সরকারি চাকরি আইনে কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির বিধান অন্তর্ভুক্তি আর কিছুই নয়, এটা মুষ্টিমেয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বিধান করা, যা রাষ্ট্রের উৎসাহিত করা উচিত নয়। কারণ, অতীত ইতিহাস নির্দেশ করে, যেভাবেই বা যে উদ্দেশ্যেই হোক, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর লোকদের দায়মুক্তি দেওয়া জাতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনে না।
সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তারে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি নেওয়া-সংক্রান্ত সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারা বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২৫ আগস্ট এই রায় দেন। ১৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গত ১ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়।
রায়ে বলা হয়, ‘আমাদের দেশে এটি সাধারণ চর্চা যে একটি ফৌজদারি মামলার তদন্ত শেষ হতে দীর্ঘ সময় লাগে, এমনকি সম্পূর্ণ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়। তাই যদি ওই বিধান যে স্থানে যেভাবে আছে, সেভাবে বহাল থাকে, তাহলে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা হলে সেগুলোর তদন্ত শেষ হবে না।’
সরকারি চাকরি আইনের ৩ ধারায় ‘আইনের প্রাধান্য’ বিষয়ে বলা আছে। এই ধারা উল্লেখ করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, এই বিধানের মাধ্যমে আইনটিকে দেশের অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যার পরোক্ষ প্রভাব সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হলে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) ফৌজদারি মামলার তদন্তে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংস্থার ওপর পড়বে।
কারণ হিসেবে আদালত উল্লেখ করেন, সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় যখন দুদক বা এ ধরনের সংস্থা তদন্ত করবে, তখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হতে পারে। তখন তাদের সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একই ধরনের অপরাধে জড়িত অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য এমন কোনো বিধান নেই।
হাইকোর্টের রায়ে আরও বলা হয়, সরকারি চাকরিজীবী ছাড়াও দেশের পেশাজীবী সংগঠন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নিজ নিজ কাজ করছেন। যদি তাঁরাও সরকারি চাকরিজীবীদের মতো একই সুবিধা (গ্রেপ্তারে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি) দাবি করেন, তবে যৌক্তিকভাবে তাঁদের দাবি অগ্রাহ্য করা যাবে না। ফলে ফৌজদারি বিচার-প্রশাসনে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হবে। এ ধরনের বৈষম্য দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান অনুমোদন করে না।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের নভেম্বরে সরকারি চাকরি আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে একই বছরের ১ অক্টোবর থেকে আইনটি কার্যকর হয়।
আইনটির ৪১ (১) ধারার ভাষ্য, কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে করা ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে।
ধারাটি সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের পরিপন্থী উল্লেখ করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষে তিন আইনজীবী ২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করেন।
রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪১ (১) ধারাটি বাতিল ও সংবিধানের ২৬,২৭, ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হয়।
সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসমঞ্জস আইন বাতিল, ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও ৩১ অনুচ্ছেদে আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকার বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে। আবেদনটি চেম্বার আদালত হয়ে ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। পাশাপাশি আগামী ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত আবেদনের শুনানি মুলতবি করেন। রাষ্ট্রপক্ষকে এই সময়ের মধ্যে নিয়মিত লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করতে বলা হয়।