রাজধানীর আদালতপাড়ায় নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে মাদকসেবী, হকার ও ভিক্ষুকদের অবাধ আনাগোনা। বিচারক, আইনজীবীদের পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীরাও আছেন ঝুঁকিতে। হকার ও ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে যে কোনো সন্ত্রাসী নাশকতা চালাতে পারে।
আইনজীবীরা বলছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢিলেঢালা হওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার আশঙ্কা বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে আদালতপাড়ায় হকারদের সরিয়ে নিরাপত্তা জোরদারের দাবি জোরালো হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, আদালত চত্বরে আইনের বই থেকে শুরু করে চা, পান, সিগারেট, ইঁদুর-তেলাপোকা মারার বিষ, লুঙ্গি-গামছা, মোবাইল সিম, বেল্ট, ঝালমুড়ি, আচার, ডাব, কলা, ভেষজ ওষুধ বিক্রি করা হচ্ছে। রয়েছেন দাঁতের চিকিৎসকও।
বিচার চলাকালে এজলাসের সামনে গিয়ে হকাররা মৌসুমি ফল, বাদাম ও কফি বিক্রির হাঁকডাক দেন। জেলা জজ আদালত, দায়রা জজ আদালত, সিজিএম ও সিএমএম আদালত ভবনে ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে বিক্রি করছেন হকাররা। আছেন বাদাম বিক্রেতা, আমড়া ও পেয়ারা বিক্রেতাও। রাত হলে বাড়ে মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্য।
আইনজীবীরা জানান, অন্য জেলার চেয়ে ঢাকায় বেশি মামলা বিচারাধীন। আদালতের সংখ্যা ১১৮টি। এগুলোতে সাড়ে চার লাখের বেশি ফৌজদারি ও দেড় লাখের বেশি দেওয়ানি মামলার বিচার চলছে। প্রতিদিন বিচারক, আইনজীবী, মোহরার ও বিচারপ্রার্থীরা আদালতে আসছেন। বিভিন্ন কারাগার থেকে গড়ে পাঁচশ-ছয়শ আসামিকে আদালতে আনা হয়। এদের হিসাব রাখতে হয় পুলিশকে। দখল করা ফুটপাতের দোকানিদের পসরা ঠেলে আসামিদের কাস্টডি থেকে নিতে হয় এজলাসে। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন অর্ধ লক্ষাধিক বিচারপ্রার্থীর বিচরণ দেখা যায় আদালতপাড়ায়।
দেখা গেছে, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পুরোনো ও নতুন ভবনের সামনে, মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে, নতুন সিজিএম ভবনের সামনে ও বারান্দায়, রেবতী ম্যানসনের সামনেসহ পুরো আদালতপাড়ায় শতাধিক হকার ও ফেরিওয়ালার বিচরণ। অভিযোগ আছে, এ হকারদের বসানোর পেছনে রয়েছে পুলিশ ও আদালত স্টাফদের সহযোগিতা। তাঁরা নিয়মিত মাসোহারা পেয়ে থাকেন।
ঢাকা মহানগর আদালতের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু গণমাধ্যমকে বলেন, আদালত চত্বরে হকার, ভিক্ষুক ও অচেনা লোকজনের আনাগোনা মোটেই কাম্য নয়। এদের কারণে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। আদালত এলাকায় কেউ যেন ঝুঁকির মধ্যে না থাকেন, সে জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। পুরো আদালত অঙ্গন ঝুঁকিমুক্ত করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগের উপকমিশনার জাফর আহমেদ বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আদালতে হকার বসার কথা নয়। তিনি বলেন, একজন বাদাম বিক্রেতা প্যাকেটের মাধ্যমে অস্ত্র বহন করতে পারেন। তাঁদের কোনোভাবেই বসতে দেওয়া যায় না।
তিনি জানান, আদালত এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন ৪৭০ জন পুলিশ। ৩২টি সিসি ক্যামেরা বসিয়ে মনিটরিং করা হয়। হকার উচ্ছেদে সমন্বিত প্রয়াস দরকার বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা মহানগর আইনজীবী সমিতির সামনের সড়কে গামছা ও কালিজিরা বিক্রি করেন এমন দু’জন জানান, মিজান চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি প্রতিদিন বিকেলে ৩০ থেকে ৫০ টাকা করে নিচ্ছেন। এ টাকা দিয়ে সকাল ১১টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত তাঁরা বেচাকেনা করতে পারেন।
আদালত চত্বরে চা বিক্রেতা মনির, বাদাম বিক্রেতা দুলাল ও পেয়ারা বিক্রেতা মোতালেব জানান, মাঝেমধ্যে কেউ কেউ ফাও খেয়ে যান।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফিরোজার রহমান মন্টু গণমাধ্যমকে বলেন, পুরো আদালত প্রাঙ্গণকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল, নিরাপত্তা ও ঝুঁকিমুক্ত করতে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হকার, ভিক্ষুক ও অযাচিত ব্যক্তির কারণে নিরাপত্তা ও পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, হকারদের পুনর্বাসনের দিকটাও দেখতে হবে।
আদালত চত্বরে চুরি-ছিনতাইর মতো ঘটনাও ঘটেছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনে প্রবেশে আর্চওয়ে নেই। ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রবেশপথে দুটি আর্চওয়ে থাকলেও সার্বক্ষণিক লোক থাকে না। ২০০৫ সালে সারাদেশে একযোগে জেএমবির বোমা হামলার পর আদালতপাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে।
আদালতপাড়ায় ভিক্ষুকের উৎপাত নিয়েও অনেকে অভিযোগ করেন। বিভিন্ন বয়সের নর-নারীরা এজলাসের সামনে এসে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছেন। বেশিরভাগই পেশাদার ভিক্ষুক। আইনজীবীদের অভিযোগ, ভিক্ষুকরা অনেক সময় অ্যাপ্রোন (আইনজীবীদের পোশাক) ধরে টানাটানিও করেন। তখন বাধ্য হয়ে ভিক্ষা দিয়ে রেহাই পেতে হয়।
সূত্র : সমকাল