লক্ষ্মীপুরে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের মামলায় কারাদণ্ডের বদলে এক আইনজীবীকে গরীব ও অসহায়দের পক্ষে দুই বছর মামলা পরিচালনাসহ দুই শর্তে তাঁকে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। দেশে দণ্ডিত আইনজীবী প্রবেশনে মুক্ত হওয়ার এটিই প্রথম ঘটনা।
লক্ষ্মীপুর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক নুশরাত জামান মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) এ রায় দেন।
পাশপাশি একই মামলায় তাঁর সহযোগী এক গ্রামপুলিশ (চৌকিদার) কে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
দণ্ডিতরা হলেন- অ্যাডভোকেট মনছুর আহম্মদ দুলাল এবং গ্রামপুলিশ (চৌকিদার) আনসার উল্যা। দুলাল লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের আইনজীবী ও রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামের আলী আহম্মদ আখনের ছেলে। অপর দণ্ডপ্রাপ্ত আনসার উল্যা একই ইউনিয়নের চৌকিদার ও শিবপুর গ্রামের মৃত নুর মোহাম্মদ ঢালীর ছেলে।
এর আগে ভুয়া মামলার আসামি দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা আত্মসাতের মামলায় মুনছুর আহম্মদ দুলালকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। একই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। পরে আপিল আবেদন ও দুই শর্তে আইনজীবীকে প্রবেশনে মুক্তি দেন আদালত।
আদালতের পেশকার মো. সাইফুদ্দিন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এটি আইনজীবীর প্রথম অপরাধ বিবেচনায় রেখে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন আদালত। কারাদণ্ডাদেশ ও জরিমানা পরবর্তী দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। আর আনসার উল্যা জরিমানার পাঁচ হাজার টাকা পরিশোধ করে মুক্তি পেয়েছেন।
প্রবেশনের শর্ত দুটির বিষয়ে মো. সাইফুদ্দিন বলেন, তিনি দুই বছর গরীব ও অসহায়দের পক্ষে মামলায় লড়বেন। পাশাপাশি কোনো আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে ভুক্তভোগীর হয়ে তাকে মামলায় লড়বে হবে।
জানা গেছে, নুর নবী রায়পুর উপজেলার বামনী ইউনিয়নের বামনী গ্রামের বাসিন্দা ও দুবাই প্রবাসী ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালে দেশে আসেন। একই উপজেলার শিবপুর গ্রামের নুর মোহাম্মদ ঢালীর ছেলে আনসার উল্যার সাথে নুর নবীর পারিবারিক বিরোধ ছিলো। পরে ওই বিরোধ মীমাংসাও হয়।
এদিকে নুর নবী ও তার স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য চলছিল। এটিকে পুঁজি করে মীমাংসার কথা বলে আনসার উল্যা তাকে আইনজীবী দুলালের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে দুলাল ও আনসার উল্যা ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়।
একপর্যায়ে আইনজীবী জানায়, নুর নবীর ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা রয়েছে। এটি শুনে নুর নবী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এর থেকে রেহাই পেতে নুর নবী ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর দুলালকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেয়।
পরে ২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি ওই মামলার একটি অব্যহতি পত্র নুর নবীর বাড়িতে আনসার উল্যা পৌঁছে দেয়। কিন্তু ওই পত্রটি রায়পুর থানার ইনচার্জ বরাবর লেখা ছিল।
এর কিছুদিন পরই আইনজীবী দুলাল জানায়, বারিশাল আদালত থেকে নুর নবীর বিরুদ্ধে ডাকাতি ও হত্যা মামলা লক্ষ্মীপুর আদালতে হস্তান্তর হয়েছে। এ জন্য পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে আইনজীবী। এটি নিস্পত্তির জন্য ২০১৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আইনজীবীকে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা দেয়া হয়।
কিছুদিন পর ফের আইনজীবী ফোন দিয়ে নুর নবীকে জানায় তার (নুরনবী) বিরুদ্ধে চান্দিনা থানা থেকে আরো একটি মামলা এসেছে। এ মামলার নিস্পত্তির জন্য ২০১৮ সালের ৪ মার্চ ফের তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়েছে আইনজীবী।
পরবর্তীতে একটি জমি বন্টনের মামলার রায় করে দিবে বলে আইনজীবী ৫০ হাজার টাকা নেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন মামলার নকল, রায় কিংবা জামিনের কপিও দেখাতে পারেনি আইনজীবী। প্রতারণার মাধ্যমে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টাকা দুলাল ও আনসার উল্যা আত্মসাত করেছে বলে জানিয়েছে নুর নবী।
আদালত সূত্র জানায়, ভুক্তভোগী নুরনবীর অভিযোগের ভিত্তিতে লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানাকে এফআইআর দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন আদালত। পরে ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর সদর থানায় আইনজীবী মনছুর আহমেদ দুলাল ও চৌকিদার আনসার উল্যার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি সদর মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোসলেহ উদ্দিন তদন্ত শেষে দুলাল ও আনসার উল্যার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। শুনানি ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মঙ্গলবার আদালত রায় ঘোষণা করেন।
বাদী নুর নবী বলেন, আদালতে মামলা চলাকালীন আমার পক্ষে কোনো আইনজীবী কাজ করেননি। আমি নিজেই মামলাটি পরিচালনা করেছি।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে দণ্ডপ্রাপ্ত আইনজীবী মনছুর আহমেদ দুলাল সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে গিয়ে এজাহার দেখেন। তাহলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।