতীয় নং ভাগের অনুচ্ছেদ নং ১০২ (২) (খ) (আ) এর মাধ্যমে মহামান্য আদালত প্রজাতন্ত্রের কোন পদে আসীন কোন ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিতে পারেন কোন অধিকার বা আইনগত অধিকারের ভিত্তিতে তিনি উক্ত পদে অধিষ্ঠিত আছেন এবং তৎবিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দিতে পারেন।
বাংলাদেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সমূহের গঠন
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৯টি মন্ত্রণালয় আছে। এই সকল মন্ত্রণালয়সমূহ সুনির্দষ্ট বিষয় ভিত্তিক কার্যক্রম নির্বাহ করার জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত। মন্ত্রণালয় প্রধান হলেন একজন মন্ত্রী। কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বেও থাকে। কিছু কিছু মন্ত্রণালয় সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকে। যেমন : সশস্ত্র/প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ইত্যাদি।
মন্ত্রণালয় সমূহের মূল দায়িত্ব হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্ত সকল অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও অন্যান্য অধস্তন দপ্তরসমূহের সংগঠন, ব্যাবস্থাপনা ও পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ ও দেখাশুনা করা। দায়িত্বপ্রাপ্ত বিষয়ে কর্ম কৌশল নির্ধারণ, সেবার খাত নির্ধারণ, সেবার প্রদানে সরকারি ফী নির্ধারণ, বিনা ফীতে সেবা প্রদানের খাত নির্ণয়, সংগঠন পুনর্গঠন, কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নকরণ, সেবা সংশ্লিষ্ট জনগণ ও কর্মবিভাগের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করা ইত্যাদি।
মন্ত্রণালয় সমূহের দায়িত্ব ও কর্তব্য রুলস অফ বিসনেস, ১৯৯৬ (সংশোধিত ২০১৭) এর অধীন প্রণীত এলোকেশন অফ বিসনেস এমাং ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিজ এন্ড ডিভিশনস, ১৯৯৬ (সংশোধিত ২০১৭) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
মন্ত্রণালয়ে যে সকল মন্ত্রী নিয়োগ দেয়া যেতে পারে
(ক) মন্ত্রী (Minister);
(খ) প্রতিমন্ত্রী (State Minister);
(গ) উপমন্ত্রী (Deputy Minister);
উল্লেখ্য, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী একটি মন্ত্রণালয়ের প্রধান কার্য নির্বাহী কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আর সচিব/সিনিয়র সচিব মন্ত্রণালয়ের প্রিন্সিপাল একাউন্টিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রণালয় সমূহের গঠন
(০১) বিভাগ (Division); প্রধান: সচিব/সিনিয়র সচিব (Senior Secretary/Secretary)
(০২) অনুবিভাগ (Wing); প্রধান: অতিরিক্ত সচিব (Additional Secretary)
(০৩) অধিশাখা (Branch); প্রধান: যুগ্ম সচিব (Joint Secretary)
(০৪) শাখা (Section); প্রধান: উপসচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব (Deputy Secretary/Senior Assistant Secretary)
বিজ্ঞ আইনজীবীদের রিট মোকাদ্দমা প্রস্তুতির কালে রেসপন্ডেন্ট নির্ণয়ের সময় খেয়াল রাখতে হবে সঠিক পদবি উল্লেখ করে রেসপন্ডেন্ট যেন দরখাস্ত লেখা হয়।
সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি
(০১) রুলস অফ বিসনেস, ১৯৯৬ (সংশোধিত ২০১৭)।
(০২) এলোকেশন অফ বিসনেস এমাং ডিফারেন্ট মিনিস্ট্রিজ এন্ড ডিভিশনস, ১৯৯৬ (সংশোধিত ২০১৭)।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।