সিরাজ প্রামাণিক : নারী বা শিশু কারও দ্বারা নির্যাতনের শিকার হলেই তার নাম পরিচয় সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করা যাবে না। যদি কেউ এ বিধান লংঘন করে তা প্রচার বা প্রকাশ করে তবে দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। {নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৪(১)}
কোনো নারী বা শিশু যদি কারও দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন কিংবা অপহরণের শিকার হন কিংবা যৌতুকের শিকার হন, বিদেশে পাচার কিংবা কোন নারীকে অসৎ উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয় কিংবা পতিতাবৃত্তির উদ্দেশ্যে ভাড়া করা ইত্যাদি অপরাধের শিকার হয়েছেন এমন নারী বা শিশু সম্পর্কিত বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাবে যাতে ঐ নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়৷
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৪(১) উপ ধারার বিধান লংঘন করা হলে দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন৷
আবার ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৪৬ ধারায় শিশু সম্পর্কিত রিপোর্ট বা ছবি প্রকাশের দন্ড হিসেবে বলা হয়েছে যে, এই আইনের অধীন বিচারাধীন কোন মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোন প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না, যার দ্বারা শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়।
সম্প্রতি প্রথম আলো মহান স্বাধীনতা দিবসে একটি শিশুর ছবির ক্যাপশন এর সাথে একজন দিনমজুরের বক্তব্যের অসংগতি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় এবং সে সাংবাদিক গ্রেফতার হয়। কোনো ব্যক্তি ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের ৪৬ এর ২ (১) উপধারা লঙ্ঘন করলে সেটা এই আইনের অধীন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং উক্ত অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক ১ (এক) বৎসর কারাদণ্ড অথবা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অনুরূপভাবে কোন কোম্পানী, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান উপ-ধারা (১) এর বিধান লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানী, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন অনধিক ২ (দুই) মাসের জন্য স্থগিত রাখাসহ সেটাকে অনধিক ২ (দুই) লক্ষ টাকা জরিমানা আরোপ করা যাবে।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইনটি সংশোধিত হয়ে ৮১ ধারায় সংবাদ মাধ্যম কর্তৃক কোনো গোপন তথ্য প্রকাশের দণ্ড প্রদান সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারা অনুসারে, শিশু আইনের অধীনে বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যার মাধ্যমে শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়।
ভারতের একটি দৃষ্টান্ত। নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে এক নারীকে ট্রেনে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা তখন সারাবিশ্বেই আলোড়ন তৈরি করে এবং এর বিরুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। কিন্তু এত আলোচিত হওয়ার পরও ধর্ষিতা মেয়েটির প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি সংবাদমাধ্যমে।
‘দামিনী’ ছদ্মনামে সংবাদমাধ্যম তার খবর প্রচার করে। এর কারণ ভারতের দন্ডবিধির ২২৮-ক ধারা অনুসারে ধর্ষিতার নাম-পরিচয় প্রকাশ করা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে ধর্ষিতা যদি নিজে চান তাহলে তিনি নিজের নাম প্রকাশ করতে পারেন।
এছাড়া প্রশাসন বা সংবাদমাধ্যম নিজ থেকে ধর্ষিতার নাম-পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে পারে না। এমনকি পুলিশ, র্যাব প্রেস কনফারেন্স করেও নির্যাতিত নারী ও শিশুর নাম পরিচয় প্রকাশ করতে পারবেন না। অবশেষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ধর্ষিতার পিতা নিজ থেকে সেই ধর্ষিতা তরুণীর নাম জ্যোতি সিং পাণ্ডে প্রকাশ করেন। এর আগ পর্যন্ত সারা পৃথিবী তার নাম জানতে পারেনি।
আইনের প্রতি ভারতীয় সরকার এবং গণমাধ্যমগুলোর এই আন্তরিকতা সত্যিই প্রশংসাযোগ্য। আমরাও আশাকরি বাংলাদেশ সরকার এবং গণমাধ্যম আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। তবেই আমাদের সংবিধানের শাশ্বত বাণী চিরন্তন রুপভাবে।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক। ই-মেইল : seraj.pramanik@gmail.com