আবারও আলোচনায় উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সাংবিধানিক মামলা। আপিল নিষ্পত্তির সাড়ে চার বছর পর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে করা রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। তাদের আবেদনেই গুরুত্বপূর্ণ এই মামলা এখন আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। সে জন্য ২০ অক্টোবর দিন ধার্য করা হয়েছে। ঐ দিন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চের কার্যতালিকায় মামলাটি শুনানির জন্য অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এদিকে সূত্র জানিয়েছে, ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির পরই উচ্চ আদালতের তিন বিচারপতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দুর্নীতি ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ ওঠায় তিন বছর আগে তাদের বিচারকাজ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হককে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে দেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের দায়িত্ব পালনকালে রিভিউ পিটিশনের শুনানি না হওয়ায় এই তিন বিচারপতির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে আনা হয় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী। বিলটি পাশের পর ঐ বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়।
ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ৯ আইনজীবীর রিট
জাতীয় সংসদ কতৃর্ক বিচারপতি অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঐ বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। ২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সরকারের আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। আপিল বিভাগের ঐ রায়ের ফলে সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে যায়। এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ঐ বছরের ২৪ ডিসেম্বর রিভিউ পিটিশন দায়ের করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সম্প্রতি ঐ রিভিউ পিটিশন শুনানির দিন ধার্যের জন্য আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালতে আবেদন করেন অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এটা একটা সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ মামলা। শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করছি।’
আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম রিভিউ পিটিশনটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। ২০ অক্টোবর মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
রায়দানকারী বেঞ্চের পাঁচ বিচারপতি অবসরে
ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের রায়দানকারী বেঞ্চের সাত বিচারপতির মধ্যে পাঁচ জন বিচারপতি ইতিমধ্যে অবসরে গেছেন। কর্মরত আছেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. ইমান আলী। আর পদত্যাগ করে অবসরে যান সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ও আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞা। স্বাভাবিক অবসরে যান বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
পরবর্তীকালে আপিল বিভাগে আরো বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। ঐ নিয়োগের ফলে আপিল বিভাগে বর্তমানে সাত জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ছয় জন বিচারপতি। দীর্ঘ ছুটিতে রয়েছেন বিচারপতি মো. ইমান আলী। তাকে ডিঙিয়ে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করায় তিনি ছুটিতে যান।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু ছয় জন বিচারপতি কর্মরত রয়েছেন, সেহেতু তাদের নিয়েই প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে সাংবিধানিক এই মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে।
প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধান অনুসারে সংসদের দুটি কক্ষে অনুমোদনের পরই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে ইমপিচ করা সম্ভব। তবে অপসারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন রাষ্ট্রপতি। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইমপিচমেন্ট ছাড়া কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করা যায় না। অপসারণের অভিযোগটি প্রথমে প্রতিনিধিসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদিত হওয়ার পর সিনেটে পাঠাতে হয়। এরপর সিনেটে উত্থাপিত সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের ভোটে অভিযুক্ত বিচারপতি দোষী প্রমাণিত হলে তাকে অপসারণ করা হয়।
সূত্র : ইত্তেফাক