মো: ফারুক রেজা : শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক প্রচলিত আইনে মানব পাচার বলতে কি বুঝায়? মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ অনুসারে- মানব পাচার অর্থ কোন ব্যক্তিকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বা বলপ্রয়োগ করিয়া; বা প্রতারণা করিয়া বা উক্ত ব্যক্তির আর্থ-সামাজিক বা পরিবেশগত বা অন্য কোন অসহায়ত্বকে (vulnerability) কাজে লাগাইয়া; বা অর্থ বা অন্য কোন সুবিধা (kind) লেনদেন-পূর্বক উক্ত ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ রহিয়াছে এমন ব্যক্তির সম্মতি গ্রহণ করিয়া; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বা বাহিরে যৌন শোষণ বা নিপীড়ন বা শ্রম শোষণ বা অন্য কোনো শোষণ বা নিপীড়নের (exploitation) উদ্দেশ্যে বিক্রয় বা ক্রয়, সংগ্রহ বা গ্রহণ, নির্বাসন বা স্থানান্তর, চালান বা আটক করা বা লুকাইয়া রাখা বা আশ্রয় দেওয়া (harbour)।
অন্যভাবে বলতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রম, যৌন দাসত্ব করানোর উদ্দেশ্যে দেশের অভ্যন্তরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাচারের মত অবৈধ মানব বাণিজ্যকে মানব পাচার বলা হয়। মানব পাচার বল প্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত একটি অপরাধ যা মানুষের মুক্ত চলাচলের অধিকারকে হরণ করে। মানব পাচার মূলত নারী এবং শিশু পাচারকেই ইঙ্গিত করে থাকে।
মানব পাচারের ধরণ
- অভ্যন্তরীণ পাচার- সাধারনত নারী ও শিশু (পতিতাবৃত্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, ইটের ভাটায় শ্রম শোষন, ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রয় ইত্যাদি কাজে);
- আন্তঃসীমান্ত বা দেশের মধ্যে পাচার- নারী ও শিশু (স্থল সীমান্ত দিয়ে বৈধ ও অবৈধ পথে);
- আন্তর্জাতিক পাচার- শ্রমিক পর্যায়ের নারী ও পুরুষ (মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ ও আফ্রিকায় পাচার);
- অভিবাসনের নামে পাচার- নারী ও পুরুষ (কর্মক্ষেত্রে চুক্তি বদল, শোষণ, নিপিড়ণ, অমানবিক কাজে বাধ্য ও স্বাধীনতা হরণ);
- সাগর পথে পাচার- নারী-পুরুষ ও শিশু (সম্পূর্ন অবৈধ পথে দাস শ্রমিক হিসাবে শোষণ ।
চাকরি বা কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গমনের পূর্বে ভালোভাবে দেখে ও বুঝে নিন সব কিছু ঠিক আছে কিনা। তাই সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসনের জন্য নিম্নের বর্ণিত ধাপগুলো অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরী-
- পাসপোর্টে নিজের নাম, ঠিকানা সঠিক আছে কিনা বা নাম বা ঠিকানার বানান সঠিক আছে কিনা তা চেক করে নিতে হবে। সম্বভ হলে নিজ দায়িত্বে পাসপোর্ট তৈরী করবেন।
- সঠিক তথ্য দিয়ে নিজের পাসপোর্ট নিজেই পূরণ করুন। অন্যথায় পাসপোর্টে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে;
- চেক, পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট ছাড়া অর্থাৎ বিনা রশিদে কোন বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি, এজেন্ট বা দালালের সাথে টাকা লেনদেন করবেন না। পরিচিত ব্যক্তি, বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি, এজেন্ট বা পরিচিত দালাল ছাড়া অপরিচিত মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া উচিত না।
- যার মাধ্যমে (দালাল বা বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি) বিদেশে যাচ্ছেন তার নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর সঠিকভাবে জেনে এবং যাচাই করে সংরক্ষণ করুন;
- চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার আগে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET) এর ডেটাবেজ-এ নাম নিবন্ধন করুন;
- বিদেশে কর্মসংস্থানের চুক্তিপত্রটি (প্রয়োজনে অনুবাদ করে) সঠিক কিনা তা বিএমইটি (BMET), বায়রা (BAIRA), জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস (DEMO) বা সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস থেকে যাচাই করে নিন;
- নির্ধারিত হাসপাতাল থেকে মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পর বিশ^স্ত কোন ডাক্তারের কাছ থেকে শারীরিক ফিটনেসের সত্যতা যাচাই করে নিন;
- আপনার ভিসা সঠিক কিনা তা BMET, DEMO বা সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস বা দপ্তর থেকে যাচাই করে নিন, এছাড়াও বিমানের টিকিটটি ঠিক আছে কিনা তা BMET, DEMO অফিস থেকে বা অনলাইনে যাচাই করুন;
বিদেশে যাবার আগে করণীয়
- চাকরি নিয়ে বিদেশে যাবার আগেই BMET থেকে বহির্গমন ছাড়পত্রসহ স্মার্ট কার্ড সংগ্রহ করে নিন;
- দেশে নিরাপদে টাকা পাঠানোর জন্য বিদেশে যাওয়ার আগে ব্যাংকে নিজের নামে একটি এবং পরিবারের নির্ভরযোগ্য সদস্যের সাথে যৌথভাবে আর একটি একাউন্ট খুলুন;
- আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হলে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক হতে জামানতবিহীন ঋণ গ্রহণ করুন;
- বিদেশে যাওয়ার আগে DEMO অফিস থেকে প্রদত্ত বিস্তারিত দিকনির্দেশনামূলক ব্রিফিং সেশনে অংশগ্রহণ করুন;
- বিদেশে যাওয়ার আগে সকল কাগজ পত্রের এক কপি নিজের সাথে এবং আর এক কপি পরিবারের কোন সদস্যের কাছে রেখে দিন;
- গন্তব্য দেশের আইন, নিয়ম-কানুন মেনে চলুন এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকুন। কোন সমস্যায় পড়লে সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস/মন্ত্রনালয়ে লিখিতভাবে বা অনলাইনে অভিযোগ দাখিল করুন।
শ্রম অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণের জন্য বাংলাদেশে যেসব সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জড়িত সেগুলো হলো-
- জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (BMET), ৮৯/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।
- বাংলাদেশ বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও সার্ভিসেস লি: (BOESL); প্রবাসী কল্যাণ ভবন (৫ম তলা), ৭১-৭২, এলিফ্যান্ড রোড, ইস্কাটন গার্ডেন, ঢাকা।
- লাইসেন্সধারী প্রাইভেট বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (BAIRA)
- ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ভবন, ৭১-৭২, পুরাতন এলিফ্যান্ট রোড, ইস্কাটন গার্ডেন, রমনা, ঢাকা। ওয়েবসাইট (https://probashi.gov.bd/)
পাচারের শিকার হওয়ার পর কোথায় যোগাযোগ করতে হবে
- পাচারের ঘটনা এবং পাচারের শিকার ব্যক্তি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটিকে অবহিত করুন এবং পরামর্শ নিন;
- এলাকায় মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে এরকম সংগঠনের সাথে যোগাযোগ করুন এবং পরামর্শ নিন;
- জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি (DEMO) অফিসে ক্ষতিপূরণের জন্য অভিযোগ দায়ের করুন;
- মানব পাচার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট থানায় অথবা আদালতে মামলা দায়ের করুন;
- জেলা লিগ্যাল এইড অফিস ও সরকারি কৌঁসুলি (PP) অফিসে আইনি সহায়তার জন্য যোগাযোগ করুন।
- যদি সম্ভব হয় আইহনত সকল প্রতিকার পাওয়ার লক্ষে আপনার পক্ষে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করুন।
মানব পাচার প্রতিরোধে কমিটি সমূহ
- জাতীয় মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি- এই কমিটির নেতৃত্বে আছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি;
- জেলা মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি- এই কমিটির নেতৃত্বে আছেন জেলা প্রশাসক;
- উপজেলা মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি-এই কমিটির নেতৃত্বে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও);
- ইউনিয়ন মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটি- এই কমিটির নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
উপরোক্ত কমিটিগুলো মানব পাচার প্রতিরোধে সরকারের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন কমিটি হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও আইন অনুযায়ী মানব পাচার সংক্রান্ত সকল প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরিচালনার সমন্বয়, তদারকি ও মূল্যায়নের জন্য জাতীয় মানব পাচার দমন সংস্থা (National Anti-Human Trafficking Authority) কাজ করে যাচ্ছে।
মানব পাচার অপরাধের শাস্তি
মানব পাচার প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন ‘মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২’। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন আমলযোগ্য, অ-জামিনযোগ্য, অ-আপোষযোগ্য এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৬-১৬ ধারায় পাচার সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের শাস্তির কথা বলা হয়েছে।
- মানব পাচারকারী কোন একক ব্যক্তি হলে তার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা (ধারা-৬);
- মানব পাচারকারী কোন সংঘবদ্ধ দলের সদস্য হলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন ৭ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা” (ধারা-৭);
- কোন ব্যক্তি মানব পাচার অপরাধ করার জন্য প্ররোচনা কিংবা সহযোগিতা করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং সর্বনিম্ন ৩ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং সর্বনিম্ন ২০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন (ধারা-৮);
- মানব পাচার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন পাবেন না। এছাড়া অপরাধসমূহ আপসে মিমাংসা করা যাবে না।
- প্রতারণা, জাল কাগজপত্র ও অবৈধ পথে বিদেশে পাঠানোর নামে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং সর্বনিম্ন ১ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং আইন উপদেষ্টা, মুলতাজিম গ্রুপ।