অবসরে যাচ্ছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের তৃতীয় নারী বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। দীর্ঘ ৪১ বছরের বিচারিক জীবনের ইতি টানতে যাচ্ছেন তিনি।
বিচারক হিসেবে বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের শেষ কর্মদিবসে আজ বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১২টায় আপীল বিভাগের এজলাসে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
নিয়ম অনুযায়ী বয়স ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় আগামী ১০ অক্টোবর বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের অবসরে যাওয়ার কথা। সে অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ৯ অক্টোবর তাঁর শেষ কর্ম দিবস। কিন্তু সে সময় কোর্টের অবকাশ থাকায় আজ বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের শেষ কর্মদিবসে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
চার দশকের বিচারিক কর্মজীবন পার করে আপিল বিভাগের বিচারপতি হওয়া স্বপ্নজয়ী ব্যক্তি বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ। এই অবস্থানে আসতে তাঁকে পার হতে হয়েছে নানান প্রতিকূলতা ও বাধাবিপত্তি। ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম পাঠকদের জন্য তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী তুলে ধরা হল।
জন্ম, পরিচয় ও প্রারম্ভিক শিক্ষা
কৃষ্ণা দেবনাথের পিতার নাম দিনেশ চন্দ্র দেবনাথ এবং মাতার নাম বেণু দেবনাথ। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার পুড্ডায় দীনেশ চন্দ্র দেবনাথের গ্রামের বাড়ি। তবে বাবার কর্মস্থল রাজবাড়ী মুনসেফ কোয়ার্টারে ১৯৫৫ সালের ১০ অক্টোবর জন্ম নেন কৃষ্ণা দেবনাথ। তাঁরা দুই ভাই ও তিন বোন।
রাজবাড়ীতে ভাইবোনের সঙ্গে কাটে শৈশব। বাবার বদলির চাকরি হওয়ায় যেতে হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। ১৯৭০ সালে সিলেট গার্লস স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক) পাস করেন তিনি।
বাবাকে দেখে বিচারক হওয়ার স্বপ্ন
পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ সালে সাব–অর্ডিনেট জুডিশিয়ারিতে (অধস্তন আদালত) যোগদান করেন দীনেশ চন্দ্র দেবনাথ। বিচার বিভাগে কর্মরত অবস্থায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিগ্রহের শিকার হন তিনি। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বিচারক হিসেবে কর্মজীবন শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি।
বাবাকে দেখেই বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষ্ণা দেবনাথ। আর এই স্বপ্ন পূরণে সব সময় তাঁর পাশে ছিলেন মা বেনু দেবনাথ। ১৯৬৪ সাল। ঢাকার সদরঘাটের ইস্টবেঙ্গল স্কুলে চর্তুথ শ্রেণিতে পড়ে একটি শিশু। তার বাবা দীনেশ চন্দ্র দেবনাথ তখন ঢাকার আদালতের পঞ্চম সাবজজ। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়েটি বাবার কাছে যেত। এজলাসের পাশে বসে দেখত বাবার বিচার কার্যক্রম। তখন থেকেই তার স্বপ্ন, বড় হয়ে বিচারক হবেন।
লক্ষ্য যেহেতু বিচারক হওয়া, তাই উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মানবিক বিভাগে ভর্তি হন। রংপুর বেগম রোকেয়া কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি জুর (আইনে স্নাতক) ও এম জুর (আইনে স্নাতকোত্তর) পাস করেন।
কর্মজীবন
রাজশাহী জেলা আইন সমিতিতে আইন পেশায় যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন কৃষ্ণা দেবনাথ। বছরখানেক আইন পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৮১ সালের ৮ ডিসেম্বর জুডিশিয়াল সার্ভিসে মুনসেফ (বর্তমান সহকারী জজ) হিসেবে নিয়োগ পান কৃষ্ণা দেবনাথ।
১৯৯২ সালে তৎকালীন সরকারের আমলে সাবজজ থেকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় পরপর তিনবার তাঁকে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। পদোন্নতির তালিকার শীর্ষে ছিল তাঁর নাম। তারপরও পদোন্নতি দেওয়া হয়নি।
চাকরিই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন!
১৯৯২ সালের দুর্বিষহ ওই ঘটনার সময় চাকরিই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন বিচারক কৃষ্ণা দেবনাথ, সত্যি বলতে, সঙ্গে পদত্যাগপত্র রাখতেন। এতে আপত্তি জানিয়ে বরাবরই সাহস জুগিয়ে আসছিলেন তাঁর বাবা।
এছাড়াও এ সময় এগিয়ে আসেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড. কামাল হোসেন ও আইনজীবী এম আমীর–উল ইসলাম। আর পাশে থেকে সাহস জোগান তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক।
তাঁদের পরামর্শে প্রায় প্রতিটি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা রিট করেন। এতে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ‘পরামর্শ’ শব্দটি সরকারের জন্য মানা বাধ্যতামূলক—মর্মে নির্দেশনা চাওয়া হয়।
শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১৯৯৪ সালে রুল দেন। রুল নিষ্পত্তির আগেই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের হস্তক্ষেপে ওই বছরই কৃষ্ণা দেবনাথকে অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান তিনি।
অধস্তন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালতে
বিভিন্ন জেলায় জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পান কৃষ্ণা দেবনাথ। তিনিই ঢাকা জেলার প্রথম নারী জেলা জজ। এছাড়া তিনি বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রথম নারী বিচারকও বটে।
এই দায়িত্ব পালনকালে ২০১০ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল তাঁর নিয়োগ স্থায়ী হয়। হাইকোর্ট বিভাগে নিয়োগ পাওয়া ষষ্ঠ নারী বিচারক তিনি। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন কৃষ্ণা দেবনাথ। আপিল বিভাগের তিনি তৃতীয় নারী বিচারপতি।
পরিবারকে পাশে পেয়েছেন সর্বদা
তাঁর বাবা বলতেন, তিনি মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখতে পান। তবে এই ভবিষ্যৎ যে এত দূর পর্যন্ত (আপিল বিভাগের বিচারপতি হওয়া) বিস্তৃত ছিল, তা কেউ কেউ হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি। দীনেশ চন্দ্র দেবনাথ (মৃত্যু ২০০০) মেয়ে কৃষ্ণা দেবনাথকে জেলা জজ হিসেবে এবং মা বেনু দেবনাথ (মৃত্যু ২০১৭) হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে দেখে গেছেন। বেঁচে থাকলে আজ সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন তাঁরা।
রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী স্বপন দত্তের সঙ্গে ১৯৮১ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন কৃষ্ণা দেবনাথ। বিয়ের আগে মায়ের উৎসাহ ও প্রেরণা পেয়েছেন, বিয়ের পর সেই দলে যুক্ত হলেন স্বামী। স্ত্রীর বদলির চাকরি। এক বছর এই জেলায়, তো পরের বছর অন্য জেলায়। কিন্তু এতে বিরক্ত হননি, বরং স্ত্রীকে দায়িত্ব পালনে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন তিনি।
একসময় এই দম্পতির ঘর আলো করে আসে দুই কন্যাসন্তান—আনন্দী কল্যাণ ও ইন্দিরা কল্যাণ। তাদের পড়াশোনা, দেখভাল—বেশির ভাগটাই সামাল দিয়েছেন কৃষ্ণা দেবনাথের স্বামী এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। মেয়েরাও একপর্যায়ে বুঝে গেছেন তাঁদের মায়ের কাজের ধরন। স্ত্রীর এই অর্জনে স্বভাবতই অনেক খুশি ও গর্বিত স্বপন দত্ত। দুই মেয়েই শিক্ষকতা করছেন। বড় মেয়ে ড. আনন্দী কল্যাণ ও ছোট মেয়ে ড. ইন্দিরা কল্যাণ এবং তাঁদের স্বামীরা আমেরিকার পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
ধৈর্য, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ
বদলির চাকরি নারীদের জন্য বেশি চ্যালেঞ্জিং। বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের ক্ষেত্রে পরিবার ও কর্মক্ষেত্র সমান গুরুত্ব পেয়েছে। যখন তিনি মেহেরপুরের জেলা জজ, তখন তাঁর ছোট মেয়েটি অনেক ছোট। তবে ধৈর্য, সততা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা তাঁকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশ মহিলা জজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ জুনিয়র বিচারকদের জন্য সব সময় প্রেরণার উৎস। তাঁর বিশ্বাস ধৈর্য, সততা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।