মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
তের লক্ষ ইয়াবা টেবলেট পাচারের দায়ে এক রোহিঙ্গা সহ কক্সবাজারে ৪ জন আসামীকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একইসাথে প্রত্যেককে ৫০ হাজার করে অর্থদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বুধবার (১৬ নভেম্বর) এ রায় ঘোষণা করেন।
মামলায় মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতরা হলো : কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প-১৩ এর ব্লক-এইস-১৬ এর মোঃ বশির আহমদ ও আয়েশা খাতুনের পুত্র মোঃ আয়াজ (৩৪), কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পাওয়ার হাউজ দক্ষিণ হাজীপাড়ার মৃত আবদুল মজিদ ও মোছা: মোস্তফা খাতুনের পুত্র আবুল কালাম (৩৭), খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ির পঞ্চরাম পাড়ার মকবুল আহমদ ও সোনা মেহেরের পুত্র আজিমুল্লাহ (৪৩) এবং একই এলাকার ফয়জুল হক ও ছেহেরা খাতুনের পুত্র আবুল কালাম (৩৭)।
রায় ঘোষণার সময় দন্ডিতরা সকলে আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস.এম আববাস উদ্দিন এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন একই আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম ফরিদ।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
২০২০ সালের ২৩ আগস্ট রাত ৭ টা ৫ মিনিটের দিকে র্যাব-১৫ এর একটি টিম এক অভিযান চালিয়ে কক্সবাজার শহরের মাঝির ঘাটে খুরুস্কুল ব্রীজের উত্তর পাশে, রাস্তার পশ্চিম পাশে একটি ফিশিং বোট আটক করে। একইসাথে ফিশিং বোটে থাকা মো: আয়াজ ও মো: বিল্লালকে গ্রেফতার করে। তখন র্যাব সদস্যদের উপস্থিতি টের পেয়ে আরো ৪/৫ জন লোক দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরে ফিশিং বোট তল্লাশি করে ১৩ লক্ষ ইয়াবা টেবলেট, ১০ হাজার ৯ শত নগদ টাকা উদ্ধার এবং ফিশিং বোটটি জব্দ করা হয়।
এ ঘটনায় র্যাব-১৫ এর নায়েব সুবেদার মোঃ হারুনর রশীদ বাদী হয়ে উল্লেখিত ২ জন সহ অজ্ঞাত আরো ৪/৫ জনকে আসামী করে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) সারণির ১০(গ)/৩৮/৪১ ধারায় কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার কক্সবাজার সদর থানা মামলা নম্বর : ৪২/২০২০ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ৬৭৪/২০২০ ইংরেজি (সদর) এবং এসটি মামলা নম্বর : ১৩৫৬/২০২১ ইংরেজি।
বিচার ও রায় :
মামলার ঘটনাস্থল থেকে ধৃত আসামী মো: আয়াজ ও মো: বিল্লাল তাদের দোষ স্বীকার করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দী প্রদান করে। তারা জবানবন্দিতে তাদের ‘গডফাদার’ ইয়াবা পাচারের মূল হোতা পলাতক আসামী আজিমুল্লাহ ও আবুল কালাম এর নাম ঠিকানা প্রকাশ করে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও র্যাব-১৫ এর এসআই মোহাম্মদ সোহেল সিকদার ২০২১ সালের ১০ জুন আদালতে মামলাটির চার্জশীট (অভিযোগপত্র) প্রদান করেন। যার চার্জশীট নম্বর : ৩৯৩। চার্জশীটে তদন্তে প্রাপ্ত আসামী আজিমুল্লাহ ও আবুল কালাম এবং ঘটনাস্থল থেকে ধৃত মো: আয়াজ ও মো: বিল্লাল সহ ৪ জনকে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্থ করে বিচারের জন্য প্রার্থনা করা হয়।
মামলাটির বিচারের জন্য ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হয়। মামলায় ১৬৪ ধারায় আসামীদের জবানবন্দি নেওয়া সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আবুল মনসুর সিদ্দিকীর বিকল্প সাক্ষ্য গ্রহণ সহ চার্জশীটের ৩১ জন সাক্ষীর মধ্যে মোট ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সাক্ষীদেরকে আসামীদের পক্ষে জেরা করা হয়। মামলাটির আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাই, আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, উভয় পক্ষে যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
ঘটনার মাত্র ২ বছর ২ মাস ২২ দিন পর বুধবার মামলাটির রায় ঘোষণার দিনে কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) সারণির ১০(গ)/৩৮/৪১ ধারায় দোষী সাব্যস্থ করে উপরোক্ত ৪ জন আসামীকে মৃত্যুদন্ড, প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডে রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, মামলার অভিযুক্ত আসামীগণের নিকট থেকে জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ ইয়াবা টেবলেট উদ্ধারের বিষয়টি প্রসিকিউসন পক্ষ উপস্থাপিত নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য প্রমান দ্বারা বর্ণিত আইনের ৩০ ধারা মতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে, একই ধারা মোতাবেক আসামীদের নির্দোষ প্রমাণের দায়িত্ব আসামী পক্ষের উপর বর্তাইলেও আসামীগণ তা প্রমাণ করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষনে বিজ্ঞ বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল আরো বলেন “বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে অ্যাম্ফিটামিনযুক্ত ইয়াবা টেবলেট যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখোমুখি করেছে। যাহা প্রকারন্তরে জাতীয় বিপর্যয় হিসাবে দেখা দিয়েছে।”
প্রসঙ্গত, এ মামলাটি দেশে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ পরিমাণ মাদক পাচার মামলার রায়।