বেল্লাল হোসাইন : দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮ এর ধারা ২ এর উপধারা ৮ এ বিচারককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে যার বাংলা অর্থ আদালতের প্রধান কর্মকর্তা। অন্যদিকে আইনজীবীরা হলেন কোর্ট অফিসার। আদালতে বিচারক হবেন সেই সকল কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধান। তাহলে সম্পর্কটা হওয়ার কথা মর্যাদাময় কলিগের সম্পর্ক। কিন্তু এই নির্ধারিত সম্পর্কে টানাপোড়েন কী নিয়ে?
বার-বেঞ্চের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে ভাটা লাগে যখন কোনো প্রান্তে শ্রদ্ধার ঘাটতি থাকে এবং ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ নগ্নভাবে সামনে আসে। বিচারে অসন্তোষের প্রতিকার উচ্চতর আদালতে আপীল করা। আপীলের অনেকগুলো ফোরাম রয়েছে। কোনো বিচারকের আচরণ বা নৈতিকতা বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তা নিষ্পত্তির যথাযথ ফোরাম যেমন: আইন মন্ত্রণালয় ও মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট রয়েছে।
তদ্রুপ একজন আইনজীবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলেও তাঁর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল রয়েছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে বলপ্রয়োগ, গালাগালি বা অশ্লীল শব্দোচ্চারণের মতো আচরণ অবশ্যই নিন্দনীয়।
Criminal Rules and Orders (Practice and Procedures of Subordinate Courts), 2009 এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিধি ৩ থেকে ১৫ পর্যন্ত আদালত পরিচালনার সময়সূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সেখানে নিয়মিত অফিস সময় ৯ টা থেকে ৫টা এবং আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার সময় ৯.৩০ থেকে ৪.৩০ টা বা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী আদালত বসার বিধান রয়েছে। এই সময়ে বিচারকবৃন্দ তাদের অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে আইনগতভাবে বাধ্য। দায়িত্ব পালন না করলে শৃঙ্খলা বিধিমালা অনুযায়ী তিনি অসদাচরণের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন।
অন্যদিকে বিচারককে তার অফিসিয়াল কার্যক্রম জোরপূর্বক পরিচালনা করতে না দিলে সেটাও সুস্পষ্ট ফৌজদারি অপরাধ। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ১৮৬ অনুযায়ী সরকারি কর্তব্য কাজে বাধার অপরাধে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে।
আদালত বর্জন বা আদালতের বিরুদ্ধে ধর্মঘট না করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের ২০০৫ সালের একটি রায় রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ আইনের মর্যাদা পায়। কিন্তু আদালত বর্জন বা ঘেরাও প্রায়ই করা হয় যা নিশ্চিতভাবেই সুবিচারকে প্রভাবিত করে থাকে।
আইনজীবীদের পেশা পরিচালনার কানুনস এর মধ্যে চার ধরণের আচরণের কথা রয়েছে। যথা;
১. আইনজীবীদের প্রতি আচরণ
২. মক্কেলের প্রতি আচরণ
৩. আদালতের প্রতি দায়িত্ববোধ
৪. জনসাধারণ তথা সমাজের প্রতি সাধারণ দায়িত্ববোধ
আদালতের প্রতি দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে “শুধুমাত্র বিচারিক কর্মকর্তার বিচারিক পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন স্বল্প সময়ের জন্যই নহে বরং বিচারিক আদালতের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করিয়া আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা একজন আইনজীবীর দায়িত্ব ও কর্তব্য।”
এখানে সুস্পষ্ট বিষয় এই যে, একজন ব্যক্তি বিচারককেই নয় বরং টোটাল জুডিসিয়াল সিস্টেমকে মর্যাদাবান জায়গায় অধিষ্ঠিত করা আইন অঙ্গণের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের দায়িত্ব। স্বচ্ছ বিচার বিভাগের মাধ্যমে সমাজের নৈতিক কাঠামো ঠিক করা সম্ভব। কিন্তু কোনো বিচারকের ব্যক্তিগত নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা সমাধান করার যথাযথ ফোরাম আছে। ব্যবস্থা নেওয়ার নজিরও আছে।
কিন্তু একজন বিচারককে কেন; কোনো মানুষকেই অসম্মানজনকভাবে এভাবে গালিগালাজ করার অধিকার কারো নেই। বিচারকবৃন্দ প্রকাশ্যে মতামত প্রদান করেন না বলে তাদের মন:কষ্ট বা ব্যাখ্যা অজানা থাকে। তাই তাদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে জনমতও তৈরি হয় না। এক্ষেত্রে তাদের হয়ে সুহৃদ মুখমাত্র হতে পারে বিজ্ঞ আইনজীবী সমাজ। কিন্তু দ্বন্দ্ব হলে কে কার যত্ন করে?
আইনজীবীগণকে বলা হয় সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ার। সমাজ ও সামাজিক মূল্যবোধ বিনির্মাণের ম্যান্ডেট নিয়ে সামান্য ব্যক্তি স্বার্থে সামাজিক মূল্যবোধ বিনাশ করার অধিকার কতিপয় ব্যক্তির নাই।
একটি আদালতে বিচারক থাকেন একজন। বিপরীতে আইনজীবীবৃন্দের সংখ্যা থাকে অগণিত। তারপরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে সারাদেশে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বিচার কার্য পরিচালিত হয় অর্থাৎ কিছু মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবিশেষ বাদে বেশিরভাগ আইনজীবী আইন মান্য করেন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ ও বিচারকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন।
কিন্তু লক্ষ্য করলাম উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ আইনজীবীগণের বৃহৎ অংশ নিরপেক্ষ ভূমিকায় রয়েছেন। যার মর্মার্থ ধরা যায় যে, এই সময়ে গালিগালাজের পক্ষে কেউ না থাকলেও যিনি গালি গেলেন তাঁর পক্ষেও আমাদের শক্ত অবস্থান নেই। কিন্তু কেন?
বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দের আত্মোপলব্ধি দরকার যে, যারা আজ বিচারক হয়েছেন তাঁরা আইনজীবীদেরই ভাই, বন্ধু বা পরিবারের লোক। কিন্তু সরকারি বড় পদে আসীন হয়ে বিচারকদের কেউ কেউ পরিবারের লোকদের ভুলে গেছেন নাকি? আপনি প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে কোর্ট অফিসারদের অবজ্ঞা করেন না তো?
বিপদে বন্ধুর পরিচয় হলে বিপদে বন্ধু কই? বন্ধু বানাতে না পারার ব্যর্থতার দায় কিছুটা হলেও তো আপনাদের নিতে হবে।
কিন্তু অন্য অনেক বিষয়ে হাজার বিতর্ক থাকলেও কোনোভাবেই এজলাসে সম্মানিত বিচারক মহোদয়কে গালিগালাজ করা ও দুর্ব্যবহারের কোন ডিফেন্স নাই। এখানে গোষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে ন্যায়ের পক্ষ না নিলে এই অনাচার ভিন্ন কোনো রুপে নিজেদের প্রতি ফিরে আসবে!
বিচারের ভার লাঠির উপর ভর করলে বিচার পাওয়া যাবে না বরং লাঠির আঘাতে আমাদের গায়ে কালসিটে দাগ পড়বে।
মানুষ সাধারণত অহংকার করে ধন, মান, শিক্ষা আর পদ-পদবী নিয়ে। আইনজীবীবৃন্দের মধ্যে থেকেই উচ্চ আদালতে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ হয়ে থাকে। কিন্তু আইনজীবীগণের শুরুর ক্যারিয়ার অনেকটা চ্যালেঞ্জিং। সেই সময়ে বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ আবার নিয়মিত বেতন পেয়ে থাকে। কিন্তু দিনশেষে হিসেব করলে কেউ কারো থেকে ধনে মানে পিছিয়ে থাকেনা।
তাহলে এই অনর্থক দ্বৈরথ কেন?
একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে একটা বাছাই পরীক্ষার ফলাফলের কারণে বার-বেঞ্চের পেশায় আসা ব্যক্তিগণ একে অন্যকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারবে না কেন? আজকের মহামতি সম্মানিত বিচারকবৃন্দের অনেক বন্ধু আছেন যারা কোনো দিন জুডিসিয়ারি পরীক্ষায় ইচ্ছে করেই বসেনি আইনজীবী হবে বলে। আবার কিছু বিচারক চাকরি ছেড়ে ওকালতি করতে আসেন। পেশায় মজা খুঁজে না পেলে লোকে তা সারাজীবন করতে চায়না। কিন্তু যে যাহাই করুক, প্রাপ্য সম্মানবঞ্চিত হতে কেউ-ই চায় না।
সাংবিধানিকভাবে আইনের দৃষ্টিতে সমতার বিধান থাকলেও পদ-পদবী ও ডিগ্রিতে এগিয়ে থাকারা যে আমাদের মতো অধমদের তুলনায় বাড়তি কোন সুবিধাই পায়না সেটা হলফ করে বলা যায় না। সবাইকে সমতার দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যাবে ব্যালেন্স অব পাওয়ার নিশ্চিত হয়ে গেছে। এদিকে নজর দিন। লক্ষ করলে দেখবেন, আপনি যাকে খুব গুনছেন সেই আপনাকে বেশি তাচ্ছিল্য করছে!
বিচারক পরিবারের একজন আইনজীবী ব্যক্তি হিসেবে আমি বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দের নিকট বিজ্ঞ আইনজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সম্পর্কের প্রত্যাশা করি। দলছুট, ব্যক্তিস্বার্থের জন্য বিপথগামী মুষ্টিমেয় আইনজীবীর অসদাচরণের দায় প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী কমিউনিটি নিবে না বলে বিশ্বাস করি এবং উদ্ভূত ঘটনার বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে সুবিচার চাই।
বিচারক এবং বিচার বিভাগের মর্যাদা ভূলন্ঠিত হলে সাধারণের লাস্ট রিসোর্ট বলে কিছু থাকবে না। প্রকাশ্য আদালতে বিচারককে গালিগালাজ করলে সম্মানিত বিচারকের মান যায় না বরং তা পুরো জুডিসিয়াল সিস্টেমের অংশীদারদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও হুমকি হিসেবে সুনামির মতো আবির্ভূত হতে পারে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে সৌহার্দ্যপূর্ণ কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত হোক আন্ত:পেশাজীবী সম্প্রীতি সমিতির পক্ষে এটাই প্রত্যাশা করি।
লেখক : প্রসিকিউটিং অফিসার (আইন কর্মকর্তা), নৌপরিবহন অধিদপ্তর; সংগঠক, আন্ত:পেশাজীবী সম্প্রীতি সমিতি। ই-মেইল: bellal.confident@gmail.com