নিজস্ব এখতিয়ারে প্রধান বিচারপতির ‘সুয়ো মোটো নোটিস’ বা ‘স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ’ দেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে আনতে একটি বিল পাস করেছে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ। ফলে একক ক্ষমতাবলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে কোনো বিষয়ে আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা আর থাকল না দেশটির প্রধান বিচারপতির।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বুধবার (২৯ মার্চ) ‘সুপ্রিম কোর্ট (প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিওর)’ বিলটি উত্থাপন করেন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের আইন ও বিচারমন্ত্রী আজম নাজির তারার।
নতুন আইনে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই কমিটি যে কোনো মামলা ও আপিল নিষ্পত্তি বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ গঠন করে দেবে।
আগের আইনে প্রধান বিচারপতি একক ক্ষমতাবলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যে কোনো বিষয়ে আদেশ দিতে পারতেন এবং এর বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ ছিল না। নতুন আইনে একক সিদ্ধান্তে আদেশ দেওয়ার এই সুযোগ আর থাকছে না এবং আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে।
পার্লামেন্টে বিলের উপর আলোচনায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, এই পদক্ষেপ ‘অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছে’ এবং এই বিলের নামকরণ করা উচিৎ ছিল ‘বিচারকদের ক্ষমতায়ন’ বিল।
বিলের বিষয়ে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী তারার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব আনার কথা আলোচনা করা হয়েছে। আমি তাদের জানাতে চাই যে সংবিধান সংশোধন করার দরকার নেই। সংবিধানের ১৯১ ধারায় আইনসভাকে এই আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
“সুপ্রিম কোর্টও তাদের বিধি সংবিধান ও আইন অনুযায়ীই তৈরি করে থাকে এবং ১৯৮০ সাল থেকে তা চলে আসছে।”
আদালতের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ করার লক্ষ্যেই এই বিল তোলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
পাকিস্তানের ছয়টি বার কাউন্সিল রয়েছে এবং তারা সবাই এই বিল পাসের জন্য আইনসভাকে ‘স্যালুট জানিয়েছে’ বলেও দাবি করেন নাজির তারার।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেন, পার্লামেন্ট সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করেনি বরং সংবিধানিক অধিকার অনুযায়ী তাদের আইনসিদ্ধ করেছে।
বিলের ধারা
সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়ে নতুন এই বিলে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারকের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে এই বিষয়ে আদেশ, আপিল ও মামলার শুনানি করতে হবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত প্রাধান্য পাবে।
এছাড়া কোনো বিষয়ে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানের ১৮৪(৩) ধারা ব্যবহার করার সময় উল্লিখিত কমিটির সামনে আগে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে।
বিলে বলা হয়েছে, “নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের প্রথম অধ্যায় অনুযায়ী জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আদেশের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের কমপক্ষে তিন বিচারকের বেঞ্চ গঠন করতে হবে যার মধ্যে উল্লিখিত কমিটির সদস্যও থাকতে পারেন।”
সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কমিটি এই কাজের যোগ্য কমপক্ষে পাঁচজন বিচারকের সমন্বয়ে বেঞ্চ গঠন করবে।
এছাড়া সংবিধানের ১৮৪(৩) ধারার অধীনে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ক্ষেত্রে আদেশ দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিক কোর্টের আরেকটি বৃহত্তর বেঞ্চে আপিল করতে হবে এবং আপিল করার ১৪ দিনের মধ্যে আদালতকে তা নিষ্পত্তি করতে হবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি একক ক্ষমতাবলেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ দিতে পারতেন। নতুন আইনে তার এই ক্ষমতা সীমিত করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির ক্ষমতা নিয়ে আপত্তি
প্রধান বিচারপতির ‘সুয়ো মোটো’ ক্ষমতা নিয়ে অনেক দিন ধরেই পাকিস্তানের বার কাউন্সিলগুলো আপত্তি জানিয়ে আসছিল। সম্প্রতি সেদেশের সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারকও প্রধান বিচারপতির এই ক্ষমতা কমানোর পক্ষে কথা বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সরকার নতুন এই বিল পাস করল।
এ বিষয়ে অধিবেধনে নিজের স্বাগত বক্তব্যে আইনমন্ত্রী তারার বলেন, “গত এক বছরে বা তার বেশি সময়ে সুপ্রিম কোর্টের দুইজন জ্যেষ্ঠ বিচারককে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বেঞ্চে দেখা যায়নি। এমন ঘটনা কাম্য নয়।”
বিদ্যমান ‘সুয়ো মোটো’ ক্ষমতাকে ‘ওয়ান ম্যান শো’ আখ্যা দিয়ে আজম নাজির তারার বলেন, “আমরা সবদিক খতিয়ে দেখে নিশ্চিত হয়েছি এ বিষয়টি নিয়ে সংবিধান সংশোধনের কোনো দরকার নেই।”
তিনি আরও বলেন, “দুঃখজনকভাবে কোনো শুনানিতেই গত তিন বছরে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ বসেনি। আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এ ধরনের শূন্যতা পূরণ করা কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব।”
‘সুয়ো মোটো’ ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার চৌধুরীর নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, “এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের দাবি সব মহল থেকেই অনেক দিন ধরে উঠে আসছে। সে কারণেই এই পদক্ষেপ নিয়েছে বর্তমান সরকার।”
তবে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকারের এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ।