কারাদণ্ডের বিকল্প হিসেবে প্রবেশন ব্যবস্থা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ সাইফুল ইসলাম পলাশ

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির চিঠি, আত্মবিশ্বাস ও মুক্তির গল্প

সাইফুল ইসলাম পলাশ : ৪৬ বছর পর আসামির পুনঃবিচার শুরু হয়েছে। এই ৪৬ বছর তিনি জামিনে ছিলেন না; ছিলেন কনডেম সেলে। কনডেম সেল মানে জানেনতো! এই সেলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারের অন্যান্য কয়েদিদের থেকে আলাদা একটি নির্জন কক্ষে রাখা হয়।

মৃত্যুদণ্ড রায় শোনার পর ৪৬ বছর অর্থাৎ ১৬৩৭৬ দিনের প্রত্যেকটি দিন প্রতিটি মূহুর্ত তিনি মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। আর এই দীর্ঘ সময় কনডেম সেলে থাকার কারণে তিনি গিনেজ রেকর্ড করে ফেলেছেন। এখন ধারণা করা হচ্ছে তিনি প্রকৃত আসামি নন।

অত্যন্ত মর্মান্তিক এই রেকর্ডধারী ব্যক্তির নাম হাকামাদা ইওয়াও। হাকামাদা একজন জাপানি নাগরিক এবং একজন খ্যাতনামা বক্সার। ঘটনার সময় তিনি বক্সিং ছেড়ে একটি সয়াবিন প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিতে যোগ দেন।

ঘটনাটা ১৯৬৬ সালের ৩০ জুন। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। রাত ২:০০ টার সময় তার কোম্পানীর মালিক হাশিমোতোর বাড়িতে আগুন জ্বলছিল। প্রতিবেশীদের আহবানে চারটি ফায়ার ট্রাক এসে আগুন নেভালেন। ঘটনাস্থলটি ঠান্ডা হওয়ার পর সেই বাড়িতে চারটি লাশ পাওয়া যায়। লাশগুলো হাশিমোতো, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের। তাদের শরীরে পেট্রোলের গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল এবং ৪০ বারের বেশি ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। পুলিশ এসে আরো জানলেন হত্যাকারী সেই বাড়ী থেকে ২ লক্ষ ইয়েন লুট করে পালিয়ে যান।

সে সময় প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় বড় হেডলাইন। পুলিশ ঘটনা তদন্তে ৮০ জনের একটি স্পেশাল ফোর্স গঠন করল। সেই দল ঘটনাস্থল থেকে একটি ৫.১” ব্লেডযুক্ত ছুরি খুঁজে পেল। ধারণা করা হল এই ছুরি দিয়েই হত্যাকারী চারজনকে খুন করেছেন। পুলিশ হাকামাদার কক্ষ থেকে একটি রক্তমাখা পায়জামা জব্দ করে। ধারণা করা হল পায়জামায় মিশ্রিত রক্তের গ্রুপ নিহত পিতা-পুত্রের রক্তের গ্রুপের সাথে মিলেছে। সেই পায়জামায় প্রচুর গ্যাস ও তেলের চিহ্ন খুজে পায়। এটিকে পুলিশ প্রমাণ হিসেবে গণ্য করে যে হাকামাদাও অগ্নিসংযোগ করেছে।

ঘটনার ২৯ দিন পর হাকামাদাকে গ্রেফতার করা হয়। মূলত তিনটি কারণে তাকে পুলিশের সন্দেহ হয় এবং গ্রেফতার করা হয়।

প্রথমত, তার alibi (ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে অনুপস্থিতির অজুহাত) ছিল না। তিনি ওই কোম্পানির ডর্ম রুমে একাই বাস করছিলেন এবং তিনি আগুন নেভানোর জন্য প্রতিবেশী ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, তার বাম হাতের মাঝের আঙ্গুল এবং ডান কাঁধে কাটা ছিল। কিন্তু হাকামাদা বলেছিলেন তিনি আগুন নেভানোর সময় ছাদ থেকে পড়ে জখমপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

তৃতীয়ত, তিনি একজন বক্সার ছিলেন। সে সময় জাপানে একটা বক্সার বিরোধী কুসংস্কার ছিল।

এসব কারণে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২৩ দিনের রিমান্ডে নিলেন। আমাদের দেশের সাথে জাপানি ফৌজদারি আইনের পার্থক্য হচ্ছে এখানে পুলিশ একনাগাড়ে ১৫ দিনের অধিক জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন না (সিআরপিসি ১৬৭ ও ৩৪৪ ধারা)। কিন্তু জাপানে একনাগাড়ে ২৩ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন। হাকামাদা টানা ২০ দিন জিজ্ঞাসাবাদের মাথায় তিনি হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করলেন।

হাকামাদা বিচারের সময় সেই দোষ স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেছিলেন। তিনি দাবী করেছিলেন, তাকে চরম নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করে নিয়েছিলেন। কারাগারে থাকাবস্থায় এক চিঠিতে লিখেছিলেন –

“পুলিশ আমাকে এই বলে হুমকি দিয়েছিল যে তারা আমাকে হত্যা করলে তাদের কিছুই হবে না। কারণ তারা তার অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে মর্মে রিপোর্ট করবে। আমাকে উপহাস করা হয়েছিল এবং কাঠের নাইটস্টিক দিয়ে পেটানো হয়েছিল। দিনের পর দিন আমাকে দুই তিন জন শিফটে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কোনো কোনো রাতে রাত ১১ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমাকে পালাক্রমে লাথি মেরেছে। এই ছিল আমার জিজ্ঞাসাবাদ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বীকারোক্তি আদায় করা যে, আমি খুন করেছি এবং অগ্নি সংযোগ করেছি। যদিও আমি এমন কিছু করিনি।”

কোন পরিস্থিতিতে তিনি এই স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় কারাগার থেকে লেখা আরেকটি চিঠিতে। তিনি লিখেছিলেন-

“যখন আপনাকে একই জিনিস বারবার এবং বারবার বলা হয় তখন এটি আপনাকে বিরক্ত করে। এক সময়ে আপনি যখন শারীরিক ব্যথা অনুভব করবেন, তখন আপনি মনে করবেন যে আপনি যা করেন নি তা বললে পরিস্থিতি থেকে পালাতে পারেন। মানুষ কী এমন হয় না!”

২.
১৯৬৬ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর। সেদিন হাকামাদার বিরুদ্ধে শিজুওকা জেলা আদালতে হত্যাসহ দস্যুতা ও অগ্নি সংযোগের অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলার বিচার চলাকালে বিচারের ১৭ তম অধিবেশনে একটি অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে।

প্রসিকিউটরা ঘোষণা দেন, পুলিশ মাত্র ঘটনাস্থলের মিসো ট্যাংক থেকে ০৫ টি পোষাক জব্দ করেছেন। এখন আর পূর্বে উদ্ধারকৃত পায়জামা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এই পোষাকগুলো গুরুত্বপূর্ণ যা হাকামাদা হত্যাকাণ্ডের পর মিসো ট্যাংকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। নতুনভাবে সংযোজিত এই আলামতগুলো মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এতকিছুর পরেও তিনি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে আদালত সত্যকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাকে খালাস দেবে। ১৯৬৭ সালে তার মাকে পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছিলেন-

“অবশ্যই এই মামলার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। মা, প্লিজ তুমি আত্মবিশ্বাসী হও এবং তোমার মাথা উঁচু করে এখানে জেলে আমার সাথে দেখা করতে আসো।”

সে বছর তিনি আরেকটি চিঠিতে লিখেছিলেন-

“আমি নির্দোষ। আমি শান্তভাবে আমার বিচার শেষ করার অপেক্ষা করছি।”

১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮। সেদিন ছিল হাকামাদার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিন। সেদিন বিচারিক আদালতে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। রায় শোনার পর তার আত্নবিশ্বাসে ফাটল ধরে। কিন্তু একেবারে ভেঙে পড়েননি। এরপর হাকামাদা এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রথমে টোকিও হাইকোর্টে আপীল করলে তা নামঞ্জুর হয়। অতঃপর সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে তাও নামঞ্জুর হয়। পরবর্তীতে তিনি পুনঃবিচারের আবেদন করলে তাও সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত নামঞ্জুর হয়। তিনি ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় বারের মত পুনঃবিচারের দরখাস্ত দেন।

৩.
বিচারিক আদালতে এই মামলার বিচারক ছিলেন ০৩ জন। কুমামতো নরিমিচি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। ২০০৭ সালে তিনি একটা বিস্ফোরক তথ্য দিলেন। জানালেন, তিনি মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য রাজি ছিলেন না। যেদিন মামলায় নতুনভাবে আলামত সংযোজন হয়েছে সেদিনই তিনি অনুমান করেছিলেন আসামি নির্দোষ। তিনি প্রথমে ৩৫০ পৃষ্ঠার খালাসের রায়ের খসড়া লিখেছিলেন। কিন্তু অন্য দুজন সিনিয়র বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় লিখতে বাধ্য করেছিলেন। এজন্য তিনি সারাটা জীবন ভীষণ অনুশোচনার মধ্যে ছিলেন।

এই রায় ঘোষণার পর বিচারকের জীবন পাল্টে গিয়েছিল। রায় ঘোষণার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৯। সে সময় সবাই ধারণা করেছিলেন তিনি একদিন সুপ্রীম কোর্টের বিচারক হবেন। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে রায় ঘোষণার মাত্র ছয় মাস পরে তিনি চাকুরি থেকে ইস্তফা দেন।

এরপর শুরু হয় তার যন্ত্রণাদায়ক জীবন। তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। পারকিনসন্স ও ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন অ্যালকোহলিক জীবনেও। এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

কুমোমোটো বারবার বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন তিনি একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিতে সাহায্য করেছিলেন। বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগের পর তিনি চার বার হাকামাদার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেননি। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তিনি আসামীপক্ষের আইনজীবীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন তাকে যেন হাকামাদার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে আপীল আদালতে উপস্থিত হবার প্রস্তাব দেয়। সেই চিঠির উত্তর তিনি পাননি।

৪.
আসামীপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে ছয়টি প্রধান যুক্তি প্রদর্শন করে হাকামাদার খালাস চাইলেন। এগুলো হলো –

প্রথমত: হাকামাদার স্বীকারোক্তি মিথ্যা ছিল। আইনানুসারে শুধু সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত স্বীকারোক্তি গ্রহণযোগ্য। তাছাড়া জাপান সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোন ব্যক্তিকে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না যদি তা বাধ্যবাধকতা, নির্যাতন বা হুমকির মাধ্যমে হয় বা গ্রেপ্তার বা ডিটেনশনের দীর্ঘদিন পর করা হয়। শুধুমাত্র নিজের স্বীকারোক্তি দ্বারা কাউকে বাধ্য করা যাবে না।

প্রসঙ্গক্রমে বলি, জাপানের দোষ স্বীকারোক্তি বিষয়ে সেখানকার সমাজবিজ্ঞানের এক অধ্যাপক ডেভিড জনসন মনে করেন, দীর্ঘকাল ধরে দোষ স্বীকারোক্তি জাপানি ফৌজদারী বিচারের মূল ভিত্তি। এখানে স্বীকারোক্তিকে বলা হয় ‘প্রমাণের রাজা (King of evidence) এবং ‘প্রমাণ নির্ধারক উপাদান’ যা প্রত্যেক প্রসিকিউটর দ্বারা চাওয়া হয়। এমনকি বেশীরভাগ বিচারক দ্বারা তা প্রত্যাশিত। আর এই প্রত্যাশার কারণে স্বীকারোক্তিগুলো প্রায়ই দীর্ঘ, নিবিড় এবং কখনও কখনও জবরদস্তিমূলক হয়।

বেশীরভাগ গণতান্ত্রিক দেশে ২০০ ঘন্টার বেশী জিজ্ঞাসাবাদের পরে প্রাপ্ত একটি স্বীকারোক্তি অনৈচ্ছিক, অবিশ্বস্ত এবং প্রমাণ হিসেবে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়। এই মামলায় হাকামাদাকে ২৩ দিনে প্রায় ২৬৫ ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত: ফ্যাক্টরি ট্যাংক থেকে জব্দকৃত রক্তমাখা কাপড়ের সাথে আসামের কোন সংযোগ ছিল না। প্যান্টের সাইজ ছোট ছিল। প্রথমে প্রসিকিউশনের ধারণা ছিল ট্যাংকে ভেজানো ছিল বলে সাইজ ছোট ছিল এবং প্যান্টে লেখা B মানে Big সাইজ। কিন্তু পরে দেখা গেছে B মানে Black;

তৃতীয়ত: একজন আসামির দ্বারা চারজন ব্যক্তিকে ৪০ টির বেশী জখম করা হলে প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনতে পেত;

চতুর্থত: হত্যার একমাত্র অস্ত্র ছোট্ট ছুরিটি ভিকটিমদের শরীরে অতটা গভীর জখম সৃষ্টি করতে পারেনি;

পঞ্চমত: যে রাস্তা দিয়ে হাকামাদা প্রবেশ করেছিল মর্মে দাবি করা হয়েছিল তা বাস্তবে তালাবদ্ধ এবং দুর্গম ছিল;

ষষ্ঠত: এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আসামীর কোন মোটিভ ছিল না। প্রসিকিউশন টাকা লুট করাকে আসামীর উদ্দেশ্য হিসেবে দাবী করলেও সেখানে থাকা ৩,৭৪০,০০০ ইয়েন, চেক বই, স্টক সার্টিফিকেট এবং দামি গয়না নেওয়া হয়নি।

৫.
হাকামাদা কনডেম সেলে থাকাবস্থায় ২০১১ সালে নিজের ৭৫ তম জন্মবার্ষিকীতে বিশ্ব রেকর্ড করে ফেললেন। এই রেকর্ড সুখকর নয়, বরং মর্মান্তিক। তিনি দীর্ঘ সময় যাবৎ কনডেম সেলে থাকার গিনেজ রেকর্ড করেছেন। কনডেম সেলের দিনগুলো কেমন ছিল তা তার বিভিন্ন চিঠিতে ফুটে উঠেছে। আমি সেগুলো চিঠির বর্ণনা দেব না। প্রসঙ্গক্রমে আরেকজন কনডেম সেলে থাকা কয়েদীর অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।

এই ভদ্রলোকের নাম সাকাই মেন্ডে। তিনি ১৯৪৯ সালে একটি ডাবল মার্ডার কেসে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। কিন্তু ৩৪ বছর কনডেম সেলে থাকার পর পুনঃবিচারে মাধ্যমে খালাস পেয়েছিলেন। এই মামলাতে তার দোষ স্বীকারোক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জাপান সরকার তাকে প্রতিদিনের জন্য ৭০০০ ইয়েন করে মোট ৯০ মিলিয়ন ইয়েন ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে –

“সকাল ৮:০০ টা থেকে ৮:৩০ টা সময়টা ছিল সবচেয়ে জটিল সময়। কারণ এই সময়টাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যাপারে অবহিত করা হয়। এ সময় আপনি সবচেয়ে ভয়ানক উদ্বেগ অনুভব শুরু করবেন। কারণ আপনি জানেন না কারারক্ষীরা কখন আপনার সেলের সামনে এসে থেমে যাচ্ছে। এই অনুভূতিটা কতটা ভয়ংকর তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। আমি তখন আমার মেরুদন্ডের নীচে কাঁপুনি অনুভব করতাম। এটা একেবারেই অসহনীয় ছিল।”

এমন ভাবেই প্রতিটা দিন কাটে কনডেম সেলে। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সাথে সাথে তা কার্যকর হয় না। মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু রায় ঘোষণার পরপরই তাকে কনডেম সেলে থাকতে হয়।

৬.
পুনঃবিচারের আবেদনের পর হাকামাদার মামলায় জব্দকৃত পোষাকগুলোর DNA Test করা হলো। পরীক্ষায় দেখা গেল সেই হত্যাকাণ্ডের ঘাতকের পোষাকে যার DNA আছে তা হাকামাদার নয়। এরূপ প্রেক্ষাপটে ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ মামলাটির পুনঃবিচারের আবেদন মঞ্জুর করা হলো এবং তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপরেও প্রসিকিউশন উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যায়। কিন্তু সর্বশেষ ২০২০ সালে সুপ্রীম কোর্ট পুনঃবিচারের আদেশ বহাল রাখেন।

DNA Test এর মাধ্যমে কনডেম সেল থেকে মুক্তির ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশী পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার ইনোসেন্ট প্রকল্পের তথ্যানুসারে ১৯৮৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৩৭৫ জন ব্যক্তি DNA Test এর মাধ্যমে মুক্তি পেয়েছে। অন্যভাবে বলা যায় ৩৭৫ জন ভুল ব্যক্তিকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২১ জন ছিলেন যারা কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন এবং তারা গড়ে ১৪ বছর করে কারাগারে ছিলেন। আমরা এরূপ বিচারকে বলি মিসক্যারেইজ অব জাস্টিস।

বর্তমান বিশ্বের ১৪২ টি দেশে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড না থাকলেও আমি এটাকে সমর্থন করি। উপযুক্ত ক্ষেত্রে অপরাধীকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু এই দণ্ড প্রদানে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এই দণ্ড হতে হবে সুস্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে এবং কোনভাবেই যেন এগুলোর বিকল্প ব্যাখ্যার সুযোগ না থাকে।

এখন হাকামাদার বয়স ৮৬ বছর। বর্তমানে তিনি জাপানের ছোট্ট শহর হামামাতসুতে বোনের সাথে থাকেন। কিন্তু এই বয়সেও তিনি যেকোনো আবহাওয়ায় প্রতিদিন ৫/৬ ঘন্টা করে হাঁটেন। একজন ভলান্টিয়ার তাকে অনুসরণ করেন যেন তিনি আঘাত না পান, যেন তিনি পথ হারিয়ে না ফেলেন। যে মানুষটি জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় কারাবন্দী ছিলেন, আজ মুক্তির পর মুক্তধারার আলোয় অবিরত হেটে চলা যেন ৪৬ বছর বন্দীত্বের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ।

(বি.দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত এবং একাধিক বিদেশী জার্নাল থেকে অনূদিত)

লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), প্রাবন্ধিক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।