জাল নথি ও ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহারের মাধ্যমে ভিত্তিহীন রিট করে আদালতের সময় নষ্ট করায় চাঁদপুরের বিতর্কিত ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সেলিম খানকে ৫০ লাখ ও অপর দুই রিটকারীকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া রায়ের ২১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি আজ বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) প্রকাশ করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ৯ জুন এ রায় ঘোষণা করেন আদালত।
রায়ে নথি পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। জমা না দিলে চাঁদপুর জেলা প্রশাসককে তাদের কাছ থেকে এই টাকা আদায় করতে বলা হয়েছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, সেলিম চেয়ারম্যান জনপ্রতিনিধি হিসেবে ঘৃণিত কাজ করেছেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় ব্যবহার করে অবৈধ, অনৈতিক ও জনস্বার্থবিরোধী কাজ করেছেন। বিশেষ করে নির্বাচিত চেয়ারম্যান কর্তৃক এ ধরনের আচরণ অপ্রীতিকর ও অত্যন্ত অবমূল্যায়নজনক।
ঘটনার পূর্বাপর
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত ভূমি অধিগ্রহণের লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়নের মেঘনাপাড়ের একটি এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ৬২ একর ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করতে গিয়ে দেখা যায়- ওই ইউপির চেয়ারম্যান সেলিম খান, তার ছেলে-মেয়েসহ অন্যান্য জমি মালিকরা অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে দলিল তৈরি করেছেন। এর ফলে ওই জমি অধিগ্রহণে সরকারের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা।
জমির অস্বাভাবিক মূল্য দেখে জেলা প্রশাসক তদন্ত করলে বেরিয়ে আসে সরকারের কয়েকশ’ কোটি টাকা লোপাটের পরিকল্পনা।
ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জেলা প্রশাসক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ওই মৌজায় জমির মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার কানুনগো ও সার্ভেয়ারদের সমন্বয়ে ১৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন জেলা প্রশাসক। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই করে দেখা যায়, অধিগ্রহণ প্রস্তাবিত ও পূর্বে অধিগ্রহণকৃত দাগগুলোর জমির হস্তান্তর মূল্য চরম অস্বাভাবিক।
এছাড়া এটি উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হওয়ায় জনস্বার্থ ও সরকারি অর্থ সাশ্রয়ে অস্বাভাবিক উচ্চ মূল্যে সৃজন করা দলিল ছাড়া ১১৫ নম্বর লক্ষীপুর মৌজার অন্যান্য সাফকবলা দলিল বিবেচনায় নিয়ে ১৯৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অধিগ্রহণের প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়। আর উচ্চমূল্যের সেই দলিলগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রাক্কলন তৈরি করলে সরকারের ৩৫৯ কোটি ১৬ লাখ টাকা ক্ষতি হত। এছাড়া মৌজামূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সাধারণ জনগণ ভূমি হস্তান্তরসহ নানা বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হত।
হাইকোর্টে রিট
এ অবস্থায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের ১৪ অক্টোবরের (মূল্যহার পরীক্ষায় কমিটি গঠন) এবং ৪ নভেম্বরের (১৯৪ কোটা টাকা প্রাক্কলন) স্মারকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সেলিম খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তি হাইকোর্টে পৃথক রিট করেন।
গত বছর করা পৃথক রিটে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইনের ৯ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী প্রাক্কলন নির্ধারণের নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
সেলিম খানের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। অপর রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ৩০ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। পৃথক রিটের (রুল) ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়।
শুনানি শেষে গত ৯ জুন এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন।
জাল নথি ও ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে ভিত্তিহীন রিট করে আদালতের সময় নষ্ট করায় চাঁদপুরের বিতর্কিত ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করেন হাইকোর্ট। অপর দুই রিটকারী আব্দুল কাদের ও জুয়েলকে ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে সেদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানান, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে যেসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে স্থানীয় জেলা প্রশাসন করেছে, তা সঠিক বলে রায়ে এসেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের এই আইনজীবী বলেন, রিট আবেদনকারীরা আদালতে কিছু জাল ডকুমেন্ট দিয়েছেন। এতে আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে রুল খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে সেলিম খানকে ৫০ লাখ টাকা ও অপর দুজনকে ২৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত।