রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যাকাণ্ডের মামলার তৃতীয় ধাপের বিচারে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রেখেছেন। রায়ে আদালত বলেছেন, এই হত্যাকাণ্ড ছিল নজিরবিহীন মহাঅপরাধ।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির বেঞ্চ গত এপ্রিল মাসে চার আসামির আপিল খারিজ করে এ রায় দেন। গত সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৬৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এই রায় প্রকাশ করা হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি নিজেই। রায়ে একমত পোষণ করেছেন আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি বোরহান উদ্দিন, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কৃঞ্চা দেবনাথ।
মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনা করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, ড. তাহের হত্যাকাণ্ড ছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতির। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী শিক্ষককে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড ছিল নজিরবিহীন মহাঅপরাধ।
ড. তাহেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র ও তা বাস্তবায়নে খুনিদের নানা লোভ দেখিয়ে হাত করাসহ লাশ গুম করা পর্যন্ত সকল পরিকল্পনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। যিনি অধ্যাপক ড. তাহেরের সহকর্মী ও একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। যা আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
রায়ে ড. তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ রেশমীর সাক্ষ্য তুলে ধরা হয়েছে। সাক্ষ্যে ওই নারী বলেছেন, ‘রাজশাহী আসার আগে আমি আমার স্বামীকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে, মহিউদ্দিনের প্রমোশনের (পদোন্নতির) ব্যাপারে অনিয়ম আছে এবং সে মিটিংয়ে না বলবে। পূর্বেও তার প্রমোশনের ব্যাপারে মিটিং হয়েছে এবং আমার স্বামী বিরোধিতা করেছে। এজন্য আসামি মহিউদ্দিন আমার স্বামীর সঙ্গে খারাপ আচরন করেছে। আমার স্বামী আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময় বলে যে, মহিউদ্দিন তার সঙ্গে বেয়াদবি ও খারাপ আচরণ করেছে। এই একজন শিক্ষক সম্পর্কেই তার সাথে খারাপ আচরণ করার কথা আমি শুনেছি। এই কারণে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার স্বামী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মহিউদ্দিন। তিনবছর পূর্বে মহিউদ্দিন আমার স্বামীকে তিন তলা থেকে ছুড়ে ফেলে দিবে বলেছিল। যা আমার স্বামী আমাকে জানিয়েছিলো।’
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের এই সাক্ষীর জবানবন্দির অংশ বিশেষ তুলে ধরে রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, অধ্যাপক ড. তাহের জীবিত থাকলে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার আশা একেবারেই শূন্য বলে অনুমান করেছিলেন ড. মহিউদ্দিন। এ কারণে কম্পিউটার, চাকরি ও নানা আর্থিক সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ড. তাহেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে খুনিদের হাত করেন মহিউদ্দিন। পরবর্তীকালে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ড. তাহের যাতে পদোন্নতির পথে বাধা না হন সেই পথ পরিষ্কার করতেই ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, ফৌজদারি মামলার বিচারের সময় একজন বিচারক সবসময়ই লক্ষ্য রাখবেন যেন কোন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পান। তবে একজন প্রকৃত অপরাধীও যেন বিচারের উপযুক্ত শাস্তি থেকে রেহাই না পান। মামলার বিষয় ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য বিবেচনায় নিয়ে আমাদের মত এই যে, মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে বিচারিক আদালত কোন ভুল করেনি।
খুনি জাহাঙ্গীর জবানবন্দিতে বলেন, “২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি মহিউদ্দিন স্যারের সঙ্গে দেখা। তাহের স্যার কবে ঢাকা থেকে আসবে-এ কথা জিজ্ঞাসা করে। আমি বলি, স্যার আজ ঢাকায় গেছেন। আসবেন ৩ তারিখ। তখন মহিউদ্দিন স্যার বলে যে, তাহের স্যার ফিরে আসলে তাকে হত্যা করতে হবে। আমি বলি, আপনি লোকজন দিবেন। কাজ হবে। …..মহিউদ্দিন স্যার বলেন, তাহের আসলে গুলি করে হত্যা করতে হবে। তখন শিবিরের সভাপতি সালেহীন বলে, গুলি করলে শব্দ হতে পারে। আমি বলি, তাহলে অন্য কিছু করা হোক। মহিউদ্দিন স্যার বললেন, ঘাড়ের পেছনে আঘাত করলে সেন্সলেস হয়ে যায়। স্যারের ঘাড়ের পেছনে আঘাত করতে হবে। তারপর নাকে বালিশ চাপা দিতে হবে। পহেলা ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন স্যার বলেন, তাহের স্যার ঢাকা থেকে এসেছে। আজকেই তাকে খুন করতে হবে। এই কথা বলার পর আমার হাতে এটা রিভলবার দেয় এবং বলে তুমি যাও আমরা আসছি। ….রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমি কলিং বেল বাজাই। কলিং বেল না বাজায় স্যার স্যার করে ডাকতে থাকলে স্যার এসে দরজা খুলে দেয়। ওই সময় বিদ্যুৎ ছিলো না। স্যার বাসার দোতালায় চলে যায়। পরে মহিউদ্দিন স্যার, সালাম, নাজমুল আর সালেহীন এসে দরজা নক করে। দরজা খুলে দিলে তার ঘরে প্রবেশ করে। ২/১ মিনিট পর আমি দোতালায় উঠে যাই। দেখি তাহের স্যার টিভির সামনে দাড়িয়ে। আমি বলি স্যার টিউব লাইট কেটে গেছে। তখন স্যার সামনে ঘুরছে। অমনি আমি পেছন থেকে ঘাড়ের ওপর রিভলবারের বাট দিয়ে আঘাত করি। ইতিমধ্যে মহিউদ্দিন স্যারসহ ওরা ৪ জন উপরে উঠে এসেছে। স্যার আঘাত পেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মহিউদ্দিন স্যার বলে, তাড়াতাড়ি ধরে নিচে নামাও। আমরা ধরাধরি করে নিচে নামিয়ে আনি। যে ঘরে আমি থাকতাম সেই ঘরের কার্পেটের উপর চিৎ করে শোয়াই। আমি ও সালেহীন স্যারের নাকের ওপর বালিশ চাপা দেই। স্যার তখন হাত-পা নাড়তে থাকে। মহিউদ্দিন স্যার বলে জোরে করে চেপে ধর। ডিপার্টমেন্টে বড়াই করে। উচিৎ শিক্ষা হবে।….হঠাৎ স্যার ঝটকা মেরে ডান দিকে উল্টে যায়। তখন আমি আগে থেকে লুকিয়ে রাখা ছোরা দিয়ে স্যারের মাথার পেছনে একটা আঘাত করি। আমি আর সালেহীন নাকের ওপর বালিশ চাপা দেই। একটু পরেই স্যারের দম শেষ হয়ে যায়। তখন মহিউদ্দিন স্যার তাহের স্যারের বুকের উপর কান পাতে এবং হাত টিপে দেখে বলে শেষ। পরে লাশ বাড়ির পেছনের হাউজের মুখ খুলে তার মধ্যে রাখা হয়। পরে আমি ও মহিউদ্দিন স্যার এসে নীচের সোফায় বসি। স্যার আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে, “কিছু চিন্তা করিস না’। যা হবার হয়ে গেছে। মুখ খুলিস না। কম্পিউটার আর চাকরি হয়ে যাবে।”
রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, আইনসভা অপরাধগুলিকে পর্যাপ্ত স্পষ্টতার সাথে সংজ্ঞায়িত করে এবং শাস্তির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে। সেই সীমার মধ্যে শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিচারকের বিস্তৃত স্বাধীনতা থাকার বিধান আইনে অনুমোদিত। আর শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণের সময় ভুক্তভোগীর উপর অপরাধের প্রভাবও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ভুক্তভোগীর প্রতি ন্যায় বিচার করা। কারণ অযৌক্তিকভাবে কম সাজা ন্যায় বিচারহীনতার দিকে নিয়ে যায় এবং ফৌজদারি বিচার প্রশাসনের কার্যকারিতা নিয়ে জনগণের আস্থা হ্রাস করে। রায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও তার আত্মীয় ছাত্র শিবিরের কর্মী আব্দুস সালামের সাজাও বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারের ম্যানহোল থেকে অধ্যাপক ড. তাহেরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ মতিহার থানায় হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং দুই জনকে খালাস দেয়।
রায়ে প্রমাণিত হয় যে, ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের পদোন্নতিতে আপত্তি জানানোয় এ হত্যাকাণ্ড। আর এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ড. মহিউদ্দিন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা।
পাশাপাশি ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি নিয়ে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল হাইকোর্ট দুই আসামির ফাঁসি বহাল রাখে। এরা হলেন ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলম। আর মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় জাহাঙ্গীর আলমের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুল আলমের আত্মীয় আব্দুস সালামকে।
অপরদিকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। আর যাবজ্জীবন সাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এতে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিদের মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়। তবে আপিল বিভাগ দুই আসামির সাজা বৃদ্ধির আবেদন খারিজ করে দিয়েছে।