মোঃ আরিফ হুসাইন : মাদক নিয়ন্ত্রণে ২০১৮ সালে প্রণয়ন হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং এ-বছরটি ছিল মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বছর। তখন পত্রিকার হাতে নিলেই দেখা যেত শত শত মাদক বিরোধী গ্রেপ্তারের খবর। আদালত আর কারাগারগুলোতে ছিল মাদক অপরাধীদের উপচে পড়া ভিড়। ঠিক সেই কঠিন সময়ে রাজশাহীর তৎকালীন বিজ্ঞ চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একজন মাদকসেবী কলেজ শিক্ষার্থীর অপরাধ প্রমাণিত এবং দণ্ডিত হওয়ার পরেও ছেলেটিকে কারাদন্ড না দিয়ে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দেন।
সেই খবরে অনেকের মনে লেগেছিল খটকা, এটিকে ভেবেছিল আইন বহির্ভূত ও অনাচার। কারণ অপরাধী অপরাধ করলে কারাগারে থাকবে এমনটাই আমরা জেনে এসেছি। কিন্তু তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলেও কারাগারে না গিয়ে নিজ বাড়িতে থেকেই সংশোধনের সুযোগ পাবে, সমাজের নিজ পরিমণ্ডলে তার মুক্ত জীবন-জীবিকা অব্যাহত থাকবে—এটা কী করে সম্ভব…!
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এরূপ আদেশ আমাদের দেশে আইন সিদ্ধ অর্থাৎ আইন সমর্থিত যাকে আইনের ভাষায় বলা হয় ❝প্রবেশন❞
জানা যায়, প্রবেশনের প্রথম বিকাশ ঘটেছিল আমেরিকায়। জন অগাস্টাসকে বলা হয় প্রবেশনের জনক। তিনি বোস্টনের একজন জুতার কারিগর ছিলেন। ১৮৪১ সালে বোস্টন পুলিশ কোর্টের একজন বিচারককে তিনি আসামির পুনর্বাসনের বিষয়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সর্বপ্রথম তিনি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত মাতালকে তার হেফাজতে নিয়েছিলেন এবং নিজ তত্ত্বাবধানে তাকে সংশোধিত করে গড়ে তুলেছিলেন।
এই মানুষটি মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় দুই সহস্রাধিক মানুষকে সংশোধিত হতে সাহায্য করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৮৭৮ সালে বোস্টনের মেয়র একজন সাবেক পুলিশ অফিসারকে প্রথম অফিশিয়াল প্রবেশন কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেন।
সম্প্রতি আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ আপিল বিভাগ ❝নুর মোহাম্মদ বনাম সরকার এবং অন্যান্য❞ মামলার রায়ে মন্তব্য করেন, ❝আমরা দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ বিচারকগণ ও আপিল আদালতের বিজ্ঞ বিচারকগণ সম্পূর্ণরূপে ভুলেই যাচ্ছেন যে, আমাদের দেশে ❝দি প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০❞ নামে একটি আইন আছে।❞
বলতে দ্বিধা নেই, অনেকে বোধহয় এটিও ভুলে গেছেন, আসামিকে জেলে পাঠানোটাই ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং তার সংশোধন-ই হলো মুখ্য উদ্দেশ্য। আসামীকে জেলে পাঠানো হয় মূলত সেই উদ্দেশ্য পূরণকল্পে এবং তার নিরাপত্তার জন্য। এজন্য কারাগারের ফটকে বড় করে লেখা থাকে ❝রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ।❞
প্রবেশনের সংজ্ঞা আমরা এভাবে দিতে পারি যে, ❝দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জেলে না পাঠিয়ে অর্থাৎ কারাদন্ড না দিয়ে একজন প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কিছু শর্ত আরোপ করে পরিবারের সঙ্গে থাকতে দেওয়ার ব্যবস্থাপনা করে দেয়াই প্রবেশন। মৌলিকভাবে প্রবেশনের উদ্দেশ্যই হলো অপরাধ প্রতিরোধ, আসামির পুনর্বাসন, সংশোধন এবং তাকে সমাজের মূলধারায় ধরে রাখা বা ফিরিয়ে আনা।❞
প্রাথমিকভাবে প্রবেশন আইন প্রণয়নের পূর্বে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬২ ধারা অনুযায়ী প্রবেশন আদেশ দেওয়া যেত। দণ্ডবিধিতে বর্ণিত প্রথমবারের মতো চুরিসহ অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড সংবলিত যে কোনো অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামির জন্য এটি প্রযোজ্য ছিল। সেক্ষেত্রে প্রবেশনের পূর্বশর্ত ছিল আসামির গুড বিহেভিয়ার অর্থাৎ ভালো আচরণ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮০ ও ৫৬২-৫৬৪ ধারায় এ সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত ছিল।
পরবর্তীতে ১৯৩১ সালে ‘সর্বভারতীয় প্রবেশন বিলের’ খসড়া প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু খসড়া বিল পাশের বিলম্বের কারণে প্রদেশগুলোকে প্রবেশন আইন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। প্রাদেশিক সরকারগুলো সে অনুযায়ী প্রবেশন আইন প্রণয়ন করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৮ সালে ভারতে ‘প্রবেশন অব অফেন্ডারস অ্যাক্ট’ পাশ হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলে বর্তমান ‘প্রবেশন অব অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’ প্রণীত হয়। ১৯৭১ সালে একটি বিধিমালাও প্রণীত হয়।
এই অধ্যাদেশটির ধারা ৫ অনুযায়ী, আদালত-
→ মহিলা আসামির ক্ষেত্রে দণ্ডবিধিতে উল্লিখিত মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ ব্যতীত সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন আদেশ দিতে পারেন।
→ অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য অপরাধসহ অন্যান্য কতিপয় অপরাধ ব্যতীত সব অপরাধের ক্ষেত্রে প্রবেশন আদেশ দিতে পারেন।
এমনকি বিশেষ আইনের অপরাধের ক্ষেত্রেও প্রবেশন আদেশ দেওয়া যায়। আইন অনুযায়ী, আদালত কোনো অপরাধীকে এক বছর থেকে অনধিক তিন বছর পর্যন্ত প্রবেশনে থাকার আদেশ দিতে পারেন।
সম্প্রতি বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, কারান্তরীণ আসামির সংখ্যা দেশের কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। যার ফলে আসামিদের সংশোধন, নিরাপত্তা বিধান, স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, খাদ্য ও চিকিৎসাসহ সব ধরনের ব্যবস্থাপনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আসামির সংখ্যাধিক্য, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি এবং অন্যান্য অপরাধীদের সাহচর্যের কারণে তাদের ওপর নানা রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ কারণে অনেকেরই জেল থেকে ফিরে আসার পর তাদের অপরাধপ্রবণ মানসিকতা আরো বেড়ে যায়।
প্রবেশনের মূল বিশেষত্ব এখানেই। প্রবেশনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোনো পরিস্থিতির আশঙ্কা থাকে না। আসামি প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। প্রবেশন কর্মকর্তার নজরদারির কারণে সে কোনো অপরাধের সংস্পর্শে যেতে পারে না। পেশা বা কর্মের মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারে বিধায় তার মস্তিষ্কে নেতিবাচক চিন্তার উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। আসামির আয়-উপার্জনের সুযোগ থাকায় পরিবারের সদস্যরাও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে।
কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের উচ্চ আদালত কর্তৃক প্রবেশন আইনের প্রয়োগ একেবারেই অনুল্লেখযোগ্য আর নিম্ন আদালতগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। সময়ে-সময়ে কিছু রায় আসলেও অনেককেই দেখা যায় এ ব্যাপারে না জেনেই বিরূপ মন্তব্য করতে যা বড়ই দুঃখজনক।
আইনজীবী, বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে অসচেতন। তাদের মধ্যে সদিচ্ছার অভাবের পাশাপাশি এ সম্পর্কে অজ্ঞতাও রয়েছে। অনেকে জানেনই না এমন একটি সুন্দর আইনি ব্যবস্থার কথা। অন্যদিকে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত কাঠামো হতাশাজনক।
একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সারা দেশে বর্তমানে মাত্র ৪৪ জন প্রবেশন কর্মকর্তার পদ রয়েছে, যারা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত। কিছু জেলায় প্রবেশন কর্মকর্তাই নেই। যারা আছেন তারাও অনেকটা কর্মহীন। ফলে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব তো রয়েছেই।
তবে আশার বাণী হচ্ছে, ইদানীং নিম্ন আদালত গুলোতেও প্রবেশন আইনের কিঞ্চিৎ প্রয়োগ লক্ষ করা যাচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ কক্সবাজারের বিজ্ঞ আদালত দুই মাদক অপরাধীকে প্রবেশনের আদেশ প্রদান করেন। যদিও এখন পর্যন্ত প্রবেশন কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের কাছাকাছিও নয়, তবুও কিছুটা আশান্বিত হওয়ার ব্যাপার বটে।
ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি সাধন, কারাগারে আসামির সংখ্যা কমানো, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা রোধ এবং আসামির সংশোধন ও পুনর্বাসন অধিকতর কার্যকর ও ফলপ্রসূ করার জন্য সংশোধনমূলক মতবাদের প্রয়োগ হিসাবে প্রবেশন আইনের প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য এবং এ আইনের প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। প্রবেশন একটি অনিবার্য ব্যবস্থা বটে। এজন্য খুব বেশি প্রয়োজন বিচারক ও আইনজীবীদের সক্রিয় ভূমিকা। তাদের আগ্রহ ও সচেতনতা। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রশিক্ষণ এবং এ উদ্দেশ্যে ওয়ার্কশপসহ প্রয়োজনীয় কর্মসূচি।
লেখক : প্রভাষক, গাজীপুর সেন্ট্রাল ল’ কলেজ।