শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : বাংলাদেশের দুগর্ম প্রান্তিক এলাকায় এক ধরনের আদালতকে চৌকি আদালত (Chowki adalat) বলে। চৌকি আদালত অর্থ উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত দেওয়ানি বা ফৌজদারি এখতিয়ার। চৌকি আদালতেও মামলা করার জন্য অন্যান্য আদালতের মতোই দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে বর্ণিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়।
এই আদালতের ইতিহাস অনেক প্রাচীন ও গৌরবময়। পাক ভারত উপমহাদেশে এই আদালত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বিচার ব্যবস্থা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। বর্তমানে চৌকি আদালতকে উপজেলা পর্যায়ে সিনিয়র সহকারী জজ আদালত ও সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বলা হয়।
ব্রিটিশ আমলে এই দুই আদালত একজন মুন্সেফ ও ম্যাজিস্ট্রেট পরিচালনা করতেন। সারাদেশে বর্তমানে ১৬টি জেলায় ফৌজদারি ও দেওয়ানি মিলে ৪৩টি চৌকি আদালত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৫টি হলো ফৌজদারি আদালত ও ১৮টি হলো দেওয়ানি আদালত।
২৫টি ফৌজদারি আদালত হচ্ছে- দুর্গাপুর, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, পটিয়া, লামা, মহেশখালী, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, জকিগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বড়লেখা, ধর্মপাশা, কয়রা, পাইকগাছা, মঠবাড়িয়া, মনপুরা, চরফ্যাশন, মীর্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, দশমিনা, গলাচিপা, আমতলী, পাতরঘাটা ও শাহজাদপুর।
১৮টি দেওয়ানি আদালত হচ্ছে- দুর্গাপুর, সন্দ্বীপ, পটিয়া, রাউজান, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চরফ্যাশন, হাতিয়া, শাহজাদপুর, নবীনগর, বাজিতপুর, চিকনদী, কয়রা, পাইকগাছা, ভাঙ্গা, ঈশ্বরগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ।
উপযুক্ত চৌকি আদালতগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে ৭টি চৌকি আদালত। ১৮৮০ সাল থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে এই আদালতগুলো প্রতিষ্ঠা হয়।
ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জে ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ সরকার একটি চৌকি আদালত স্থাপন করে। এই আদালত তৎকালীন বৃহত্তর ঈশ্বরগঞ্জ (বর্তমানে গৌরিপুর ও নান্দাইল), ফুলপুর, কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের কিছু অংশের দেওয়ানি মোকদ্দমার জন্য চালু হয়। বর্তমানে এই চৌকি আদালতে ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরিপুর ও নান্দাইল উপজেলার দেওয়ানি মোকদ্দমার কার্যক্রম চালু রয়েছে। দেশের অপরাপর চৌকি আদালতগুলোও প্রায় একই সময়ে স্থাপিত হয়।
জানা যায়, ১৭৯৩ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করে। ফলে এ অঞ্চলে জমিদারদের পূর্বাপর অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য অপরিবর্তিত থাকলেও শাসক অভিজাত মহলের চাহিদার উপযোগী করার জন্য ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কাঠামোতে কিছু পরিবর্তন করা হয়। ভূমির পরিবর্তিত ব্যবস্থায় জমিদারগণ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন।
তারা খাজনা অনাদায়ী গরিব প্রজাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাত। কখনও খরা, বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে জমিতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে প্রজাদের পক্ষে খাজনা প্রদান করা সম্ভব হতো না। তখন গরিব প্রজারা জমিদারদের অত্যাচার-নির্যাতনের ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে অন্যত্র গিয়ে প্রাণ বাঁচাত। এর ফলে জমিদাররা খাজনা আদায় করতে না পারায় তারা ব্রিটিশ কোম্পানি শাসককে খাজনা প্রদান করতে পারত না। পক্ষান্তরে গরিব প্রজারাও জমির স্থায়ী মালিকানা থেকে বঞ্চিত হতেন।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শাসনের অবসানের পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি শাসন শুরু করলে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন আনয়ন করে। ফলশ্রুতিতে ১৮৮০ সালের দিকে ভূমি আইন সংশোধন করে প্রজাদেরকে জমির মালিকানা দেওয়া হয়। এই সময়ে খাজনা আদায়ের বিধান চালু করে। তখন কোনো প্রজা খাজনা দিতে না পারলে ঐ প্রজাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো না। বরং খাজনা আদায়ের জন্য মামলা করার বিধান চালু করা হয়। তখন খাজনা আদায় সংক্রান্ত মামলার বিচারের জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় গরিব প্রজাদের সুবিধার্থে চৌকি আদালত নামে এক ধরনের আদালত স্থাপন করে ব্রিটিশ সরকার। সমকালে এই চৌকি আদালত কৃষি জমির রাজস্ব নির্ধারণ ও গরিব প্রজাদের সমস্যা সমাধানে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে।
ব্রিটিশ আমল ছাড়াও পরবর্তীকালে যোগাযোগ ব্যবস্থায় দুর্গম এলাকাগুলোতে এ ধরনের আরও কিছু আদালত স্থাপিত হয় ও পূর্বাপর কিছু আদালত জেলা সদরে আনা হয়।
প্রত্যন্ত এলাকায় স্থাপিত এসব আদালত আজও চৌকি আদালত নামেই পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী এসব আদালতে যে সকল আইনজীবী, বিচারক কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে তাঁরা অনেকেই খ্যতিমান হয়েছেন। তাছাড়া তৎকালীন এ আদালতকে ঘিরে সমকালে অনেক স্কুল, ভবন, বার অ্যাসোসিয়েশন গড়ে ওঠেছিল যা বর্তমানে এগুলো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে এসব চৌকি আদালত অতুলনীয় ভূমিকা রাখছে।
লেখক : গবেষক