সৈয়দ রিয়াজ মোহাম্মদ বায়েজিদ : আদালতে একজন ব্যক্তির চিঠি, ই-মেইল বা টেলিগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে মামলা করার আইন রয়েছে। কিন্তু এই বিষয়টি অনেকেরই অজানা। আদালতে মামলা করার জন্য বিধিবদ্ধ আইন যেমন রয়েছে তেমন অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতেও মামলা করার দরজা খোলা রয়েছে। অতীব জরুরী ও জনস্বার্থে বা জনগুরুত্বপূর্ণ যদি কোন বিষয় পরিলক্ষিত হয় বা কোথাও কোন আইনের লঙ্ঘন, অন্যায় বা অপরাধ সংঘটিত হয় তবে যে কোন ব্যক্তি মেসেজ, চিঠি, ইমেইল, টেলিগ্রাম ইত্যাদি বার্তা প্রদানের মাধ্যমে উচ্চ আদালতকে অবহিত করলে উচ্চ আদালত যদি মনে করেন এর গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তবে তা ‘রিট পিটিশন’ হিসাবে গণ্য করতে পারেন এবং এর উপর ভিত্তি করে একটি আদেশ প্রদান করতে পারেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয় তবে মহামান্য হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশনকে নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। এটাকে মহামান্য হাইকোর্টের বিশেষ আদি এখতিয়ার (special original jurisdiction) বা রিট এখতিয়ার বলা হয়।
যে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলেই আবেদন করতে পারে এবং মহামান্য হাইকোর্ট তার এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিধিমালা ১৯৭৩ এ কিভাবে ‘আবেদন’ করা হয় তার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিধিতে ‘সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি’ কিভাবে প্রতিকার পাওয়ার জন্য আবেদন করবে তার সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। এই বিধান উল্লেখ থাকলেও এই বিধানের বাইরেও একটি সহজ মাধ্যম হচ্ছে বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার বা Epistolary Jurisdiction.
‘এপিস্টোলারী’ শব্দটি উৎপত্তি হয় ‘এপিস্টোল’ হতে। ‘এপিস্টোল’ শব্দটি এ্যাংলো ফ্রান্স বা ল্যাটিন শব্দ। ‘এপিস্টোল’ অর্থ হচ্ছে মেসেজ, চিঠি বা বার্তা। কোন জরুরী কিংবা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদি কোন ব্যক্তি প্রধান বিচারপতি বা অন্য কোন বিচারপতি বা রেজিষ্ট্রার বরাবর কোন বিষয়ে চিঠি বা ই-মেইল প্রদানের মাধ্যমে তথ্য পাঠিয়ে অবগত করেন তবে বিষয়টি অতীব জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচিত হলে মহামান্য হাইকোর্ট সেটিকে রিট পিটিশন (writ petition) হিসাবে গণ্য করতে পারেন। এছাড়া কোন পত্রিকার সংবাদ কিংবা কোন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদও একইভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
জনস্বার্থে মামলার ক্ষেত্রে বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার (Epistolary Jurisdiction) একটি সহজ মাধ্যম যার মাধ্যমে সমাজের গরীব এবং অসহায় অবস্থার জনসাধারণের জন্য ন্যায় বিচার পাওয়ার একটি উত্তম ও সহজ পথ। ন্যায়বিচার পাওয়ার আইনটি বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক অধিকার। সমাজের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার বা (Epistolary Jurisdiction) একটি নতুন কৌশল বা পদ্ধতি বলা যায়।
এ বিষয়ে ভারতের ল্যান্ডমার্ক মামলা রয়েছে – “সুশীল বাত্রা বনাম দিল্লী এডমিনিস্ট্রেশন” এ মামলায় একটি চিঠি গ্রহণের মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি পরবর্তীতে চিঠিকে রিট পিটিশন হিসাবে গণ্য করেন। “গাইডিওন বনাম ওয়াইন রাইট”এ মামলায় ইউ.এস. সুপ্রীম কোর্ট একজন প্রিজনার এর নিকট হতে একটি ‘পোস্টকার্ড’ গ্রহণ করেছেন এবং সেটিকে রিট পিটিশন হিসাবে গণ্য করেছেন।
“এস.পি. গুপ্তা বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া” মামলায় আদালত বলেছেন,“যেখানে আইন লঙ্ঘিত হয়েছে সেখানে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ তাদের দারিদ্রতা, অসহায়ত্ব বা অক্ষমতা অথবা সামাজিকভাবে ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত অবস্থায় আছেন, আদালত হতে প্রতিকার নিতে যারা অক্ষম তাদের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি চাইলে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন।”
অবহেলিত বা সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তির পক্ষে লিখিত চিঠি, টেলিগ্রাম বা ই-মেইলের মাধ্যমে তথ্য মহামান্য হাইকোর্টের বিচারপতিকে জানিয়ে ন্যায় বিচার প্রদানের যে কৌশল অবলম্বন করাহয়। তাই ‘এপিস্টোলারী’ এখতিয়ার হিসাবে পরিচিত।
“ড. ফসটিনা পেরেরা বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য” ৫৩ ডিএলআর (হাইকোর্ট বিভাগ) ৪১৪ পৃষ্ঠা; এ মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ড. ফসটিনা পেরেরা ২০০১ সালে প্রধান বিচারপতিকে একটি চিঠি লিখেন। তিনি চিঠিতে জানান, “কিছু বিদেশী নাগরিক সাজা ভোগ করার পরও কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। এই বিষয়টি আমলে গ্রহণ করে রুল ইস্যু করেন এবং পরবর্তীতে সকল বিদেশী বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। বাংলাদেশে এটি একটি “ল্যান্ডমার্ক মামলা”।
“দর্শন মাসিহ এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র” এটি পাকিস্তানের বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার প্রয়োগে উল্লেখযোগ্য মামলা। দর্শন মাসিহ নামের একজন শ্রমিক প্রধান বিচারপতিকে কিছু শ্রমিকের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে একটি টেলিগ্রামপাঠান। পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্ট টেলিগ্রামটিকে পরবর্তী সাংবিধানিক মামলা হিসাবে গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এক আইনজীবী পত্রিকায় প্রকাশিত “বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে শিশুকে সাজা দেওয়ার” বিষয়ে ই-মেইলে মাননীয় বিচারপতিকে বার্তা পাঠান। চিঠিতে আইনজীবী উল্লেখ করেন- “শিশু আইন অনুযায়ী কোন শিশুকে সাজা দেওয়ার এখতিয়ার ভ্রাম্যমাণ আদালতের নেই। ফলে প্রদত্ত সাজা এখতিয়ার বহির্ভূত। মাননীয় বিচারপতি বিষয়টি আমলে নেন এবং দুই শিশুকে মুক্তির নির্দেশ প্রদান করেন। এটি বাংলাদেশে বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার প্রয়োগের উল্লেখযোগ্য মামলা।
আমাদের দেশের অবহেলিত, অসহায় ও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যারা মামলার খরচ চালাতে অক্ষম এবং যারা তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন তাদের জন্যও সবসময় আদালতের দরজা খোলা। সুপ্রীম কোর্টের ‘এপিস্টোলারী এখতিয়ার’ বা “বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার” এর মাধ্যমে অসহায় ও অবহেলিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের দ্রুত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
ভারত, পাকিস্তান ও আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সহজ মাধ্যম বা বিধান থাকায় অসহায় মানুষ দ্রুত তাদের ন্যায় বিচার পাচ্ছে। বলা যায়, বার্তাপ্রসূত এখতিয়ার হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অতীব সহজ ও ব্যয়বিহীন মাধ্যম। মানুষের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আদালতের প্রক্রিয়া যতই সহজ হবে বা মানুষ যত সহজেই আদালতের কাছে পৌছাতে পারবে দেশের মানুষ তার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।