সাব্বির এ মুকীম :
পূর্বপরিচিতি
যে সময়ে বাংলাদেশে এমএলএম কোম্পানীগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণার ঘটনাগুলো ঘটেছিলো সেই একই সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণার ভারতীয় উদাহরণ হলো চিট ফান্ড প্রতারণা। কাকতালীয়ভাবে ইংরেজি উচ্চারণ একই হলেও চিট আর চিট এর বানান এক নয়। চিট ফান্ড এর চিট ১টি মালায়াম শব্দ যার ইংরেজি (Chit) বানান আর প্রতারণার ইংরেজি চিট (Cheat) বানান ভিন্ন ভিন্ন রকম বানান। এমএলএম যেরকম cheating-ab-initio মানে শুরুই করা হয় প্রতারণা করার জন্য করা হয়, চিট ফান্ডে কিন্তু তেমনটা হয় না।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ স্তরের অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক বিভিন্ন অভ্যাসের একটা হলো টাকা জমিয়ে সমবেত লটারি করা। প্রায় সবাই চিনে তবুও বোঝার জন্য এই লটারিতে ধরা যাক ১০ জন ব্যাক্তি সমবেত হলেন। তাঁরা প্রতি সপ্তাহে ১টা নিদৃষ্ট অংক -ধরা যাক প্রতিজনে ১০০টাকা করে- ম্যানেজারের নিকট জমা রাখেন। ১০জন মিলে ১সপ্তাহে জমা পড়ে ১ হাজার টাকা; ১মাসে জমা হয় ৪ হাজার টাকা- সে টাকা জমা হওয়ার পরে আগে থেকে নিদৃষ্ট এক দিনে লটারি হয়- সে লটারি তে যার নাম আসে সে একসাথে ৪ হাজার টাকা পেয়ে যায়। এভাবে লটারি ঘুরতে থাকে- কেবল যে একবার লটারি জিতে যায় সে আর পরে লটারিতে অংশ নিতে পারে না তবে কিস্তির টাকা জমা দিয়ে যায়। মানে এখানে জুয়া জাতীয় কোনো উপাদান নাই। এটা আসলে ১টা অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ এর ১টা বিশেষ প্রক্রিয়া যাতে ঋণ গ্রহন করে গ্রাহক- যে ঋণের অর্থায়নও সেই গ্রাহক ই করে।
ঘটনা
ভারতে এই ম্যানেজারির কাজটা করে দেয়ার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এই চর্চা ভারতে সেই ১৮ শতকেই থেকেই চলছে বলে জানা যায়। এই চিট ফান্ড পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের কিস্তি নিশ্চিত করতে জামানত হিসেবে গ্রাহকের স্বাক্ষরিত চেক নেয়। তেমন চেক কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে ২০১৩ সালের ১৯৭৮ নেং ফৌজদারি আপিলে বিচারপতি বি আর গাভাই ও বিচারপতি এম এম সুন্দরেশ এর বেঞ্চ গত ২৩ শে জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে আলোচ্য রায় প্রদান করেন।
মোট টাকার পরিমান ৭ লক্ষ, চেক ছিলো ২টি- প্রতিটি ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার চেক, প্রমিজরি নোট ও ছিলো ২টি। বাদী ২টি চেক দিয়ে এন আই এক্ট এর ১৩৮ ধারায় ২টি ফৌজদারি মামলা করে এবং ২টি প্রমিজরি নোট দিয়ে ২টি দেওয়ানি মোকাদ্দমা করেন। ৪টি মামলাতেই নিম্ন আদালতে বিবাদী রায় পায়, হাইকোর্টে বাদী রায় পায়। হাইকোর্টের ৪টি রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদী আলাদা আলাদা ৪টি আপিল করে।
বিবাদী আপিল্যান্ট পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি
(১) নালিশী চেকগুলো চিট ফান্ড সংক্রান্ত, বাদীর সাথে বিবাদীর কোনো ব্যাক্তিগত লেনদেন ছিলো না।
(২) চিট ফান্ডের গ্রাহক হিসেবে নিরাপত্তা জামানত হিসেবে নালিশী চেকগুলো ব্ল্যাংক চেক আকারে প্রদান করা হয়।
(৩) চেকের তারিখের বহু আগেই নালিশী ব্যাংক হিসাব বন্ধ ছিলো।
(৪) বাদী দাবী করে কৃষি আয় হতে সে বিবাদীকে ধার দেয় কিন্তু বাদীর আয়কর রিটার্ণে কোনো কৃষি আয় নাই।
(৫) বাদীর আয়কর রিটার্ণ মোতাবেক ই প্রমাণ হয় বিবাদী প্রদত্ত কথিত ধার/ঋণ/কর্জ দেয়ার কোনো ধরণের সামর্থ্য বাদীর ছিলো না।
বাদী রেসপন্ডেন্ট পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি
(১) বিবাদী চিট ফান্ড সংক্রান্ত দাবী প্রমান করতে পারেনি।
(২) বিবাদী নিরাপত্তা জামানত হিসেবে নালিশী চেকগুলো ব্ল্যাংক চেক হিসেবে প্রদান করার দাবী প্রমান করতে পারেনি।
(৩) বাদীর আয়কর রিটার্ণ এর বক্তব্যকে বিবাদী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।
বিচার্য বিষয় সমূহ
সুস্পষ্টভাবে কোনো বিচার্য্য বিষয় এর কথা রায়ে বলা হয়নি। কিন্তু সার্বিক পাঠে নীচের ৩টি বিচায্য বিষয় স্পষ্ট হয়। উল্লেখ্য স্বাক্ষ্য আইনে সুপ্রতিষ্ঠিত আলাপ হলো সন্দেহের সম্ভাবনার প্রাধ্যান্যতা সংক্রান্ত নীতির প্রার্থিত মান (the standard of “preponderance of probability”) এর আলোকে পক্ষগণের উপস্থাপিত প্রমাণ যাচাই করে বিজ্ঞ আদালত সন্দেহ বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করে মামলার গতি নির্ধারণ করেন। আলোচনার সুবিধার্থে সংক্ষেপে এই নীতি কে সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন বলা হয়েছে।
(১) আলোচ্য মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতের খালাসের রায় পরিবর্তন করে সাজা দিতে পারে কিনা?
উত্তর: না পারেন না। রায়ের ২১তম অনুচ্ছেদ।
(২) ফৌজদারি মামলায় সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন যাচাইয়ে বিবাদীর উত্থাপিত সন্দেহ যথেষ্ট কিনা?
উত্তর: যথেষ্ট। রায়ের ২৫তম অনুচ্ছেদ।
(৩) দেওয়ানি মামলায় সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন যাচাইয়ে বাদীর উত্থাপিত সন্দেহ যথেষ্ট কিনা?
উত্তর: যথেষ্ট। রায়ের ৩০তম অনুচ্ছেদ।
ফলাফল
বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট ১টি রায়ের মাধ্যমে ৪টি মামলা নিষ্পত্তি করেন। ফৌজদারি আপিল ২টি মঞ্জুর হয়, যাতে বিবাদী খালাস পান। দেওয়ানি মোকাদ্দমা ২টিতে হাইকোর্টের ডিক্রি পরিবর্তন করা হয় যা চরিত্রগতভাবে আংশিক ডিক্রিতে পরিণত হয়।
বাদী আয়কর রিটার্ণের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে রায়ের যুক্তি বিন্যাস
সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন বিবেচনায় আলোচ্য ঘটনা যাচাই করে দেওয়ানী মোকাদ্দমা ২টিতে বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগে প্রদ্ত্ত বাদী পক্ষে ডিক্রি আদেশ বহাল রাখেন যদিও ডিক্রির ভেতরে পরিবর্তন করেন। সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন যাচাই করে দেওয়ানী মামলায় বাদী পক্ষে রায় দেন আবার সেই ১ই যুক্তিতে বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট ফৌজদারি মামলা ২টিতে বাদীর বিপক্ষে রায় দিয়ে বিবাদীকে খালাস দেন।
১ই ঘটনা নিয়ে ১ই নীতির ২রকম প্রয়োগের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলোচ্য রায়ের ৩০ তম অনুচ্ছেদে বিজ্ঞ আদালত যা ইংরেজিতে লিখেছে তার বাংলা সারমর্ম এমন যে- দেওয়ানি মোকাদ্দমায় ওই সম্ভাবনা নীতি বাদী কে সাহায্য করে কিন্তু ফৌজদারি মামলায় সেই ১ই নীতির সাথে ফৌজদারি মামলায় সন্দেহাতীত প্রমাণের নীতি যোগ হয়ে সেটা বিবাদীকে সাহায্য করে।
ফৌজদারি মামলা ২টিতে বাদী পক্ষের অভিযোগের সারমর্ম হলো- বাদী পক্ষ তার কৃষি খাত হতে প্রাপ্ত আয় হতে চেক এর টাকা বিবাদী কে ধার দেয়। পরে বিবাদীর নিকট টাকা ফেরৎ চাইলে বিবাদী টাকা পরিশোধের নিশ্চয়তা স্বরূপ নালিশী চেক ও নালিশী প্রমিজরি নোটগুলো বাদী কে প্রদান করে। নগদায়ন করতে গেলে “একাউন্ট ক্লোজ” জনিত কারণে চেকগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়।
নিম্ন আদালতে স্বাক্ষীর সময়ে বিবাদী পক্ষ নিযুক্তীয় আইনজীবীর দাখিলকৃত দরখাস্ত মঞ্জুরক্রমে বিজ্ঞ নিম্ন আদালত বিবাদীকে টাকা ধার প্রদানের বৎসরে আয়কর বিভাগে বাদীর দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ণ তলব করেন। বিজ্ঞ আদালতের আদেশ মোতাবেক ঘটনার বছর ১৯৯৮ সালের সহ ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সন পর্যন্ত ৭ বছরে বাদীর দাখিলকৃত আয়কর রিটার্ণ সমূহ নিয়ে সংশ্লিষ্ট আয়কর কর্মকর্তা মহোদয় আদালতে স্বাক্ষ্য দেন, রিটার্ণগুলো উপস্থাপন করেন যা বিজ্ঞ আদালত প্রদর্শণী হিসেবে চিহ্নিত করেন।
টানা ৩ বৎসরের আয়কর রিটার্ণ পর্যালোচনায় বিজ্ঞ নিম্ন আদালত নজরে নেন যে- আয়কর রিটার্ণে বাদী কৃষি আয়ের ঘরে কোনো আয় নেই এবং প্রদত্ত ঋণ এর কলামে কোনো ঋণ প্রদান করেননি বলে ঘোষণা করে রেখেছেন। সে ঘোষণা বাদীর আলোচ্য নালিশী ২টির বক্তব্যের সাথে সর্ম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। কারণ বাদী নালিশে উল্লেখ করেছেন তিনি ঋণ প্রদান করেছেন এবং তিনি তাঁর কৃষি আয় হতে সে ঋণ প্রদান করেছেন। আয়কর রিটার্ণের ভিত্তিতে বিজ্ঞ নিম্ন আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌছেন যে- নালিশের কথিত ঋণ প্রদানের সামর্থ্য বাদীর ছিলো না এবং ঘটনার সময় বাদীর কোনো ধরণের কৃষি আয় ছিলো না। সে প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞ নিম্ন আদালত আলোচ্য ফৌজদারী মামলা ২টিতে সিদ্ধান্ত দেন যে নালিশে কথিত ঋণের উৎস হিসেবে উল্লেখিত কৃষি আয় এর কথা মিথ্যা এবং যেহেতু সে বছরের আয়কর রিটার্ণে বাদী কোনো ধরণের ঋণ প্রদান করেননি মর্মে ঘোষণা করেছেন তাই নালিশে কথিত ঋণ আসলে তিনি প্রদান করেননি। বিজ্ঞ নিম্ন আদালত সার্বিক পর্যালোচনায় এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে বাদী তার অভিযোগ সন্দেহাতীত প্রমান করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আলোচ্য রায়ের ১০ম অনুচ্ছেদের বিবরণ মতে বাদী পক্ষে দাবী করা হয় আয়কর রিটার্ণ এর ঘোষণা বাদীর সাথে আয়কর বিভাগের সম্পর্কের বিষয়, আলোচ্য ঘটনায় বিবাদী সেটাকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। বাদীর দাবী বাতিল করে বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট রায়ের ১৩ তম অনুচ্ছেদের শেষ লাইনে মত দেন যে এন আই এক্ট এর ১৩৯ ধারার ”খন্ডনযোগ্য অনুমান” এর এই খন্ডনযোগ্যতার কারণে বিবাদী পক্ষ বাদীর দাবী খন্ডন করতে যেকোনো প্রমান ব্যবহার করতে পারবে।
বাদীর দাবী সত্য এ অনুমান খন্ডন করতে বিবাদীর উত্থাপিত সন্দেহ সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন নিরূপন করে বিবাদীর উত্থাপিত সন্দেহ সে মান পূরণ করেছে মর্মে বিজ্ঞ নিম্ন আদালত উপসংহার টানেন। বিজ্ঞ হাইকোর্ট বিভাগ নিম্ন আদালতের সে উপসংহার কে ভুল বলে সিদ্ধান্ত দেন এই বলে যে- বিবাদী কতৃক উত্থাপিত সন্দেহ এন আই এক্ট এ প্রাসঙ্গিক সন্দেহের সম্ভাবনা প্রাধ্যান্যতা সংক্রান্ত নীতির প্রার্থিত মান পূরণ করতে পারেনি। বিজ্ঞ সুপ্রিম কোর্ট নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ফৌজাদারি মামলা ২টিতে বিবাদী কে খালাস দেন।
রায়ে প্রতিষ্ঠিত নীতির সারমর্ম
সারসংক্ষেপ হলো চেক এর মামলার ক্ষেত্রে এনআই এক্ট এর ১১৮ ধারা ও ১৩৯ ধারা এর যুক্তপাঠ মোতাবেক ধরে নেয়া হয় নালিশী চেক এর সব উপাদান ঠিক রয়েছে এবং উক্ত চেক আসলেই কোনো দেনাপাওনা লেনদেন এর অংশ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। তবে এর সাথে এটাও যুক্তপাঠে পাওয়া যায় যে বিবাদী চাইলে সেই চেক এর উপাদান ঠিকঠাক ধরে নেয়া, দেনাপাওনা লেনদেনের অংশ সংক্রান্ত ধরে নেয়া কে চ্যালেন্জ করতে পারে, সন্দেহ করতে পারে। তবে সে সন্দেহ উপস্থিতি ও যৌক্তিকতা করার দায়িত্ব ও বিবাদীর ই। যদি বিবাদী কেবল প্রমান করতে পারে যে সে সন্দেহ যৌক্তিক এবং সে সন্দেহ করার পর্যাপ্ত উপাদান রয়েছে তাহলেই বিবাদী খালাস পাবে। তর মানে সন্দেহ সত্য হতে হবে তা নয়, সন্দেহর যৌক্তিকতা ও সন্দেহর উপস্থিতি প্রমান করাই যথেষ্ট।
ফৌজদারি মামলায় সন্দেহাতীত প্রমাণের নীতি মোতাবেকই যদি যে কোনো যৌক্তিক সন্দেহ থাকার মানেই হলো অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করা যায়নি। কোনো সন্দেহ কে যৌক্তিক সন্দেহ বলা হবে সেটা ঠিক করার প্রতিষ্ঠিত মাপাকাঠি হলো স্বাক্ষ্য আইন সংক্রান্ত আলোচনায় সন্দেহের সম্ভাবনা প্রাধ্যান্যতা সংক্রান্ত নীতির প্রার্থিত মান (the standard of “preponderance of probability” )। আলোচ্য চেক এর মামলা ফৌজদারি মামলা- বাদীর আয়কর রিটার্ণ বাদীর অভিযোগে সন্দেহ তৈরী করে যা সন্দেহের প্রাধাণ্য নীতির ওজন বজায় রেখেছে। তাই বিজ্ঞ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মনে করেন অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমান হয়নি; ফলে বিবাদী কে খালাস দেয়া হয়।
পূর্নাঙ্গ রায় দেখতে লিংকে ক্লিক করুন।
লেখক : এডভোকেট, কুমিল্লা জজ কোর্ট। ই-মেইল : samukim1@gmail.com