ফেসবুকে ধর্মীয় উসকানি ছড়ানোর দায়ে রাজশাহীতে দুই যুবককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পৃথক তিনটি ধারায় পাঁচ করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। কারাদণ্ডের পাশাপাশি আলাদা তিনটি ধারার প্রতিটিতে ৫ লাখ টাকা করে ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অর্থদণ্ড অনাদায়ে দুই আসামিকে প্রতি পাঁচ লাখ টাকার জন্য আরও ছয় মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জিয়াউর রহমান গত মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) এই রায় দেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন- ওয়াসিম আল রাজী (৩৩) ও নাসিম আলী (২০)। দণ্ডিতরা দুজনেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসিন্দা। এদের মধ্যে ওয়াসিম আল রাজী নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ফেসবুকে লেখালেখি করতেন। সাংবাদিক পরিচয়ে এলাকায় নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আইনজীবী ইসমত আরা বেগম। আর আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করেন মো. শহীদুল ইসলাম ও মো. লিয়াকত আলী।
মামলা ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ওয়াসিম ও নাসিম হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির নামে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলেন। গত বছরের ১ আগস্ট ওই অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁরা ধর্মীয় উসকানিমূলক লেখা ও ছবি পাঠান। এতে ওই এলাকায় সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা হয়।
এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ওয়াসিম হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই ব্যক্তিকে ব্ল্যাকমেল করে তাঁর কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। তবে ওই ব্যক্তি টাকা দিতে রাজি না হলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওয়াসিম ও নাসিম সাইবার ক্রাইম ইউনিটের পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিকে মুঠোফোনে ভয়ভীতি দেখান।
বিষয়টি জানতে পেরে পুলিশ দুজনকে আটক করে। পরে তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া মুঠোফোনে ভুয়া ফেসবুক আইডির মাধ্যমে উসকানিমূলক ও আপত্তিকর ছবি পাঠানোর প্রমাণ মেলে। এ ঘটনায় তাঁদের বিরুদ্ধে গোদাগাড়ী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয়। পরে শুনানি ও মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আদালত আজ এ রায় ঘোষণা করেন।
আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ইসমত আরা বেগম বলেন, রায় ঘোষণার সময় দুই আসামি আদালতের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। পরে তাঁদের রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রায়ে আদালত বলেছেন, আসামিদের তিনটি ধারার সাজা পর্যায়ক্রমে কার্যকর হবে।
রায়ে আদালত বলেন, এই মামলায় উপস্থাপিত সকল সাক্ষীগনের সাক্ষ্য ও প্রমানাদি এবং পারিপার্শ্বিকতা সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করলে প্রমানিত হয়, আসামী ওয়াসিম ও নাসিম একে অপরের সহায়তায় পরিচয় গোপন করে দোলনের আইডির মত করে ওয়ালপেপার এর স্কিনসট তৈরী করে সেখানে আপত্তিকর মন্তব্য লিখে এবং সাংবাদিকতার নামে খবর প্রকাশ করার হুমকি দিয়ে দোলনকে দোষারোপ করে; যা ছিল ইসলাম ধর্মালম্বিদের জন্য চরম অনুভূতি আঘাত করার মত, যার ফলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সহ আইন শৃংখলা অবনতি হতে পারতো। এ দ্বারা আসামী ওয়াসিম এবং নাসিম এর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর ২৪/২৮/৩১এর ধারার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়।
ইসলামের নামে উন্মত্ততা সমর্থনযোগ্য নয় উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ইসলাম শান্তির ধর্ম। মহানুভবতা, উদারতা ইসলামের সৌন্দর্য। ইসলামে উন্মত্ততা, উগ্রতার কোন সুযোগ নাই। অন্যর ধর্ম কে ছোট করলে নিজের ধর্ম বড় হয় না। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন এর সূরা আল বাকারায় বলছেন, লা ইকরাহা ফিদ্দীন যার বাংলা, ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নাই [সুরা আল বাকারা-২৫৬]। মুসলিমদের সাথে যারা ধর্মের ব্যাপারে যুদ্ধ করে নাই বা দেশ ত্যাগে ব্যধ্য করে নাই তাদের সাথে মহানুভবতা ও ন্যায়বিচার প্রদর্শন করতে মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন [সুরা আল মুমতাহিনা-৮]।
নবী মুহাম্মদ (সাঃ) অমুসলিমদের উপর কোন জুলুম হলে কেয়ামত দিবসে নিজে তাদের হয়ে লড়বেন মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন [আবু দাউদ-২৬২৬]। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) অমুসলিম বলে কারও প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রকাশ করতেন না, সদাচার করতেন। তিনি অমুসলিম প্রতিবেশীকে খাবার পোঁছে দিতেন [আলবানি-আদাবুল মুফরাদ-৯৫]। তিনি মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষকে সম্মান করতেন, এমনকি তাদের মৃহদেহ কেও। একবার তাঁর সামনে দিয়ে একজনের লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে যখন বলা হলো লাশটি একজন ইহুদির তখন তিনি বললেন, সে কী মানুষ নয়? [বুখারি-১২৫০]।
একজনের অপরাধে পুরো জনগোষ্ঠীকে ইসলাম দোষারোপ করে না। বনু সা’লাবার কিছু লোক একজন সাহাবিকে হত্যা করেছিল। রাসূল (সাঃ) এর একজন সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! ঐ যে বনি সা’লাবা, যারা অমুককে হত্যা করেছিল। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন, একজনের অপরাধে অন্যজন অপরাধী হবে না। সম্প্রীতি বিনষ্ট করে অশান্তি, বিদ্বেষ সৃষ্টি ফিতনা আর মহান আল্লাহ ফিতনাকে হত্যার চেয়ে জঘণ্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন [সুরা আল বাকারা-২১৭]। তাহলে আমরা দেখছি ইসলাম অমুসলিমদের প্রতি এমন উন্মাদ্দনা, উন্মত্ততাকে সমর্থন করে না।
আদালত বলেন, ইসলামের নামে যারা এমন সহিংসতা করে তারা ইসলামের পবিত্র নান্দনিক রূপকে ক্ষতিগ্রস্থ করে, দেশ বিদেশে অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে নেগেটিভ ইমেজ তৈরী হয় এবং ইসলামোফোবিয়ার জন্ম নেয়। এ ধরনের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একক ভাবে প্রতিহত করতে পারে না। প্রয়োজন নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। যখন ই অমুসলিমদের প্রতি এমন জুলুম বা অবিচারের পরিস্থিতি তৈরী হয়, অমুসলিমদের রক্ষায় প্রকৃত মুসলিম হিসেবে আলেম ও ইমাম সমাজ, মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সহ সচেতন নাগরিকদের বলিষ্ট ভূমিকা রাখা উচিত।
সংবিধানে নাগরিক হিসেবে একজন অমুসলিমের অধিকার সমুন্নত রাখার বিষয়টি উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। এ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের জন্য এনে দিয়েছে স্বাধীনতা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর পবিত্র সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে নাগরিকত্ব এর বিষয়ে বলা হয়েছে, সেখানে কোন ধর্ম বিশ্বাসের ভিত্তিতে নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য করা হয় নাই।
সংবিধানের ২ক অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবেন মর্মে অঙ্গীকার করেছে। সংবিধানের ১২(ঘ) অনুচ্ছেদে কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে মর্মে রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার অঙ্গীকার করেছে।
সংবিধানের ৪৩ ক) ধারা মতে স্বীয় গৃহে নিরাপত্তালাভ প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খার সর্বোচ্চ দলিল সংবিধান মতে, একক কোন ধর্ম বিশ্বাস নয়-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য বাংলাদেশের সৃষ্টি, আর রাষ্ট্রের প্রতিটি ধূলিকনায় প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার। আর পবিত্র সংবিধান কাউকে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে চিহ্নিতও করে নাই, সবাইকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অধিকার প্রদান করেছে।
সাইবার স্পেসকে নিরাপদ রাখতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দায়বোধের জায়গা রয়েছে উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর মধ্যে আমাদের দেশের মানুষের কাছে ফেসবুক ভীষণ জনপ্রিয়। মানুষে মানুষে যোগাযোগের অনন্য মাধ্যম ফেসবুক। মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে মুহুর্তে এক অপরের সাথে কানেকটেড হতে পারছে, প্রতিনিয়ত দেশবিদেশী নানান খবরাখবর পাচ্ছে এবং নিজেকে আপডেটেড রাখতে পারছে। ফেসবুকে মানুষ তাদের আনন্দ, বেদনা, কষ্ট, ভালোলাগা, মন্দলাগা শেয়ার করছে। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে প্রতিদিন তরুনরা এগিয়ে আসছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরী হচ্ছে, ব্যবসার সুযোগ তৈরী হচ্ছে। কবিতা, গান, ফটোগ্রাফি, সিনেমা সহ নানান ক্ষেত্রে মানুষ নিজেকে সৃষ্টিশীল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষও এখন ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ব্যবহার করছে।
আদালত আরো বলেন, নেপোলিয়নক্যাট এর হিসাব মতে, জানয়ারি ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহার করে ৫ কোটি ২৭ লাখ ১৪ হাজার মানুষ যা আমাদের মোট জনসংখ্যার ৩০.২ শতাংশ। দিন দিন ফেসবুক আরও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে। ব্যবসার সাথে সাথে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের রেসপন্সিবিলিটির জায়গা রয়ে যায়।
রায়ে বলা হয়, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটআপস সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভাল দিকগুলোর সাথে কিছু নেগেটিভিটিও উন্মোচিত হচ্ছে। রামু কক্সবাজার, নাছিরনগর সিলেট, বোরহানউদ্দীন ভোলা সহ অতি সাম্প্রতিতকালে শারদীয় দূর্গাপূজায় কুমিল্লা ও রংপুর এ ফেসবুক কেন্দ্রিক প্রকাশিত ও প্রচারিত কনটেন্টকে কেন্দ্র করে ঘৃনা, বিদ্বেষে রক্ত ঝরেছে, মুহুর্তে আগুনে জ্বলেছে শত শত ঘরবাড়ি, তান্ডবে গৃহহীন হয়েছে বহু মানুষ। কিছু দুষ্ট মানুষের অশুভ কর্মকান্ডে বহু নারীর জীবন দূর্বিসহ হয়েছে, হচ্ছে; তাদের ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও এই মাধ্যমে বিকৃত বা অপমানকর ভাবে প্রচার, প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে আরো বলা হয়, আমাদের সমাজ, মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বোধ ও সংস্কৃতি, পারস্পরিক সম্পর্ক, সামাজিক রীতিনীতি আমাদের মত, উন্নত দেশের মত করে একই নীতিতে মূল্যায়ন বাস্তবসম্মত নয়। তাই আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা বিবেচনায় ফেসবুককে পলিসি নিতে হবে। কোন সাইবার ক্রাইম হলে দায়িত্বশীলতার জায়গা হতেই ফেসবুককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তা একত্রে উন্মোচন, উৎঘাটন, দমন ও শাস্তি আরোপে পরস্পর নিবিড়ভাবে সহযোগিতা কাম্য। ফেসবুকের বহু ভাল দিকের পাশাপাশি এখনো কিছু জায়গা আছে যা আরও সুরক্ষিত ও উন্নত হতে পারে। ব্যবসার পাশাপাশি সাইবার স্পেসকে আরও নিরাপদ রাখতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দায়বোধের জায়গাও রয়ে গেছে।
আদালতের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, সার্বিক বিবেচনায় ১) ফেক আইডি হলো সাইবার অপরাধের সূতিকাগার। একই ব্যক্তি নামে বেনামে একাধিক আইডি খোলার অপসন চালু রাখা সাইবার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই ফেইক আইডি প্রতিরোধে ফেসবুকের পক্ষ হতে কার্যকর ভূমিকা কাম্য। ২) ফেসবুকে পোস্টকৃত কোন নারী ও শিশুর ছবি বা ভিডিও যাতে অনুমতি ছাড়া কেউ ডাউনলোড করতে না পারে এমন সিকিউরিটি থাকতে হবে। নারী ও শিশু এর ছবি বা ভিডিও বিকৃত করে কেউ যেন ফেসবুক বা মেসেঞ্জারে প্রকাশ ও প্রচার না করতে পারে বা অভব্য কমেন্ট বা শেয়ার না করতে পারে সে জন্য অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব (অও) নির্ভর নিরাপত্তা ফিচার জোরদার জরুরি। ৩) কারও ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে এমন কোন কনটেন্ট প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব দ্রুত উৎঘাটন করে প্রয়োজনে সেইরুপ কনটেন্ট প্রকাশ ও প্রচারে বাঁধা এবং তা দ্রুত অন্তর্জাল হতে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
অপরাধ দ্রুত সনাক্ত ও অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় উপস্থাপনের বিষয়ে আদালত বলেন, আমাদের দেশে মাঝেমধ্যেই ফেসবুকে ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক ছবি প্রকাশ হয়েছে মর্মে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে- এমন দাবীতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা হচ্ছে এবং নিরীহ মানুষের জান মালের ক্ষতি সাধন করা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ দ্রুত সনাক্ত ও অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় উপস্থাপন ও যথার্থ সাক্ষ্য প্রমান দিয়ে মামলা প্রমান করে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে
১. শুরুতেই মামলার আই.ও হিসেবে তথ্য প্রযুক্তিতে তুলনামূলক দক্ষ অফিসারকে নিযুক্ত করা প্রয়োজন। তদন্ত কার্যক্রম যেন নিরবিচ্ছিন্ন হয় এবং অযথা বিলম্বিত ও বাঁধাগ্রস্থ না হয় সে জন্য যৌক্তিক প্রয়োজন ব্যতীত আই.ও চেঞ্জ করা সমীচীন নয়। সেই সাথে দ্রুততম সময়ে পুলিশ রিপোর্ট দাখিল করা উচিত।
২. এই ধরনের চাঞ্চল্যকর মামলায় স্মার্ট, প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন একটি টিম এর মাধ্যমে তদন্ত তদারকি হওয়া উচিত যাতে করে তদন্তে Fatal কোন ভুল ত্রুটি না হয়।
৩. সাধারনতঃ এই ধরনের মামলায় সাম্প্রদায়িক Biasness থাকায় সাক্ষীরা কাউকে সম্পৃক্ত করে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য দেয় না। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর মামলায় পূর্বের ন্যায় এনালগ বা প্রচলিত তদন্ত কার্যক্রম সুফল আনবে না। এক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ধরনের মামলায় CCTV Footage, Call List সহ চার্জসিট হওয়া উচিত তথ্য ও প্রযুক্তি ভিত্তিক সাক্ষ্য প্রমানের ভিত্তিতে।
৪. ঘটনার পর পর ই যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে জব্দতালিকা মূলে আলামত জব্দ করা উচিত এবং ডিজিটাল পরীক্ষার আশু ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নইলে বিলম্ব অপরাধীকে প্রমান বিনষ্টের সুযোগ করে দিতে পারে।
৫. মামলা প্রমান হয় সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা। প্রতিটি অপরাধের বিচার হওয়া গুরত্বপূর্ণ কিন্তু যে অপরাধের মাত্রা ও প্রকৃতি মারাত্মক, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাব বেশী – সে ধরনের অপরাধের বিচার হওয়া উচিত আরও দ্রুত। এ ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ মামলায় দ্রুত সাক্ষী উপস্থাপনে প্রতিটি জেলায় পুলিশের একটি সাক্ষী সহায়ক সেল থাকতে পারে।
সাংবাদিকদের সতর্কতার সাথে দায়িত্ব পালনের বিষয়ে আদালত বলেন, সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। এই পেশায় দায়িত্ব কর্তব্য অন্য পেশার চাইতে বেশি সতর্কতার সাথে পালন করা কাম্য। কেননা ভুল বা মিথ্যা সংবাদ এর প্রভাব ও স্থায়িত্ব তুলনামূলক ভাবে বেশি। ১৯৭৪ সালের প্রেস কাউন্সিল এ্যাক্ট এর ১১ এর ‘বি’ ধারা অনুযায়ী প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের জন্য একটি নীতিমালা তৈরী করেছে (২০০২ সালে সর্বশেষ সংশোধিত) যা মিডিয়ার সকল সাংবাদিকদের জন্য প্রযোজ্য।
আদালত আরো বলেন, এই মামলায় আসামী ওয়াসিম নিজেকে সাংবাদিক দাবী করেছে। ডিফেন্স এমন সাজেসন দিয়েছে, সংবাদ প্রকাশ করা নিয়ে আসামীদের জড়িত করা হয়েছে। সাক্ষ্য প্রমানে আমরা দেখছি, আসামীরা ফায়দা নিতে নিজেরাই খবর তৈরী করছে উক্ত আচরণ বিধি এর ৮(খ), ১০, ১৩, ২৩ বিধির সুস্পষ্ট লংঘন।
আদালত বলেন, খুব কম পেশা আছে যেখানে দায়িত্ব পালনের আগে শপথ নিতে হয়। সাংবাদিকদের জন্য প্রেস কাউন্সিল প্রনীত উপরোল্লিখিত নীতিমালার ২৪ বিধির ক পরিশিষ্ট অনুযায়ী প্রত্যেক সাংবাদিক কে শপথ পাঠ ও স্বাক্ষর করতে হয়। সত্যকে বিকৃত না করতে, ব্যক্তিগত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়কে প্রশয় না দিতে এবং পেশাগত নৈতিকতা, সততা ও সম্মানবোধের প্রতি বতী থাকার শপত নিতে হয়। আসামীদ্বয় সাংবাদিকতার সেই শপথ কে অসম্মান করেছে।
রায়ের সাজার অংশে আদালত বলেন, প্রসিকিউসন কেস গ্রহনযোগ্য, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা সুপ্রমানিত মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় বিচার্য বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়, পরস্পর যোগসাজসে আসামী (১) মোঃ ওয়াসিম আল রাজী, (২) মোঃ নাসিম আলী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ২৪/২৮/৩১/৩৫ ধারার অপরাধ করেছেন এবং তার জন্য তারা যোগ্য শাস্তি প্রাপ্য।
অপরাধের ধরণ, মাত্রা, সমাজ ও রাষ্ট্রে এর প্রভাব ইত্যাদি সহ Aggravating এবং Mitigating Circumstances বিবেচনায় আসামী মোঃ ওয়াসিম আল রাজী ও মোঃ নাসিম আলী দ্বয়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৪(২) ধারায় ০৫ (পাঁচ) বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং তৎসহ ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ০৬ (ছয়) মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ২৮(২) ধারায় ০৫ (পাঁচ) বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং তৎসহ ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ০৬ (ছয়) মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর ৩১(২) ধারায় ০৫ (পাঁচ) বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং তৎসহ ৫,০০,০০০/- (পাঁচ লক্ষ) টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে আরও ০৬ (ছয়) মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান সমীচীন মনে করি।
সাজা একটার পর অন্যটা Consecutively কার্যকর হবে। এই মামলার সংশ্রবে আসামীদ্বয় এর হাজতবাস মূল কারাদন্ড হতে বাদ যাবে। সে মর্মে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক। মামলার আলামত রাষ্ট্র বরাবর বাজেয়াপ্ত করা হলো, তা বিধি মোতাবেক নিষ্পত্তি করা হোক।