ছগির আহমেদ টুটুল : সাধারণভাবে বলা যায়, কোন মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণাদি গ্রহণের পর আসামি নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ছাড়া পেলে, তাকে খালাস বলে। তবে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির বিভিন্ন ধারায় ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে খালাসের বিধান আলোচনা করা হয়েছে। আমরা আজকে ছোট ছোট আলোচনার মাধ্যমে সহজ ভাষায় বিষয়গুলো সম্পর্কে সুন্দর একটি ধারণা নেয়ার চেষ্টা করব। আশা করি আপনারা সবাই কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৫ ধারা অনুসারে আসামিকে খালাস দেয়ার বিধান
ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৪ ধারায় সাক্ষ্য গ্রহণ করে এবং তিনি স্বপ্রণোদিত [suo motu] অতিরিক্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করে যদি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি না পান, তাহলে তিনি খালাসের আদেশ লিপিবদ্ধ করবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট সকল সাক্ষ্য নিয়ে তারপর আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তি না পেলে, আসামিকে খালাস দিবেন। খালাসের আদেশ দেয়া হয় চার্জ গঠন করে সমস্ত সাক্ষ্য নেয়ার পর। আর আসামীকে অব্যাহতি দেয়া হয় চার্জ গঠনের আগে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৭ ধারা অনুসারে আসামীকে খালাস দেয়ার বিধান
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৭ ধারা নিয়ে কিছু কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। ২৪৭ ধারা কেবলমাত্র নালিশী মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। পুলিশী মামলার ক্ষেত্রে ২৪৭ ধারা কখনো প্রযোজ্য হবে না। এখন প্রশ্ন হল পুলিশী মামলা এবং নালিশী মামলা কি?
নালিশী মামলা : যে সকল মামলা থানায় এফ.আই.আর (FIR) এর মাধ্যমে ফাইল না করে সরাসরি অভিযোগ দায়েরের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করা হয় তাকে নালিশী মামলা বলে। নালিশী মামলায় ফরিয়াদীকে মামলার খরচ বহন করতে হবে। ফরিয়াদী মানে হল মামলার অভিযোগকারী ব্যক্তি।
পুলিশী মামলা : যে সকল মামলা এফ.আই.আর এর মাধ্যমে থানায় দাখিল করা হয় তাকে পুলিশী মামলা বলে। FIR মানে হল First Information Report. পুলিশী মামলায় মামলার সমস্ত খরচ বহন করবে রাষ্ট্রপক্ষ।
এখানে আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য সমন দিতে হবে। যদি আসামিকে হাজির করার জন্য আদালত ওয়ারেন্ট ইস্যু করে তাহলে এক্ষেত্রে ২৪৭ ধারা প্রযোজ্য হবে না। নালিশী মামলায় শুনানির জন্য ধার্য তারিখে ফরিয়াদী অনুপস্থিত এবং আসামি উপস্থিত থাকলে আসামি খালাস পাবে। তবে এক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক আসামিকে সমন দিতে হবে। তার মানে আসামিকে আদালতে হাজির করার জন্য সমন দিতে হবে, ওয়ারেন্ট দিলে চলবে না।
এখন কথা হলো ২৪৭ ধারা সমন ইস্যুর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রযোজ্য হবে।ওয়ারেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না কেন? আমরা জানি কোন কোন ক্ষেত্রে আসামিকে আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে আদালতে হাজির করার জন্য সমন বা ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হবে সেটা ফৌজদারী কার্যবিধির শিডিউল -২, কলাম-৪ এ বলা আছে। সাধারণত ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে আসামিকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য সমন ইস্যু করা হয়ে থাকে। আর বড় ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে আসামিকে উপস্থিত করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে।
এখন ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে ফরিয়াদী অনুপস্থিত থাকলে এবং আসামি উপস্থিত থাকলে, আসামিকে আদালত খালাস দিতে পারবে। খুন (murder) একটা বড় ধরনের অপরাধ। এক্ষেত্রে আসামিকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়ে থাকে। খুনের মামলায় আদালত কর্তৃক ধার্য তারিখে ফরিয়াদী অনুপস্থিত থাকলেই কি আসামিকে আদালত খালাস দিতে পারবে? উত্তর হচ্ছে না, পারবে না।এজন্য ২৪৭ ধারা ওয়ারেন্ট ইস্যুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। আশা করি ২৪৭ ধারার ফিলোসফিটা আপনাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৮ ধারা অনুসারে আসামিকে খালাস দেয়ার বিধান
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ২৪৮ ধারা অনুসারে কোন মামলায় চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার আগে অভিযোগকারী তাঁর নালিশ প্রত্যাহার করার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে পারে। ম্যাজিস্ট্রেট সন্তুষ্টি সাপেক্ষে মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি দিবেন এবং আসামিকে খালাস দিবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(H) ধারা অনুসারে দায়রা আদালত কর্তৃক আসামিকে খালাস দেয়ার বিধান
বাদীপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণ, আসামির জবানবন্দি গ্রহণ এবং বাদীপক্ষ ও আসামিপক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত যদি মনে করেন যে, আসামি অপরাধ করেছে এরূপ কোন সাক্ষ্য নেই, এক্ষেত্রে আদালত আসামীকে খালাস দিতে পারবেন।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আদালত সাক্ষীদের প্রতি বার বার প্রসেস বা সমন দেয়া সত্ত্বেও সাক্ষীগণ আদালতে এসে হাজির হচ্ছে না। প্রসেস জারি হবার পর আদালতে সাক্ষীর জন্য বার বার দিন ধার্য করলে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। পাশাপাশি আসামিপক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হয়রানির শিকার হয়। এক্ষেত্রে দায়রা আদালত ২৬৫(H) ধারা অনুযায়ী আসামিপক্ষকে খালাস প্রদান করবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(K) ধারা অনুসারে আসামিকে খালাস দেয়ার বিধান
দায়রা আদালত যুক্তিতর্ক এবং আইনের পয়েন্ট (যদি থাকে) শোনার পর আদালত মামলার রায় প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে অপরাধ প্রমাণিত না হলে দায়রা আদালত ২৬৫(K) ধারা অনুসারে আসামিকে খালাস দিবেন।
ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামিকে ক্ষমার শর্তে রাজসাক্ষী করে খালাস দেয়ার বিধান
অপরাধ কাজের কোন সহচর যদি তার সহচরদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তাহলে তাকে রাজসাক্ষী বলে। রাজসাক্ষী যদি ক্ষমার প্রস্তাব একবার গ্রহণ করে তাহলে সে অন্য সাক্ষীর মত হয় এবং অন্য সাক্ষীর মত তাকে পরীক্ষা করা যায়। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৭ ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত রাজসাক্ষীর ক্ষমার প্রস্তাব গ্রহণ সাপেক্ষে তাকে খালাস দিয়ে থাকেন।
দায়রা আদালত আসামি কে ক্ষমার শর্তে রাজসাক্ষী করে খালাস দেয়ার বিধান
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৮ ধারা অনুসারে দায়রা আদালত রাজসাক্ষীর ক্ষমার প্রস্তাব গ্রহণ সাপেক্ষে তাকে খালাস দিয়ে থাকেন। তবে রাজসাক্ষীর বিবৃতিতে দুটি জিনিস থাকতে হবে। যথা :
(১) সে অপরাধে অংশগ্রহণ করেছিল।
(২) অন্য প্রত্যেকটি আসামির অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দ্বারা সমর্থিত ছিল।
আপোষের ভিত্তিতে আসামিকে খালাস দেয়ার বিধান
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪৫(৬) ধারার অধীনে কোন বিচারক আপোষের অনুমতি দিলে দন্ড ও শাস্তির আদেশ বাতিল করে আসামিকে খালাস দিবেন।
আইনগতভাবে একবার আপোষ হয়ে গেলে কোন পক্ষই তা প্রত্যাহার করতে পারবে না। আপোষের শর্ত ভঙ্গের জন্য দেওয়ানী মামলা হতে পারে। কিন্তু একবার আপোষ হয়ে গেলে তা আর প্রত্যাহার করা যায় না। যদি নালিশকারী অভিযোগ করেন যে, আসামি আপোষের শর্ত পালন করেনি। এই পরিস্থিতিতেও মামলা পুনরুজ্জীবিত করে আসামিকে অভিযুক্ত করা যাবে না। [১৭ CWN ৯৪৮]
বিচারের মাধ্যমে আসামি খালাসপ্রাপ্ত হলে ১৮৯৮ ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা মতে ক্ষতিপূরণ করার কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আপোষের মাধ্যমে আসামি খালাস পেলে ও পূর্ণ ট্রায়াল হয় না। তাই ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা এক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে না।
উন্মাদের কারণে খালাসের রায়ের বিধান
দন্ডবিধির ৮৪ ধারায় খালাসের রায় ঘোষণা করার আগে বিকৃত মস্তিষ্কতা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হতে হবে। ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৬৯ এবং ৪৭০ ধারা একসাথে পড়তে হবে। অপরাধ সংঘটনকালে অভিযুক্ততার প্রকৃতি অনুধাবনে অক্ষম মর্মে আদালত সন্তুষ্ট হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস দিবেন।
জি.আর. মামলার ক্ষেত্রে আসামিকে খালাসের বিধান
পাবলিক প্রসিকিউটর রায় ঘোষণার আগে আদালতের অনুমতি নিয়ে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহার করতে পারবেন। মামলাটি যদি অভিযোগ গঠনের পর প্রত্যাহার করা হয় তাহলে এক্ষেত্রে আসামিকে খালাস দেয়া হবে। এই কথাগুলো ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধির বিভিন্ন পরিস্থিতিতে খালাসের বিধানগুলো একসাথে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের কিছুটা হলেও ভালো লেগেছে।
লেখক: ছগির আহমেদ টুটুল, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, সিলেট।