এস.এম. আরিফ মন্ডল : মাননীয় বিচারকদের আদালতের কাজ থেকে বিরত থাকার সুযোগ নাই। কারণ অধস্তন আদালতের বিচারকবৃন্দ সরকারের কর্মচারী এবং বিচার বিভাগের প্রতি অনুগত থেকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দেশের কোনো বিখ্যাত আইনবিদ বা বিচারপতির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বা সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা জজের নির্দেশে সেই দিনের আদালতের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার সু্যোগ আছে। সন্তান প্রসবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেমন কাউকে ফিরিয়ে দিতে পারে না, তেমনি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাও যেকোন সময়ে তার দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রদর্শন বা কর্ম বিরতি পালন করতে পারে না। কোনো কারণ ব্যতিরেকে বিচারিক কাজ থেকে বিরত থাকলে তাকে বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।
আইনজীবীদের প্রধান কাজ হলো আদালতের কাজে সহযোগিতা করা। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে বিবাদের তর্কিত বিষয়টি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা যাতে করে বিবাদটির সঠিক সমাধান বিচারক দিতে পারেন। মাঝে মধ্যে দেশের অধস্তন আদালতে বিভিন্ন আইনজীবী সমিতির সাধারণ সভার সিদ্ধান্তে আদালত বর্জন করা হয়। দেশের আইন অঙ্গনে প্রায়ই এমনটি ঘটে থাকে। এটা নতুন কিছু নয়।কারণ অনেক হতে পারে, কিন্তু তা সমীচীন নয়। এটা বিচার বিভাগের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের অন্যতম অন্তরায় হতে পারে।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন আইনজীবী কারো দ্বারা হেনস্তার শিকার হলে প্রসাশনের অসহযোগিতা হেতু সকল আইনজীবী ঐ জেলার আদালত বর্জন বা কর্মবিরতি পালন করতেই পারেন। কোনো বিচারক নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারীর দুর্নীতি-অনিয়ম প্রশ্রয় দিলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে কোন আইনজীবী সমিতি নালিশ দিতে পারেন। এর বিহিত না হলে বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ কর্মবিরতি পালন করতে পারেন কিন্তু দীর্ঘদিন আদালত বর্জন মোটেও কাম্য নয়, আর এভাবে চলতে থাকলে বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদবে।
কোন বিচারক তার অধীনস্থ কর্মচারীদের ঘুষ-দুর্নীতির প্রশয় দিলে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সংশ্লিষ্ট বিচারকের আদালত বর্জন করে থাকেন । অনেক সময় আদালত বর্জনের ঘটনা ঘটে যখন সংশ্লিষ্ট বিচারিক কর্মকর্তা বিদ্যমান আইনের বিধানের যথাযথ প্রয়োগে কঠোরতা দেখান। আপীল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ওবায়দুল হাসান সম্প্রতি একটি আলোচনা সভায় অধস্তন আদালত পরিদর্শনে সংশ্লিষ্ট জেলার বিচারকের সম্পর্কে বিজ্ঞ আইনজীবীদের অভিমত ব্যক্ত করেন – কিছু কিছু জজ সাহেব সম্পর্কে কথা হল খুবই সৎ কিন্তু বদমেজাজী। এ প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি বলেন -“এই যে সততার সাথে বদমেজাজী হওয়ার কোন সম্পর্ক আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না।”
আপেক্ষিকভাবে যে বিচারক অধিক হারে ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দিয়ে জামিন বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ মঞ্জুর করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার আদালত বিজ্ঞ আইনজীবীগণ সাধারণত বর্জন করেন না (!)। ক্ষেত্রবিশেষে জামিন বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ নামন্জুর করাও এক ধরণের ন্যায়বিচার বটে। এর ফলে দেশের বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়।
আদালতের কর্ম পরিবেশ হবে পিন পতন নিরবতা সম্পন্ন। কোর্ট রুমে কি কি সাথে রাখা যাবে আর কি কাজ করা যাবে না তার সুস্পষ্ট বিধান আছে হাইকোর্ট রুলসে। কিন্তু অধস্তন আদালত পরিচালনায় এসকল নিয়ম- কানুন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অনেক বেগ পেতে হয়। বিচারকবৃন্দ যেহেতু সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পারেন না বা তাদের কোন মুখপাত্র থাকে না। যদি কিছু বলার থাকে- নিজেই বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত আদালতের কার্যধারার প্রয়োজনীয় মৌখিক নির্দেশনা দিতে পারেন। মৌখিক আদেশ যখন বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ বা বিচারপ্রার্থী অনুসরণ করেন না তখন বিচারক তাঁদের প্রতি কঠোরতা দেখাতে বাধ্য হন। যা কখনো কখনো রূঢ়তার পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
মামলায় বিজ্ঞ আইনজীবীদের বিনয়ী উপস্থাপনাও অনেক সময় বিচারককে বিচার প্রার্থীদের পক্ষে আদেশ দিতে উৎসাহিত করে। মাননীয় বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, “মক্কেলের পক্ষে কোন ভাল আদেশ পাইতে চাইলে You have to know the Judge এবং বিচারক কি জানতে চাচ্ছেন। বিচারক কোন বিষয়টিকে বেশি প্রধান্য দিচ্ছেন সেই বিষয়টার উওর দিলেই আইনজীবী হিসেবে আপনি মক্কেলের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত আদেশ পেতে পারেন।”
একজন বিচারক কোন বিজ্ঞ আইনজীবীর প্রতি বিরক্ত হতে পারেন বিভিন্ন কারণে। কিছু বিষয় বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ এড়িয়ে যেতে পারলে বিচারিক কর্মকর্তার আদালত ব্যবস্থাপনা সহজ হয়। যেমন- বিচারকার্জ চলাকালীন চায়ের দোকানের আড্ডার মত খোশ গল্প করা থেকে বিরত থাকা। আদালতের কার্যক্রম চলাকালীন মোবাইল ফোনে মক্কেলের সাথে উচ্চ স্বরে কথা না বলা। উন্মুক্ত আদালতে শুনানি কালে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকা। মামলায় দাখিলকৃত দরখাস্তে সঠিকভাবে লিখেননি বা শুনানীকালে এমন ঘটনার বা তথ্যের উপর যুক্তি উপস্থাপন করেন যা দরখাস্তে উল্লেখ্যই নাই এমনটি পরিহার করা।
Justice Delay Justice Denied, মামলার মূল শুনানির সময় অকারণে সময়ের দরখাস্ত দিয়ে মামলাটি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা করা থেকে বিরত থাকা। মামলার কোন পক্ষ একবার অন্তর্বর্তী আদেশ পেয়ে থাকলে বা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও পেশাগত সুনাম প্রতিপক্ষের আইনজীবীর কাছে রক্ষার্থে মামলাটির মূল শুনানির বিভিন্ন পর্যায়ে অগ্রহণযোগ্য কারণে সময়ের দরখাস্ত দাখিল করা থেকে বিরত থাকা। মোদ্দা কথা হচ্ছে- আদালতে কাছে বিজ্ঞ আইনজীবীদের সুনাম যেন ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।
অনেক সময় কিছু অসৎ মোহরারদের পাল্লায় পড়ে বিচারপ্রার্থীগণ অহেতুক পাল্টা দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন। আর এমন সব মামলার নথি সংশ্লিষ্ট বিচারকের নজরে আসলে অথবা কোন পক্ষ মামলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে কোন এক পক্ষের দরখাস্তের ভিত্তিতে কারণ উল্লেখ পূর্বক সংশ্লিষ্ট মামলাটি খারিজ করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে বারের সদস্যগণ যুক্তি সঙ্গত শুনানির সুযোগ পেলে বার ও আদালতের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান রাখা সম্ভব। বিচারপ্রার্থীরা অভিযোগ করে থাকেন -জেলা বারে কিছু আইনজীবীর কথিত সহকারীরাই মামলার আর্জি লিখেন আর বিজ্ঞ আইনজীবী শুধু সহি করেন মাত্র! এমন অবস্থা চলতে থাকলে কোন সংশ্লিষ্ট বারের বিজ্ঞ সিনিয়র আইনজীবীদের আর জুনিয়র আইনজীবীর প্রয়োজন হবে না!
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণেও অন্যান্য সরকারি অফিসের পাশাপাশি আদালত বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। অতীতে রাজনৈতিক ইস্যুতেও আইনজীবীদের আদালত বর্জনের নজির আছে। তবে কোর্ট বর্জনের সংস্কৃতি যাতে বিশেষ ব্যক্তিস্বার্থে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আইনজীবীদের পেশাটি ব্যবসা নয় সেবা- তা ভুলে গেলে চলবে না। আদালত এবং আইনজীবী একটি পাখির দুটি ডানা। বিচারকদের কাজে আইনজীবীদেরকেই সহযোগিতা করতে হবে, তা না হলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সুফল থেকে বিচারপ্রার্থীরা বঞ্চিত হবেন। বিচারক তার বিচারকাজে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
এ প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ তাঁর বিচারিক কর্মজীবনের শেষ দিনের বক্তব্যটি প্রাসঙ্গিক বটে। তিনি বলেন – “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কাগজে কলমে নিরঙ্কুশভাবে বাস্তবায়ন হলেও একজন বিচারক যদি তার মননে, চলনে, বিশ্বাসে নিজেকে স্বাধীন মনে না করেন, তবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদূর পরাহত।”
আবার বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী। কোর্ট চলাকালীন এমন কিছু বলা যাবে না- যা সাধারণ বিচার প্রার্থীদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে আদালত সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি- অনিয়মের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আইনজীবীবৃন্দ আনয়ন করলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত -যথাবিহিত সমাধান করা ।
লেখক : আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।