দীপজয় বড়ুয়া : অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তকে সরকারী হেফাজতে বা পুলিশ হেফাজতে বা আদালতের হেফাজতে নেওয়াকে গ্রেফতার বলে। ফৌজদারী কার্যবিধিতে পুলিশ কর্মকর্তাকে পরোয়ানাসহ বা কতিপয় ক্ষেত্রে পরোয়ানা ব্যতীতই কোন লোককে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫ম অধ্যায়ের ৪৬ থেকে ৬৬ পর্যন্ত ধারায় গ্রেফতারের নিয়ম-কানুন বা বিধি পদ্ধতির বিবরণ আছে। সরকারি পাওনা আদায় আইনের ২৯ ও ৩০ ধারায় সার্টিফিকেট দেনাদারের গ্রেফতারের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। আবার দন্ডবিধির ২২৪ ও ২২৫ ধারায় আইনসংগত গ্রেফতারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩ এর ২ দফায় বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত এবং প্রহরায় আটক প্রত্যেক লোককে গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতিরেকে তাকে সেই সময়ের অতিরিক্ত আটক রাখা যাবে না।
কিভাবে গ্রেফতার করতে হয়
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৬ ধারায় কিভাবে গ্রেফতার করতে হয় সেই সংক্রান্ত বিধান করা হয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে- কথা বা কাজের দ্বারা হেফাজতে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ অফিসার অথবা গ্রেফতারকারী অন্য কোন লোক গ্রেফতার করার সময় যাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তার দেহ স্পর্শ বা আটক করবেন।
গ্রেফতারের চেষ্টায় প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিধানে বলা আছে, এই ধরনের লোক যদি বলপূর্বক তাকে গ্রেফতারের চেষ্টায় বাধা দেয় অথবা গ্রেফতার এড়াতে চেষ্টা করে, তাহলে উক্ত পুলিশ অফিসার অথবা অন্য কোন লোক গ্রেফতার কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পন্থা অবলম্বন করতে পারবেন।
তবে এই ধারায় এরূপ কোন অধিকার দেয়া হয় নাই যার ফলে মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড যোগ্য কোন অপরাধের অভিযুক্ত নয় এই ধরনের লোকের মৃত্যু ঘটানো যেতে পারে।
6 DLR 157(WP) Md. Ishaq Vs. The Crown- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ৪৬ ধারার (২) উপধারা অনুসারে গ্রেফতার করার অধিকারী লোক অপরাধীকে গ্রেফতার করতে তার ক্ষমতা অনুসারে সকল উপায় অবলম্বন করতে পারেন এবং এর মধ্যে অন্যান্য লোককে কাজে লাগানোও অন্তর্ভুক্ত।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৫৪, ৫৫, ৫৭ ও ৫৮ ধারায় বিনা পরোয়ানায় পুলিশ কোন লোককে কখন গ্রেফতার করতে পারে তা বর্ণনা করা হয়েছে। একজন অপরাধীকে পুলিশ অফিসার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গ্রেফতার করতে পারেন।
যেসব ক্ষেত্রে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়
ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ৫৪ ধারা মোতাবেক কেউ নিম্নবর্ণিত অপরাধগুলো করলে পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন-
১। কোন আমলযোগ্য অপরাধীকে
২। কারো কাছে ঘর ভাঙ্গার যন্ত্রপাতি পাওয়া গেলে
৩। সরকার কর্তৃক ঘোষিত অপরাধীকে
৪। কারো কাছে চোরাইমাল পাওয়া গেলে
৫। কেউ পুলিশের কাজে বাধা দিলে
৬। সামরিক বাহিনী হতে কেউ পলায়ন করলে
৭। কেউ বিদেশে অপরাধ করে দেশে ফিরে আসলে কিন্তু প্রচলিত আইনে অপরাধ হলে
৮। কোন মুক্তিপ্রাপ্ত কয়েদি এই আইনের ৫৬৫(৩) ধারা লংঘন করলে
৯। পুলিশ অফিসারের নিকট হতে কাউকে গ্রেফতারের জন্য অনুরোধ পত্র পাওয়া গেলে
29 DLR(SC) 256-258 Abdur Rahman Vs. The State- মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, কোন লোক আমলযোগ্য অপরাধে জড়িত থাকলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেফতার করতে পারবে।
বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের আরো কিছু বিধান
থানা এলাকায় কোন ভবঘুরে সন্দেহভাজন ব্যক্তি ঘোরাফেরা করলে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা তার অধস্তন কোন অফিসারকে দিয়ে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করাতে পারেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৭(১) ধারা অনুযায়ী পুলিশ অফিসারের সামনে কেউ আমলের অযোগ্য অপরাধ করলে সেই অপরাধীর নাম ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পর সে যদি তার আসল নাম ঠিকানা না জানায় তাহলে নাম ঠিকানা যাচাই করার জন্য তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়। তবে শর্ত থাকেযে অতি দ্রুত উত্ত ব্যক্তিকে পুলিশ অফিসার থানা অথবা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হাজির করবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৯(১) ধারা জনসাধারনের সামনে কেউ আমলযোগ্য অপরাধ করলে বা কাউকে আমলযোগ্য অপরাধী বলে মনে হলে বা সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোন অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫১ ধারা পুলিশ অফিসারের সামনে কেউ আমলযোগ্য অপরাধ করলে পুলিশ অফিসার সেই অপরাধ নিবারনের জন্য ১৪৯ ধারা মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়েও যদি তা নিবারন করা না যায় সেক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার উক্ত অপরাধ নিবারনের জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৭১ ধারা অনুযায়ী কোন মামলার বাদী বা সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার জন্য আদালত কর্তৃক বরাবর সমন দেওয়ার পরও যদি উক্ত সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিতে না যায় সেক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার উক্ত সাক্ষীকে বিনা পরোয়নায় গ্রেফতার করতে পারেন।
ফৌজদারী কার্যবিধির ৪০১(৩) ধারা কোন জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামীর যে সকল শর্তে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছিল সে সকল শর্ত লংঘন করলে জামিন বাতিল পূর্বক বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়।
থানা এলাকায় কোন ব্যক্তি পুলিশ আইনের ৩৪ ধারা এবং ৩৪-ক ধারার অপরাধ করলে থানার পুলিশ অফিসার উক্ত অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন।
থানা এলাকায় কোন ব্যক্তিকে অস্ত্র নিয়ে সন্দেহভাজনভাবে ভাবে ঘোরা ফেরা করতে দেখলে উক্ত ব্যক্তির অস্ত্রের লাইসেন্স থাকুক বা না থাকুক সেক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার উক্ত অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন।
কোন ব্যক্তি মটরযান আইনের ৩২, ৫১, ১৪৩, ১৪৪, ১৪৫, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮, ১৪৯, ১৫৪, ১৫৬ ধারার অপরাধ করলে উক্ত অপরাধীকে পুলিশ অফিসার বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারেন।
এছাড়াও মাদক আইনের ৩৮ ধারা; মানব পাচার আইনের ২০ ধারা; তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৮০ ধারা; বিস্ফোরক আইনের ১৩ ধারা এবং রেলওয়ে আইনের ১৩১, ১৩২ ধারা অনুযায়ী বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করা যায়।
গ্রেফতারের পর করণীয়
১। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির দেহ তল্লাশী করতে হবে।
২। আসামি মহিলা হলে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৫২ ধারা মোতাবেক কোনো নারী পুলিশ অথবা অপর কোনো মহিলা দ্বারা তার দেহ তল্লাশি করতে হবে।
৩। মহিলা আসামির দেহ তল্লাশি করার সময় তার নিকট হতে চুড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি জিনিসপত্র হেফাজতে নেওয়া যাবে না।
৪। যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ ব্যতীত কোনো প্রকার বেআইনি বা হয়রানিমূলক তল্লাশি করা যাবে না।
৫। দেহ তল্লাশি করে প্রাপ্ত মালামাল হস্তগত করা যাবে না। আইনানুগ হেফাজতে নিতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধনের ৩৩(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের স্থান থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত এর অতিরিক্ত সময় আটক রাখা যাবে না।
সংবিধানের ৩৩(১)অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গ্রেফতারের কারণ জানানো, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার মনোনীত আইনজীবীর সাথে পরামর্শের সুযোগ দান ও আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
সংবিধানের ৩৩(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না।
অভিযোগ সংক্রান্ত সকল কাগজের নকল সরবরাহসহ পুলিশ গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়গণকে গ্রেফতারের কারণ ও স্থান জানাবেন।
গ্রেফতার এবং কারাবাস
১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির ২১ আদেশের ৩৯ বিধিতে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে,
(১) কোন দায়িককেই ডিক্রি জারিতে গ্রেফতার করা যাবে না, যদি না এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না ডিক্রিদার দায়িককে গ্রেফতার করার তারিখ হতে তাকে আদালতে হাজিরের তারিখ অবধি তার খোরাকীর জন্য বিচারক কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ টাকা ডিক্রিদার আদালতে জমা দেয়।
(২) যেহেতু ডিক্রি জারিতে কোন দায়িককে দেওয়ানী কারাগারে সোপর্দ করা হয়, সেক্ষেত্রে আদালত তার খোরাকীর জন্য ৫৭ ধারার অধীনে নির্ধারিত হার অনুসারে যেরকম অধিকারী সেরকম মাসিক ভাতা নির্ধারণ করতে অথবা যেক্ষেত্রে অনুরূপ কোন হার নির্ধারিত না হয়,সেক্ষেত্রে তার শ্রেণীর সূত্রে আদালত উপযুক্ত বিবেচনা করে নির্ধারিত করবে।
(৩) যে পক্ষের আবেদনে দায়িককে গ্রেফতার করা হয়, আদালত কর্তৃক নির্ধারিত মাসিক ভাতা সেইপক্ষ মাসিক পরিশোধের দ্বারা প্রতিমাসের প্রথম দিনের পূর্বে অগ্রিম সরবরাহ করবে।
(৪) দায়িককে দেওয়ানী কারাগারে সোপর্দ করার পূর্বে চলতি মাসের অবশিষ্ট অংশের জন্য আদালতের সঠিক কর্মকর্তা নিকট প্রথম প্রদেয় টাকা প্রদান করতে হবে এবং তৎপরবর্তীকালে প্রদেয়(যদি কোন) টাকা দেওয়ানী কারাগারে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট প্রদান করা হবে।
(৫) দেওয়ানী কারাগারে আটক দায়িকের খোরাকী বাবদ ডিক্রিদারের খরচ মোকদ্দমার খরচ হিসাবে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে যে, ঐ অর্থ ব্যয়ের নিমিত্তে দায়িককে গ্রেফতার বা দেওয়ানী কারাগারে আটক করা যাবে না।
লেখক : আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, আইন শব্দসমূহ- এডভোকেট মোঃ নাসির উদ্দিন, ফৌজদারী কার্যবিধির ভাষ্য- গাজী শামসুর রহমান, উইকিপিডিয়া, ফৌজদারি কার্যবিধি-জহিরুল হক, ফৌজদারী মামলা পরিচালনা পদ্ধতি – বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া।