বিচারপতি এ এন এম বসির উল্লাহ : ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলাম ভবিষ্যতে একজন আইনজীবী হিসেবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে অ্যাডভোকেট হিসেবে সনদ প্রাপ্তির পর বাংলাদেশের বৃহত্তম ঢাকা আইনজীবী সমিতির ১৮৫৭ নম্বর সদস্য পদ গ্রহণ করে অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে ঢাকা বারের খ্যাতিমান আইনজীবী এ কে এম রেজাউল করিমের জুনিয়র হিসেবে আইন পেশা শুরু করি।
উল্লেখ্য, তিনি বিচারপতি শহিদুল করিমের পিতা। আইনজীবী হিসেবে হাতেখড়ি দেওয়ার সময় একজন নবীন আইনজীবীর যে রকম পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা থাকার কথা, অনেকের মতে কাজে আমার আগ্রহ ও নিষ্ঠার জন্য তার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু আইনজীবী হিসেবে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না।
১৯৮১ সালের শুরুতে BCS Judiciary-তে মুন্সেফ পদে নিয়োগের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আমার সিনিয়র আমাকে দরখাস্ত দাখিল করতে উৎসাহিত করতে থাকেন এবং এর ধারাবাহিকতায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ০১.১২.১৯৮১ তারিখে মুন্সেফ পদে বরিশালে যোগদান করি। বিচারক হিসেবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে ১৫ বছর ১০ মাস ১৪ দিন চাকরি করার পর ২১/১০/১৯৯৭ তারিখে জেলা জজ পদে পদোন্নতি পেয়ে ময়মনসিংহে নারী ও শিশু কোর্টে যোগদান করি। অতঃপর জেলা জজ হিসেবে নরসিংদী, বিচারক, জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রাম, পুনঃ জেলা জজ পদে পিরোজপুর, সিলেট, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ, মহানগর দায়রা জজ পদে চট্টগ্রাম ও সর্বশেষে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১০ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ঢাকা মহানগর দায়রা জজ পদে কর্মরত ছিলাম। আমি নিম্ন আদালতে মোট ২৮ বছর ৪ মাস ১৫ দিন কাজ করেছি এর মধ্যে জেলা জজ হিসেবে বিভিন্ন কোর্টে ১২ বছর ৬ মাস কাজ করার সুযোগ পেয়েছি।
আমাদের দেশের আইনজীবীগণ এবং সচেতন জনগণ বিভিন্ন কোর্টের বিচারক বা জজদের কর্মপরিধি ও এখতিয়ার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। একটি জেলায় জেলা জজ, বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে বিচার ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। একজন জেলা জজের তার নিজ কর্মস্থলে অনেক ভালো কাজ করার সুযোগ আছে। আমি জেলা জজ থাকাকালীন কোর্ট ম্যানেজমেন্টের আওতায় পুরনো মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা-সহ, শুনানি গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আদেশ প্রদান, কোনো বিলম্ব ছাড়া কোর্টের আদেশ ও নথি সংশ্লিষ্ট স্থানে প্রেরণসহ দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছি এবং সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
আমি ২০১০ সালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৮.০৪.২০১০ তারিখ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করি এবং দেখতে দেখতে এখানে প্রায় ১৩ বছর (অর্থাৎ ১৩ বছর হতে মাত্র ১৮ দিন কম) অতিবাহিত হতে চলল। অধস্তন আদালতের বিচারকদের স্বপ্ন থাকে হাই কোর্টে বিচারক হিসেবে কাজ করার। আল্লাহর অশেষ রহমতে ও বাবা-মায়ের দোয়ায় আমার সেই লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে আজও শুকরিয়া আদায় করছি। প্রায় ১৩ বছর বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ৩০ মার্চ, ২০২৩ তারিখে মোট ৪১ বছরের বিচার কাজ শেষে বিদায় নিয়েছি।
বাংলাদেশে যে কোনো শ্রেণির মানুষই বিভিন্ন কারণে মামলায় জড়িত হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে মামলার পক্ষদের মূল সমস্যা হচ্ছে বিলম্বিত বিচার ও অনেক ক্ষেত্রে কোর্টের আদেশ ও নথি দ্রুত সময়ে সংশ্লিষ্ট স্থানে না পৌঁছা। আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৫ সালে ২৫ জানুয়ারি সংসদে প্রদত্ত ভাষণে বিচারে দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে সবচেয়ে মূল্যবান ও হৃদয়গ্রাহী উক্তি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন তা এখানে হুবহু তুলে ধরলাম-
একটা কোর্টে বিচার গেলে একটা যদি সিভিল মামলা হয়; আপনি তো উকিল, স্পিকার সাহেব। আল্লাহর মর্জি যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয়, ২০ বছরেও সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে? বাপ মরে যাওয়ার সময় বাপ দিয়ে যায় ছেলের কাছে। আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইয়ের কাছে সেই মামলা। আর ক্রিমিনাল কেস হলে এই লোয়ার কোর্ট, জজ কোর্ট-বিচার নাই। জাসটিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড-উই হ্যাভ টু মেইক এ কমপ্লিট চেইঞ্জ এবং সিস্টেমের মধ্যে পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ যাতে সহজে বিচার পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার পায়। ব্যাপক পরিবর্তন দরকার।
বঙ্গবন্ধুর উপরিউক্ত সুন্দর ও সাবলীল উক্তি থেকে দেখা যায় কীভাবে এ দেশে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের অপেক্ষায় বছরের পর বছর পড়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের নাড়ির স্পন্দন বুঝতেন, তাইতো তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু একই ভাষণে বলেছিলেন, মানুষকে বিলম্বিত বিচারের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে জুডিশিয়াল সিস্টেমের অনেক পরিবর্তন দরকার। কিন্তু আমরা কি গত ৫০ বছরে বিচার বিভাগে গণমুখী কোনো পরিবর্তন করেছি? এমনকি বিচারে কেন বিলম্ব ঘটে এবং তার প্রতিকারই বা কী সে সম্পর্কে কোনো রিসার্চ করেছি? বঙ্গবন্ধুর ওই উক্তির পরে বিলম্বিত বিচারের স্বপক্ষে আর কোনো প্রমাণ বা দলিলের প্রয়োজন নেই। দেশের সর্ব প্রান্তে ১৫-২০ বছরের শত শত পুরনো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে।
আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে মনে হয়েছে নিম্ন আদালতে দেওয়ানি মামলায় যে পক্ষ মেরিটে অসুবিধাজনক অবস্থায় থাকে, সে বিলম্বিত বিচারের জন্য যা কিছু করা দরকার সবই করে থাকে। এ অন্যায় পদক্ষেপকে বাধাগ্রস্ত করতে বিচারকদের যে দৃঢ় মনোভাব দরকার তার যেমন অভাব আছে, তেমনি বিচারকের সংখ্যা মামলার তুলনায় কম বিধায় প্রয়োজনীয় তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। এ সুযোগে, সুযোগ সন্ধানীরা দেওয়ানি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে দুষ্ট লোকের এ অপতৎপরতা তো কোর্টকেই রুখতে হবে। কোনো সন্দেহ নেই, বিচার প্রক্রিয়ায় যে কোনো অপতৎপরতা রোখার প্রাথমিক দায়িত্ব কোর্টের। কিন্তু বিজ্ঞ আইনজীবীদের এক্ষেত্রে নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ১টি মামলা বিচারাধীন ছিল। অপরদিকে আজ যখন আমি এ বক্তব্য রাখছি (৩০.০৩.২০২৩ তারিখে) তখন নিম্ন আদালতে ২০৫৯ অনুমোদিত কোর্টের বিপরীতে ১ হাজার ৮১০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ বিচার বিভাগে কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং,
প্রতিটি বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার ভাগে গড়ে মাথা পিছু ২ হাজার ২২টি মামলা পড়ে। আমার মনে হয় একজন বিচারকের পক্ষে এতগুলো মামলা সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয় বিধায়, দুষ্ট লোকেরা বিচারকের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে মামলার বিচারে বিলম্বের ফাঁদ পেতে সফল হচ্ছে।
অপরদিকে ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটার একমাত্র ও মৌলিক কারণ সাক্ষীর অনুপস্থিতি। ফৌজদারি মামলায় কোর্টে সাক্ষী আনার দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ এ দায়িত্ব পালন করে না এ কথা যেমন বলা যাবে না, আবার তেমনি এটিই বাস্তব সত্য যে, পুলিশ যে হারে সাক্ষী উপস্থিত করছে তা দ্রুত বিচারের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত ও সহায়ক নয়। হয়তো পুলিশের তরফে এর জন্য অনেক কারণ থাকতে পারে কিন্তু বাস্তব সত্য হলো সাক্ষীর অনুপস্থিতির জন্য ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব হচ্ছে।
কোর্টের বিচারকেরা দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে ফৌজদারি মামলার বিচার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কারণ দেওয়ানি মামলার চেয়ে ফৌজদারি মামলার বিচার করা তুলনামূলকভাবে সহজ। বিচারকদের কারণে ফৌজদারি মামলার বিচারে বিলম্ব ঘটেছে এমন নজির বের করা বেশ কষ্টকর। এখন প্রশ্ন হলো, পুলিশ কেন ফৌজদারি মামলায় যথাযথভাবে সাক্ষী উপস্থিত করছে না। এর সহজ উত্তর, যেহেতু সাক্ষী আনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই সে এ ব্যাপারে মনোযোগী নয়।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারায় বলা হয়েছে যে সাক্ষীদের কোর্টে উপস্থিত করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু এই দায়িত্ব পালনে পুলিশ উদাসীন হলে বা ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে পুলিশ সাক্ষী উপস্থিত করার ব্যাপারে চিরাচরিতভাবে উদাসীন। কিন্তু এ বিধানের কিছু ব্যতিক্রম দু-একটি আইনে আছে। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ২৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী উপস্থিত করার দায়িত্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার। কিন্তু পুলিশ সাক্ষীর সমন ও ওয়ারেন্ট কার্যকরী করতে ইচ্ছাকৃত গাফিলতি করলে এটাকে অদক্ষতা হিসেবে চিহ্নিত করে কোর্ট তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিতে পারবেন। এ আইনে এ রকম একটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা থাকার ফলে পুলিশ ঠিকই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় সাক্ষীদের উপস্থিত করে যাচ্ছে।
আমাদের দেশে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ আদালতগুলো ফৌজদারি মামলার বিচার করে থাকে। বেশির ভাগ ফৌজদারি মামলাতে সাক্ষীর অভাবে বিচার বিলম্বিত হচ্ছে। আপনি যদি যে কোনো একটি ফৌজদারি আদালতে মামলার নথি পর্যবেক্ষণ করেন, দেখবেন অসংখ্য মামলা সাক্ষীর অভাবে বিচার কার্য শেষ হচ্ছে না। ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা একটি মামলায় এরকম বিলম্বিত বিচারের ঘটনা প্রকাশ করেছে। পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে একজন ব্যক্তি রাজশাহী থেকে দোকানের মাল কিনতে ঢাকা এসেছিল, সে ১৯৯৮ সালের ১৮ মার্চ সন্ধ্যার সময় রাজশাহী যাওয়ার জন্য গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে বসা ছিল। গাবতলী বাস টার্মিনালের পুলিশ ওই ব্যক্তির কাছাকাছি স্থানে একটি সিগারেটের প্যাকেটে হেরোইন পায়। পুলিশ ওই হেরোইনের জন্য ওই ব্যক্তিকে দায়ী করে মামলা দায়ের করে। মামলাটি যখন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য ধার্য ছিল তখন ২৪ বছর পর ২০২২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি একজন সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয়। মামলাটিতে প্রতি ২-৩ মাস অন্তর তারিখ ধার্য হতো। এ মামলার আসামি দোষী কি নির্দোষ তা বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। কিন্তু রাজশাহী থেকে একজন ব্যক্তির ২-৩ মাস পর ঢাকায় এসে হাজিরা দেওয়া কতটা অমানবিক, কষ্টকর ও অর্থনৈতিক টর্চার করে তা কেবল একজন ভুক্তভোগীর পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব।
আমরা যারা বিচারক ও আইনজীবী, বিচারের এই মহান দায়িত্বে আছি তারা মানুষের এ সীমাহীন দুর্ভোগের দায় দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আলোচিত মামলাটিতে যদি পুলিশ দায়েরের পর নিয়মিত সাক্ষী উপস্থিত করত নিশ্চয়ই এত দিনে বিচারকাজ শেষ হয়ে যেত। একটি মামলার আসামিকে যদি ২৫ বছর কোর্টে আসতে হয়, একটি প্রাথমিক রায়ের জন্য এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? যে কোনো মামলার বোঝা একজন ব্যক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ করতে মানসিকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এটা ঠিক যে, এসব কষ্টের কারণে নাগরিকদের ফৌজদারি অপরাধ সংঘটন থেকে সব সময়ই দূরে থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু যদি কোনো কারণে কেউ মামলায় জড়িয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বিচারের আগেই তাকে এভাবে অর্থাৎ আর্থিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো অমানবিকতা আর কিছু হতে পারে না। বিচারে যদি দোষ প্রমাণিত হয় অবশ্যই তাকে সাজা খাটতে হবে সেটা ভিন্ন কথা।
মানুষকে এ হয়রানির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ফৌজদারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। আমি যখন সিলেটে জেলা জজ এবং চট্টগ্রামে ও ঢাকায় মহানগর দায়রা জজ পদে কর্মরত ছিলাম তখন পুরনো মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম। এ উদ্যোগ বা পরিকল্পনার আওতায় সব ধরনের মামলা থেকে সবচেয়ে পুরনো ১০টি মামলা চিহ্নিত করে সেই নথির ওপর ওই মর্মে একটি স্টিকার লাগিয়ে দিতাম। বারের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম এসব পুরনো ও নির্বাচিত মামলায় কোনো মূলতবি দেওয়া হবে না। এ পরিকল্পনার আওতায় অতি পুরনো মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
জেলায় একজন জেলা জজের বদলি হলে তার ধ্যান ধারণারও বদলি হয়ে যায়। আমার বদলির পর ওই পরিকল্পনা মতো আর পুরনো মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আশার কথা, নিম্ন আদালতের মামলা নিষ্পত্তিসহ সার্বিক কাজকর্ম তদারকি করার জন্য বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী মহোদয় সাতটি বিভাগে সাতজন বিচারপতির নেতৃতে সাতটি মনিটরিং কমিটি গঠন করেছেন এবং এ কমিটি আমার জানা মতে নিম্ন আদালতের কাজকর্ম দেখাশোনা করে যাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এ উদ্যোগের সুফল ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। ২০২২ সালে নিম্ন আদালতে ১৪ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৭টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং তার বিপরীতে ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার ৯৪% অর্থাৎ দাখিলকৃত মামলার শতকরা ৯৪ ভাগ মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়েছে। দায়েরের সমপরিমাণ মামলা বা তার চেয়ে বেশি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারলে মামলাজট কমে যাবে। আমার বিবেচনায় এ অগ্রগতি মূলত মনিটরিং ব্যবস্থার জন্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। মনিটরিং কমিটির জন্য নিম্ন আদালতের বিচারকেরা যেমন তাদের অভাব অভিযোগগুলো সহজে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নোটিসে আনতে পারবেন, তেমনি তাদেরও একটি জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যেখানেই জবাবদিহির ব্যবস্থা আছে সেখানেই আপনি কিছু দায়িত্বশীল আচরণ ও কাজ আশা করতে পারেন।
এবার উচ্চ আদালত নিয়ে কিছু কথা বলি, যেখানে আমি বিগত ১৩টি বছর বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছি। উচ্চ আদালতের নাম মূলত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সংবিধানের ৯৪ নম্বর আর্টিক্যাল অনুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের সংবিধান ০৪.১১.১৯৭২ তারিখে গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে তার আগে কি স্বাধীন বাংলাদেশে উচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট ছিল না? অবশ্যই ছিল। অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২, তারিখ ১১ জানুয়ারি এর ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই তারিখেই বাংলাদেশ হাই কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ওইদিনই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বাংলাদেশ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন এবং ১২ জানুয়ারি শপথ প্রদান করেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য ওই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এটা সর্বজন বিদিত যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন এবং কী রকম জনসমুদ্র তাকে সংবর্ধিত করেছিল তা আমরা দেখেছি ও জানি। বাংলাদেশে পদার্পণের পর তাঁর কী রকম ব্যস্ততা থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। ওই রকম তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও কোনো বিলম্ব না করে পরদিন ১১ জানুয়ারি তিনি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ প্রণয়ন এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং তার এক দিনের মধ্যে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান। এসব কিছু তার প্রশাসনিক সক্ষমতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়কের চরিত্রের সামান্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত মামলাসমূহের বিচারের জন্য ১৬ আগস্ট, ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ হাই কোর্টে আপিল বিভাগ গঠন করা হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী ভাষণে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ও বাংলা ভাষায় রায় প্রদানের ওপর জোর দেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আজও আমরা অধিকাংশ রায় বাংলা ভাষায় দিতে পারিনি। উক্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম উপস্থিত ছিলেন। ইদানীং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উদ্বোধনী দিবসকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালন করা হয়।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ হাই কোর্টে প্রধান বিচারপতি বাদে ১০ জন বিচারপতি, একজন অ্যাটর্নি জেনারেল, একজন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, দুজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও চারজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন। আমার মনে হয় এর পাশাপাশি ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও আইন অফিসারের সংখ্যা উল্লেখ করলে আমাদের সার্বিক উন্নতি আমরা বুঝতে পারব। ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বাদে আপিল বিভাগে সাতজন বিচারপতি এবং হাই কোর্ট বিভাগে ৯৫ জন বিচারপতি আছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল পদে একজন, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল পদে তিনজন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ৬২ জন এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ১৪৮ জন তাদের কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৭২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মোট ২০ হাজার ৫৬৭টি মামলা হাইকোর্ট বিভাগে বিচারাধীন ছিল। ওই সময়ে হাই কোর্টে ১০ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। সে বিবেচনায় একজন বিচারপতির বিপরীতে ২ হাজার ৫৬টি মামলা বিচারাধীন ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ৩১ ডিসেম্বর হাই কোর্ট বিভাগে মোট ৫ লাখ ১২ হাজার ৫৭৬টি মামলা বিচারাধীন ছিল। ২০২১ সালে হাই কোর্ট বিভাগে ৯২ জন বিচারপতি কর্মরত ছিলেন। সে বিবেচনায় ২০২১ সালে একজন বিচারপতির বিপরীতে ৫ হাজার ৫৭১টি মামলা বিচারাধীন ছিল। যে কোনো বিবেচনায় এটি অনেক বেশি।
একজন বিচারপ্রার্থী দ্রুততম সময়ে উচ্চ আদালত থেকে তার মামলার সিদ্ধান্ত পাবেন, এটি মানুষের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। আমরা গণমানুষের এই আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি? আজ যেদিন এ লেখা লিখছি সেদিন (অর্থাৎ ১২.০৩.২০২৩ ইং তারিখে) হাইকোর্ট বিভাগের কজলিস্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ১৯৮৮ সালের ফৌজদারি আপিল, ১৯৯১ সালের দেওয়ানি রিভিশন ও ১৯৯৫ সালের দেওয়ানি ফার্স্ট আপিল পেন্ডিং আছে। অর্থাৎ এ মামলাগুলো যথাক্রমে ৩৫, ৩২ ও ২৮ বছর যাবৎ পেন্ডিং আছে এবং এর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
হাইকোর্টের বিচারপতি এবং আইনজীবীরা কাজ করেন না এমন নয় অথবা বিষয়টি এমন নয় যে বিচারকদের গাফিলতির জন্য বিপুল পরিমাণ মামলা বিচারের অপেক্ষায় পড়ে আছে।
কোনো পরিসংখ্যানে ২০২০ ও ২০২১ সাল উল্লেখ করতে চাই না, কারণ ওই দুটি বছর করোনাভাইরাসের জন্য স্বাভাবিকভাবে কোর্টের কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। ২০১৮ সালে হাই কোর্ট বিভাগে মোট ৪৯ হাজার ৩৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। ওই বছর ৯৫ জন বিচারপতি হাই কোর্ট বিভাগে কর্মরত থাকায় গড়ে একজন বিচারপতি ৫১৬টি করে মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। পরিসংখ্যানের দিক থেকে এটি কম নয়। কিন্তু এত নিষ্পত্তির পরেও বিপুল পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় জমে আছে।
মূলত বিচারপতির সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং নিষ্পত্তিকৃত মামলার তুলনায় প্রচুর নতুন মামলা হাই কোর্টে দাখিল হওয়ার কারণে অনেক নিষ্পত্তি করেও পেন্ডিং মামলার জট কমানো যাচ্ছে না।
২০১৮ সালে ৮৮ হাজার ৮০১টি মামলা হাই কোর্ট বিভাগে দায়ের হয়েছিল, ওই বছর নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪৯ হাজার ৫৩টি মামলা। হাই কোর্টে বেশি বেশি মামলা দায়েরের অনেক কারণ আছে। ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় মানুষ তথা মামলার পক্ষগণ সহজেই ঢাকায় এসে মামলা দায়ের করতে পারছে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানুষের মধ্যে ধৈর্য ও সহনশীলতা কমে যাওয়ায় নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ পক্ষগণ পরাজয় মেনে নিতে চায় না, তারা হাই কোর্টে মামলা করে ফলাফল অনুকূলে নেওয়ার চেষ্টা করে। আগে এমন একটি সময় ছিল, যখন হাই কোর্টের আইনজীবীরা ঢাকায়ই থাকতেন, তাদের সঙ্গে এলাকার বা লোকাল বারের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে যারা হাই কোর্টে প্র্যাকটিস করেন তাদের অনেকেই নিয়মিত এলাকায় যান এবং লোকাল বারের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখেন। ফলে মামলার পক্ষগণ সহজেই হাই কোর্টের অ্যাডভোকেটদের নৈকট্য লাভের সুযোগ পাচ্ছেন এবং ফলশ্রুতিতে সহজেই হাই কোর্টে মামলা দায়ের করতে পারছেন। আগে হাই কোর্টে অ্যাডভোকেটের সংখ্যা অনেক কম ছিল, কিন্তু বর্তমানে হাই কোর্টে প্রায় ১৩ হাজার অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্ত আছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। যেহেতু অনেক অ্যাডভোকেট এখানে কাজ করেন তাই মামলার পক্ষগণ অল্প খরচে মামলা করার সুযোগ পাচ্ছে এবং এ কারণে মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে।
১৯৮১ সালে আমি যখন বিচার বিভাগে যোগদান করি তখন বিচার বিভাগে ১৮০ জন বিচারক কর্মরত ছিলেন। যদি সবার জন্য একটি কোর্ট ধরি সেক্ষেত্রে ওই সময় ১৮০টি কোর্ট ছিল। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিম্ন আদালতে কোর্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি ১৯৮১ সালে মুন্সেফ পদে বরিশালে যোগদান করি। ১৯৮২ সালে ঢাকায় জেলা জজসহ জেলা জজ পদমর্যাদার মোট চারটি কোর্ট ছিল। অপর তিনটি কোর্ট হলো- বিভাগীয় স্পেশাল জজ, শ্রম আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল। উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে ঢাকা জেলার মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ মহাকুমা অন্তর্ভুক্ত ছিল। মহাকুমাতে তখন জেলা জজ ছিল না। শুধু মুন্সেফ কোর্ট ও সাবজজ কোর্ট ছিল। বৃহত্তর জেলার সাবেক মহাকুমাগুলোতে বর্তমানে জেলা জজ পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা কর্মরত আছেন। ঢাকা জেলায় বর্তমানে ঢাকার জেলা জজসহ জেলা জজ পদমর্যাদার ৪৬ জন জেলা জজ বিভিন্ন কোর্টের দায়িত্বে আছেন। তেমনি বরিশালে ১৯৮২ সালে একজন জেলা জজ ছিলেন। বর্তমানে সেখানে জেলা জজ পদমর্যাদার ১০ জন কর্মকর্তা বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন। একইভাবে সিলেটে জেলা জজসহ জেলা জজ পদমর্যাদার নয়জন কর্মকর্তা বিভিন্ন পদে কর্মরত আছেন।
নিম্ন আদালতে বর্তমানে ১ হাজার ৮১০টি কোর্ট চালু আছে। যার মধ্যে জেলা জজ ও সম পদপর্যাদার কোর্টের সংখ্যা ২৫৯টি এবং অতিরিক্ত জেলা জজের কোর্টের সংখ্যা ১১৯টি। জেলা জজ ও সম পদমর্যাদার কোর্ট এবং অতিরিক্ত জেলা জজগণের কোর্টের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে মামলা হাই কোর্টে করতে হয়। নিম্ন আদালতে কোর্টের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের নিষ্পত্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলশ্রুতিতে হাই কোর্টে মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারি অফিসগুলো থেকে বিভিন্ন সময় যেসব আদেশ প্রদান করা হয়, অনেক সময়ই সেগুলো আইননির্ভর নয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ওইসব আদেশের বিরুদ্ধে সহজেই রিট মামলা দায়ের করে প্রতিকারের আশায়। সর্বোপরি বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ১৭ কোটির চেয়ে একটু বেশি। অথচ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর একাধিক ভাষণে জনসংখ্যার কথা বলেছেন সাড়ে ৭ কোটি। বর্তমানে এ বিপুল পরিমাণ জনসংখার জন্য স্বাভাবিকভাবেই মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এসবের চেয়েও সর্বশেষ ও মূল কারণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয় সুপ্রিম কোর্টের ওপর মানুষের সহজাত আস্থার জন্য বিচারপ্রার্থী মানুষ সুপ্রিম কোর্টে মামলা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং এভাবে অনেক কারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টে মামলার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এটি বাস্তব সত্য। এ মামলা নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিগণ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে শুধু বিচারপতিগণ ইচ্ছা করলেই অধিক হারে নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে অ্যাডভোকেটদের সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
হাইকোর্ট বিভাগে দুই ধরনের বেঞ্চ থাকে। একটি মোশন বেঞ্চ অপরটি শুনানির বেঞ্চ। মোশন বেঞ্চে মূলত মামলা ফাইলিং করে শুনানি করতে হয়। সব মোশন বেঞ্চই মোশন কেসে আদেশ প্রদান বাদেও তার এখতিয়ারাধীন মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি করতে পারেন। কিন্তু ফৌজদারি ও রিট মোশন বেঞ্চগুলো মোশন শুনানি করার পর হাতে খুব কম সময় পান মূল মামলার শুনানি করার জন্য। তাই ইচ্ছা করলেও সময়ের অভাবে মোশন বেঞ্চগুলো অধিকহারে মূল মামলার শুনানি গ্রহণ করতে পারে না। তবে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও মোশন বেঞ্চগুলো শুনানির জন্য মামলা ফিক্স করে এবং শুনানি করে থাকে।
কিন্তু যে বেঞ্চগুলো শুনানির জন্য নির্ধারিত সে বেঞ্চগুলোকে আমরা সাধারণত হিয়ারিং বেঞ্চ বলি। সাধারণভাবে হিয়ারিং বেঞ্চগুলো তাদের সময়কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারে না। হাই কোর্টে যেসব মামলা বিচারাধীন সেগুলোতে ইতোপূর্বে ২/১টি রায় হয়েছে। সুতরাং অ্যাডভোকেটরা শুনানিতে অংশগ্রহণ করলে বিচারকের পক্ষে মামলাটি সহজে নিষ্পত্তি করা সম্ভব। এটি ঠিক যে একটি মামলায় একজন বিচারপতি আইনজীবীর অনুপস্থিতিতে নথি দেখে নিষ্পত্তি করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে এটি করা কঠিন। কারণ নিম্ন আদালতের প্লিডিংস দেখতে হবে। তারপর রায় ও অন্যান্য সাক্ষ্য যদি থাকে তাও তাকে শুনতে বা দেখতে হবে। আইজীবীদের উপস্থিতি বাদে বিচারকের একার পক্ষে এগুলো দেখা বা পড়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু মজার কথা হলো যাদের উপস্থিতি বাদে শুনানি করা সম্ভব নয় তাদের অর্থাৎ আইনজীবীদের হিয়ারিং বেঞ্চে বিশেষ করে ফৌজদারি মামলার শুনানির সময় পাওয়া যায় না। হাই কোর্ট বিভাগের মোশন বেঞ্চগুলোর ভিতরে অ্যাডভোকেটদের জন্য নির্ধারিত আসন পাওয়া কষ্টকর, অর্থাৎ আপনি বসার একটু জায়গা পাবেন না, এমনকি ভোরবেলা সেখানে ঢুকতেও কষ্ট হয়। কিন্তু হিয়ারিং বেঞ্চে বিশেষ করে দেওয়ানি আপিল ও ফৌজদারি মামলার হিয়ারিং বেঞ্চে কোর্ট শুরুর সময় দু-চারজন আইনজীবী উপস্থিত থাকলেও তারা সময় নিয়ে অন্যত্র চলে যান, এরপরই বেশির ভাগ হিয়ারিং বেঞ্চগুলোতে আইনজীবী পাওয়া যায় না। ফলে হিয়ারিং বেঞ্চগুলো কাক্সিক্ষত পর্যায়ে মামলা শুনানি করতে পারে না।
হিয়ারিং বেঞ্চে বিশেষ করে ফৌজদারি মামলার বেঞ্চগুলোতে মামলা শুনানি করার ব্যাপারে অ্যাডভোকেটদের এই যে আগ্রহের অভাব, এটি কি কেবল তার জন্য? মামলা দায়েরের পর শুনানি করার বিষয়ে পক্ষদের আগ্রহ বিভিন্ন কারণে কমে যায়। হিয়ারিং বেঞ্চে শুনানির সময় আইনজীবীদের অনুপস্থিত থাকার অনেক কারণ আছে। প্রথমত, আইনজীবীরা মামলা দায়েরে এবং মোশন কেসে শুনানিতে বেশি লাভবান হন, তাই ওই মামলাগুলোর ব্যাপারে তারা যতটা সিরিয়াস থাকেন অন্য মামলার ব্যাপারে ততটা সিরিয়াস থাকেন না।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, একজন বিচারপ্রার্থী একটি মামলা একজন আইনজীবীর মাধ্যমে হাই কোর্ট বিভাগে দায়েরের পর শুনানির সময় আগ্রহহীন হলেন কেন? এর অনেক কারণ আছে। তবে মোটা দাগের কারণগুলো নিয়ে সংক্ষেপে দু-একটি কথা বলা যেতে পারে। প্রথমেই দেওয়ানি মামলার বিষয়ে ধরা যাক। সাধারণত পরাজিত পক্ষ যুগ্ম জেলা জজের রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল দায়ের করে। এ ছাড়াও জেলা জজ বা অতিরিক্ত জেলা জজগণ আপিলে যে রায় প্রদান করেন তার বিরুদ্ধে হাই কোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করতে হয়। এ ছাড়া নিম্ন আদালতের বেশ কিছু আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন করা যায়। আপিল বা রিভিশন যেটিই দায়ের করা হোক না কেন খেয়াল রাখতে হবে নিম্ন আদালতে যে পক্ষ কাক্সিক্ষত প্রতিকার পেতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই পক্ষ হাই কোর্ট বিভাগে এসেছে। সে আপিল বা রিভিশন যাই দায়ের করুক না কেন, দায়ের করে ক্ষেত্রমত স্টে বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রার্থনা করে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দরখাস্তকারী বা আপিলকারী স্টে বা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেয়ে থাকে। অর্থাৎ হাই কোর্টে মামলা দায়েরের পর নিম্ন আদালতে বিজয়ী পক্ষের চেয়ে তার (পরাজিত পক্ষ) অবস্থান ভালো হয়ে যায়। এই ভালো অবস্থানের কারণে আপিলকারী বা রিভিশনকারী সহসা আর দেওয়ানি মামলাগুলো শুনানি করতে চায় না। যেহেতু পক্ষগণের কোনো তাড়া বা গরজ থাকে না, তাই অ্যাডভোকেটরাও মামলা করার কোনো তাগিদ অনুভব করে না। এরকম দেওয়ানি মামলা শুনানি করার তাগিদ অনুভব করার জন্য আমার মনে হয় মামলা দায়েরের পর যে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিকার দেওয়া হয় তার সর্বোচ্চ একটি সময়সীমা থাকা প্রয়োজন। হতে পারে সেটি ৫, ৭ বা ১০ বছর। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মূল মামলার শুনানি না করলে অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের কার্যকারিতা লোপ পাবে। এরকম একটি বাধ্যবাধকতা থাকলে ওই সময়সীমার মধ্যে মামলা দায়েরকারী শুনানি করতে বাধ্য থাকবে।
উক্তরূপ একটি বাধ্যবাধকতা না থাকলে দেওয়ানি মামলার পক্ষগণকে শুনানিমুখী করা যাবে না। বাস্তবিকতার আলোকে আপনি দেখতে পাবেন যতগুলো রিভিশন ও আপিল হাই কোর্টে শুনানির জন্য ফিক্স হয় তার শতকরা ৮০ ভাগ মামলা প্রতিপক্ষ অর্থাৎ নিম্ন আদালতে যে বিজয়ী হয়েছিল তার পদক্ষেপের জন্য ফিক্স হয়। পরাজিত পক্ষ হাই কোর্ট বিভাগে মামলা দায়ের করার পর আবার নতুন করে আর একটি সিদ্ধান্ত তার বিপক্ষে যাক, সে ওই রকম কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না, তাই মামলার শুনানি যতদূর সম্ভব সে এড়িয়ে চলতে চায়।
লেখক : বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।