দেশে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তিদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সহায়তা দেয় সরকারের একটি সংস্থা। জাতীয় আইনগত সহায়তা দেওয়ার সংস্থার মাধ্যমে এই সেবা পাওয়া যায়। জাতীয় আইনগত সহায়তা দেওয়া সংস্থাটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের অধীন পরিচালিত হয়।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে বিনা মূল্যে দেওয়া কার্যক্রমগুলোর মধ্যে আইনি পরামর্শ, আদালতে মামলা পরিচালনা, শ্রমিক সহায়তা, বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি ও তথ্যসেবা রয়েছে।
সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অসহায়-দরিদ্র শ্রমিকদের আইনি সহায়তা দিতে ২০১৩ সালে ঢাকার শ্রম আদালতে ও ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে পৃথক শ্রমিক আইন সহায়তা সেল স্থাপন করা হয়। সারাদেশে শ্রমিক আইন সহায়তা সেল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পেয়েছেন ২৭ হাজার ৭৩৮ শ্রমিক।
সেলের সেবার মধ্যে শ্রমিকদের জন্য রয়েছে— শ্রমিকদের আইনগত পরামর্শ দেওয়া, অনুযোগপত্র তৈরিতে সহযোগিতা, মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সহায়তা, শ্রমিকের পক্ষে মামলা দায়ের-পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ, শ্রমিকের পক্ষে শ্রম আদালতে মামলা পরিচালনায় সহায়তা দেওয়ার মতো বিষয়।
বিনামূল্যে শ্রমিকের সাড়ে ৬ কোটি টাকা আদায়
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার তথ্যানুযায়ী, সেল দুটি থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ২০ হাজার ১৫৫ জনকে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৯৬২ জন পুরুষ, চার হাজার ১৯৩ জন নারী।
একই সময়ে তিন হাজার ২৯৩টি বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে মধ্যস্থতার মাধ্যমে (এডিআর) নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এক হাজার ৯০৪টি নিষ্পত্তি হয়েছে।
বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের ছয় কোটি ৪৮ লাখ ১২ হাজার ৫৬২ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেওয়া হয়েছে। সেলের সহায়তা নিয়ে শ্রমিকদের করা মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ২৯০টি। এর মধ্যে ৫২৬টি মামলা এরই মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে।
সেবা নিতে আসা শ্রমিকদের মধ্যে পুরুষ ও পোশাকশ্রমিক বেশি। বকেয়া বেতন পরিশোধ, সাময়িক বরখাস্ত, চাকরি থেকে অব্যাহতিজনিত সুবিধা, দুর্ঘটনা-মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, অবসরকালীন সুবিধা, চাকরিতে পুনর্বহাল—এমন সব সমস্যা ও অভিযোগ নিয়ে শ্রমিকেরা সেলে সেবা নিতে আসেন।
জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার মাধ্যমে শ্রমিক সহায়তা সেল দুটির কার্যক্রম চলছে। আগের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক শ্রমিক এখন সেলের মাধ্যমে সরকারি আইনগত সহায়তাসেবা নিচ্ছেন।
যেভাবে শুরু
২০০০ সালে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান’ আইন করা হয়। এই আইন অনুসারে, ২০০১ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গঠন করা হয়। তবে জনবল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবসহ নানা কারণে সূচনাকাল থেকে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম ছিল স্থবির।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জন্য পৃথক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি জেলা আদালতে সংস্থার কার্যালয় স্থাপন করা হয়।
এখন দেশের ৬৪ জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড (আইনি সহায়তা) কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও রয়েছে লিগ্যাল এইড কমিটি। সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ‘সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কার্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
গত ১৪ বছরে বিনা মূল্যে আইনি সহায়তা পেয়েছেন প্রায় ৯ লাখ মানুষ
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৮২ হাজার ৫৮৮টি মামলা বা বিরোধ বিকল্প পদ্ধতিতে (এডিআর) মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে ১৩৪ কোটি ৯০ লাখ ৬ হাজার ৪৯৮ টাকা আদায় করে দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক এবং সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, গত ১৪ বছরে প্রায় ৯ লাখ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারী, পুরুষ ও শিশুকে বিনা মূল্যে আইনি সেবা দেওয়ার এই কার্যক্রম বড় একটি অর্জন।
অসহায়, দরিদ্র, অসচ্ছল মানুষ যাতে বিনামূল্যে সরকারিভাবে আইনি সহায়তা–পরামর্শ নেন, সে জন্য সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবছরের ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ বিনামূল্যে আইনি সেবার দ্বার উন্মোচন’। আর্থিক অসচ্ছল ব্যক্তিদের বিনামূল্যে আইনিসেবা দিয়ে যাচ্ছে আইনগত সহায়তা দেওয়া সংস্থাটি।
সরকারি আইনি সেবা প্রাপ্তির যোগ্যতা
অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি, যার বার্ষিক গড় আয় সুপ্রিম কোর্টে আইনগত সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে দেড় লাখ এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে এক লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয়।
মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে দেড় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয় এবং যে কোনো শ্রমিক, যার বার্ষিক গড় আয় এক লাখ টাকার ঊর্ধ্বে নয়। যে কোনো শিশু, মানব পাচারের শিকার যে কোনো ব্যক্তি, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন এবং যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, নিরাশ্রয় ব্যক্তি বা ভবঘুরে, যে কোনো উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের লোক। পারিবারিক সহিংসতার শিকার অথবা সহিংসতার ঝুঁকিতে আছেন, এমন যে কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, দুর্বৃত্ত দ্বারা এসিড দগ্ধ নারী বা শিশু।
আদর্শগ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দ প্রাপ্ত ব্যক্তি, অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা এবং দুস্থ মহিলা, যে কোনো প্রতিবন্ধী, বিনা বিচারে আটক অসচ্ছল ব্যক্তি, আদালত কর্তৃক আর্থিকভাবে অসহায় বা অসচ্ছল বলে বিবেচিত ব্যক্তি, জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত বা সুপারিশকৃত অসহায় বা অসচ্ছল ব্যক্তি এবং এ আইনের উদ্দেশ্য পূরণে সংস্থা কর্তৃক চিহ্নিত ব্যক্তি এ সহায়তা পাবেন।
আর যে শ্রমিকদের বার্ষিক গড় আয় এক লাখ টাকার ওপরে নয়, তারাই বিনামূল্যে এ সেবা পাচ্ছেন। অবশ্য আইনি পরামর্শ গ্রহণ ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে শ্রমিকের এই আয়সীমা প্রযোজ্য নয়। শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলে বিনামূল্যের এই আইনিসেবা গ্রহণকারীদের সংখ্যা আরও বাড়বে। বাড়বে সেবার মান।