এম. মাফতুন আহমেদ : যে আইন জনগণ মানে না,জণকল্যাণে কাজে আসে না তাকে কী আইন বলা যাবে? ব্রিটিশ সৃষ্ট দেড়শত বছরের অধিককাল আইনের নামে জগদ্দল নিষ্ঠুর এক পাথর আমাদের আজও ঝাপটে ধরেছে। একটি স্বাধীন জাতিকে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে রেখেছে। এই নিষ্ঠুর আইনের রচয়িতা কে? তিনি কোন আইনবিদ ছিলেন না। যার জীবন কেটেছে রাজনীতি ও সাহিত্যের অঙ্গনেই। যার নাম টমাস ব্যারিংটন মেকলে। তিনি ভারতীয় পেনাল কোডের রচয়িতা। মেকলে রচিত পেনাল কোড উপমহাদেশের তিনটি স্বাধীন দেশ ভারত,পাকিস্তান,বাংলাদেশে আজও বহাল রয়েছে।
মেকলে রচিত এই আইন কী স্বাধীন দেশের সময়পোযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ আইন বলা যাবে? মোটেই না। এই আইন সময় উপযোগী নয়।একটি স্বাধীন দেশে এর সকল ধারা উপধারা সংশোধন হওয়া উচিত। কারণ এই আইন রচিত হয়েছিল ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। সেদিন ব্যবহার হয়েছিল উপমহাদেশের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে। এক শাসন-শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। জলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে।
মেকলে প্রবর্তিত ১৮৬২ সালের ১লা জানুয়ারী পেনাল কোড এ উপমহাদেশে সর্ব প্রথম চালু হয়। তখনই বলা হয়েছিল অসম্পূর্ন একটি আইন। জালিমের পক্ষে মজলুমের বিরুদ্ধে একটি খড়গ মাত্র। তখন দাবি উঠেছিল এর সকল ধারা উপধারা পুনবিন্যাস হওয়া জরুরী।
১৮৩৭ সালে গঠিত প্রথম আইন কমিশনগণ মন্তব্য করেছিলেন, ‘শাস্তিযোগ্য নয়, এমন অনেক কাজ, অনেক শাস্তিযোগ্য কাজের চাইতেও নৈতিকভাবে নিকৃষ্টতর। যে ব্যক্তি একজন উপকারীকে অকৃতজ্ঞতা কিংবা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে সে এবং ক্রোধবশত আঘাত দেয় অথবা কৌতুকচ্ছলে জানালা ভাঙ্গে,উভয় ব্যক্তি অন্যায় করে। নীতির দিক হইতে প্রথম ব্যক্তি অধিক তিরিস্কারের যোগ্য। তবুও আমরা আঘাত ও ক্ষতিকর কাজের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করিয়াছি, কিন্তু অকৃতজ্ঞতার জন্য কিছুই করি নাই। আসন্ন মৃত্য হইতে রক্ষা করার জন্য এক মুষ্টি ভাত দিতে যে ধনী ব্যক্তি অস্বীকার করে, সেই নিষ্ঠুর ব্যক্তির জন্য আমরা শাস্তির বিধান করি নাই।………..যে ধনী ব্যক্তি তাহার গরীব প্রতিবেশীকে জঠর জ্বালায় মৃত্যু হইতে রক্ষার জন্য তাহার অপর্যাপ্ত ভাণ্ডার হতে এক মুষ্টি ভাত দিতে অস্বীকার করে,সেই ব্যক্তি নীতির দিক হইতে অধ:পতিত, কিন্তু আইন তাহাকে অপরাধী বলে না।’ এই ছিল মেকলে প্রবর্তিত আইন।
এই ঔপনিবেশিক আইন দিয়ে শত শত বছর আমাদের শাসন করেছে। শোষণ করেছে। সম্পদের রাশ রাশ পাহাড় গড়েছে। কিন্তু কিছুই বদলায়নি। শুধু বদলিয়েছে ব্রিটিশ সিংহের প্রতীকের বদলে পাকিস্তানের চাঁদতারা তারপর বাংলাদেশের শাপলা। সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশের আইন-আদালতে‘দণ্ড বিধি,কার্যবিধি’ নামে দু’টি আইনের কেতাব নিয়ে আজও চলছে এ দেশের গোটা বিচারালয় ।
প্রিয় পাঠক, যে আইন সরাসরি জনগণের বিরুদ্ধে খড়গ, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ নেই, তাকে কী আপনি আইন বলবেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ না দিয়ে সমাজে একতরফা ভাবে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা কী সম্ভব?
আইনের পরিভাষায় যার নাম বিচার বিভাগীয় তদন্ত। ((judicial inquiry) ফৌজদারী কার্যবিধি আইনে ২০২(১) ধারায় সৃষ্ট এটি একতরফা একটি কালো অধ্যায়। বৃটিশের বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিরোধে এই ধারাটি সৃষ্টি হয়েছিল।
আইন জার্নাল 5.D.L.R –এ একটি নজিরে উল্লেখ রয়েছে যে, At the stage of judicial inquiry u/s 202(1) of the Cr.P. Code into the allegations of a directed under the provisions of section 202(1) of the code of criminal procedure the accused has no locus standi and cannot cross-examine the witnesses either himself or by proxy through the mouth of the enquiring magistrate.
বিচার বিভাগীয় তদন্তের সময় আসামী বা তার কোন প্রতিনিধি বা তার নিয়োজিত কোন কৌশুলী উপস্থিত থাকতে পারবেন না। এটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তির একক সিদ্ধান্ত। একটি হেয়ালিপূর্ণ প্রশাসনিক আইন মাত্র।এখানে বিবাদী পক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ নেই। বাদী বা তার মানিত সাক্ষীদের একতরফা সাক্ষ্য প্রমাণই যথেষ্ট। তাহলে একতরফা আইনের এই সিদ্ধান্তে সমাজে কী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবো। এখন আমরা কী বলব এটা আইন না কালো আইন? জনস্বার্থে এই সব ধারা-উপধারা বাতিল হওয়া উচিত।
বিচার বিভাগ আজ পৃথিকীকরণ হয়েছে। আইনের শাসন কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে, জনগণ কতটুকু সুফল ভোগ করছে। এ ব্যাপারে মন্তব্য না করাই ভাল। কেমন চলছে প্রিয় আদালত, বিদগ্ধ পাঠক মহল ভাল জানেন। শাসক মহল, প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা মঞ্চে-ময়দানে প্রায় বলে থাকেন বিচার বিভাগকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলে তুলতে হবে।
মাঝে মধ্যে নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা আর কবে সাবালক হবো? এ সব অন্ত:সার শুন্য বক্তব্য আর কতদিন শুনব? দায়িত্বশীল মহল কবে আমাদের বিচার বিভাগকে যুগোপযোগী করবেন। বৃটিশ সৃষ্ট আইনের সকল ধারা-উপধারাকে সংস্কার করে মানব কল্যানে আইন প্রণয়নে যুগোপযোগী হতে। যেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন। ঘরে ঘরে ফিরে যাক আবার শান্তির এক সুবাতাস। এটাই সময়ের দাবি মাত্র।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট