মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : ইয়াবা পাচারের পৃথক দুটি মামলায় ২ আসামীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দিয়েছেন আদালত। অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো ৩ বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
একই অভিযোগে অপর একটি মামলায় ১৫ জন আসামীকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে প্রত্যেককে আরো ১ বছর করে বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আবদুল্লাহ আল মামুন গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) তিনটি পৃথক মাদকের মামলায় এসব রায় ঘোষণা করেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা তিনটি পরিচালনা করেন অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মোজাফফর আহমদ হেলালী।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী দেলোয়ার হোসাইন ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এ তথ্য জানিয়েছেন।
প্রথম মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও রায়
২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী রাত ৯ টা ৪০ মিনিটের দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ রোডের রেজু খাল ব্রীজ সংলগ্ন যৌথ চেকপোস্টে ৩৪ বিজিবি’র একটি টিম এক অভিযান চালিয়ে একটি প্রাইভেট কার ও কারের ড্রাইভার চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার বড় হাতিয়ার সর্দার পাড়ার দিলীপ সর্দার ও লক্ষী সর্দারের পুত্র রতন সর্দার (৩০) কে আটক করে। পরে প্রাইভেট কারটি তল্লাশি করে ১২ হাজার ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়।
এঘটনায় ৩৪ বিজিবি’র নায়েক মোঃ মাজেদুর রহমান বাদী হয়ে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রতন সর্দারকে আসামী করে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার রামু থানা মামলা নম্বর : ১৬/২০২১ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ৪৫/২০২১ (রামু) এবং এসটি মামলা নম্বর : ৬২০/২০২২ ইংরেজি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ২০২১ সালের ২৭ মে আদালতে এ মামলার চার্জশীট দাখিল করেন। আদালত একই সালের ১৭ জুলাই চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে মামলাটির বিচার কার্যক্রম শুরু করে।
মামলায় ৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষীদেরকে আসামী পক্ষে জেরা, আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাই, আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
বুধবার রায় ঘোষণার দিন বিচারক কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) এর ১০(গ)/৩৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আসামী রতন সর্দারকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৩ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেছেন। রায় ঘোষণার সময় আসামী আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, আসামীর বিরুদ্ধে মামলায় আনীত অভিযোগ রাষ্ট্র পক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সে অনুযায়ী আসামীর সাজা মৃত্যুদন্ড অথবা আমৃত্যু কারাদন্ড দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আসামীর বয়স কম বিবেচনায় আসামীকে অপেক্ষাকৃত লঘু শাস্তি হিসাবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে।
দ্বিতীয় মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও রায়
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯ টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ রোডের চেইন্দা বাজারে র্যাব-১৫ এর একটি টিম একটি অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে একটি মটর সাইকেল আটক করে। একই সাথে মটর সাইকেল এর চালক রামু’র জোয়ারিয়ানালা বাজার এলাকার রফিক আহমদ এর পুত্র মোহাম্মদ শহীন (৪৬) আটক করে।
পরে মটর সাইকেল তল্লাশি করে ১০ হাজার ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়। এসময় মটর সাইকেল এর অপর আরোহী কক্সবাজার সদর উপজেলার খরুলিয়ার মোহাম্মদ ইলিয়াসের পুত্র আমান উল্লাহ (২৫) পালিয়ে যায়।
এ ঘটনায় র্যাব-১৫ এর নায়েব সুবেদার মোঃ ফিরোজ আহমদ বাদী হয়ে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মোহাম্মদ শাহীন ও আমান উল্লাহকে আসামী করে রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার রামু থানা মামলা নম্বর : ৩৮/২০২১ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ১৮০/২০২১ (রামু) এবং এসটি মামলা নম্বর : ১২৬৩/২০২১ ইংরেজি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ২০২১ সালের ৩০ জুন আদালতে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করেন। আদালত ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করে। চার্জ গঠনের সময় আসামী আমান উল্লাহকে মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
মামলায় ৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষীদেরকে আসামী পক্ষে জেরা, আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাই, আসামীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
বুধবার রায় ঘোষণার দিন বিচারক কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আবদুল্লাহ আল মামুন ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩৬(১) এর ১০(গ)/৩৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আসামী মোঃ শাহীনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ৩ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেছেন। দন্ডিত আসামী মোহাম্মদ শাহীন পলাতক রয়েছে।
তৃতীয় মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও রায়
২০১৬ সালের ২ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কোস্ট গার্ডের টেকনাফের স্টেশনের একটি টিম টেকনাফের সেন্টমার্টিনের ছেরাদ্বীপের দক্ষিণে মায়ানমারের দিক আসা একটি ট্রলার ও ট্রলারে থাকা ৬ জন রোহিঙ্গা সহ ১৫ জনকে আটক করে। পরে ট্রলারটি তল্লাশি করে ৫০ হাজার ইয়াবা টেবলেট উদ্ধার করা হয়।
এ ঘটনায় কোস্ট গার্ডের টেকনাফ স্টেশনের পিও মোঃ শহীদুল্লাহ বাদী হয়ে ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৫ জনকে আসামী করে টেকনাফ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। যার টেকনাফ থানা মামলা নম্বর : ০৬/২০১৬ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর : ৬৬৩/২০২১ (টেকনাফ) এবং এসটি মামলা নম্বর : ৭০৫/২০১৭ ইংরেজি।
মামলার আসামীরা হলেন –
উখিয়ার কুতুপালং শরনার্থী ক্যাম্পের মৃত সুলতান মাহমুদের পুত্র রোহিঙ্গা রশিদ আহমদ (৩৯), মৃত সাব্বির আহমদের পুত্র রোহিঙ্গা হাবিবুর রহমান (২৮), মৃত মোঃ সুলতানের পুত্র রোহিঙ্গা মোঃ ইসলাম (৪৭), হাবিব উল্লাহ’র পুত্র রোহিঙ্গা আবদুল মজিদ (৩৪), আইয়ুব আলীর পুত্র রোহিঙ্গা ইউনুস মিয়া (২৫), সাহেব মিয়ার পুত্র রোহিঙ্গা সিরাজ মিয়া (৪০)।
এছাড়া বাংলাদেশী নাগরিক ৯ জন আসামী হলেন-
আবদুল হাশেমের পুত্র মোঃ ইউনুস (৪৩), নুরুল কবিরের পুত্র আবদুল মালেক (২৫), ফকির আহমদের পুত্র রশিদ আহমদ (৩৪), নুর মোহাম্মদ এর পুত্র নুরুল ইসলাম (৩৬), জবুর হোসেনের পুত্র ইসলাম (২৭), সবি রহমানের পুত্র কেফা (২৪), ফয়জুর রহমানের পুত্র নজরুল মিয়া (২৬), সৈয়দ আলমের পুত্র শফি আলম (২৪) এবং মোঃ হাসেমের পুত্র মোঃ হোসেন (২৭)।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে মামলাটির চার্জশীট দাখিল করেন। আদালত ২০১৭ সালের ২০ জুলাই মামলাটির চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করে।
মামলায় ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ, সাক্ষীদেরকে আসামী পক্ষে জেরা, আলামত প্রদর্শন, রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট যাচাই, আসামীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্ক সহ বিচারের সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
বুধবার রায় ঘোষণার দিন বিচারক কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ-১ আবদুল্লাহ আল মামুন ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৯ (১) এর টেবিল ৯(খ) ধারায় ১৫ জন আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদন্ড, ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড, অর্থদন্ড অনাদায়ে আরো ১ বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেছেন।
রায় ঘোষণার সময় দন্ডিত আসামীদের মধ্যে ১২ জন আদালতের কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন এবং বাকী ৩ জন পলাতক রয়েছে।