আদালত পাড়ার গল্প : পাপীর টাকায় নেকী
মো. সাইফুল ইসলাম

পাপীর টাকায় নেকী

১.

– ভাই, একটা ট্রু স্টোরি বলেন! আদালত পাড়ার এমন একটা স্টোরি যেটা আপনাকে বার বার ভাবায়।

– এমন গল্পতো অসংখ্য আছে। তবে আপনার চাওয়ামত ভায়োলেন্স বা থ্রিলার টাইপের ঘটনাগুলো নিয়ে আমি বার বার ভাবি না। বিচারালয়ে এমন কিছু সাদা-মাটা মানুষের ঘটনা পেয়েছি যেগুলো আমাকে বার বার ভাবায়। কিছু কিছু মামলা আমাকে ভাবায় একটা বিচার সমাপ্তির পর পক্ষগণ পরিবারে কেমন থাকে কিংবা সাজা হলে কারাগার থেকে মুক্তির পর তারা পরিবারে ও সমাজে কেমন থাকে?

আজ থেকে তিন বছর আগে আমান ভাইয়ের সাথে কোনো এক বিকেলে কথা বলছিলাম। আমান ভাই রাজশাহীর একজন স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক। আমান ভাই সব সময় পাঞ্জাবীর সাথে গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পড়েন। সেদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মাথা ভর্তি সাদা চুলওয়ালা আমান ভাইকে দেখলেই বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিজীবী লাগে।

ভায়োলেন্সে আমার অনাগ্রহ দেখে বললেন, ”আজ তাহলে সাদা-মাটা মানুষের গল্পটাই শুনি।”

দু’জনেই চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চায়ের কাপের ধোঁয়া উড়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে।

আমি বলা শুরু করলাম…

আজ থেকে ৪/৫ বছর আগের ঘটনা। এজাহারকারী তার ভাই-বোন ও নাতিকে নিয়ে দাওয়াত খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে একটি ট্রাকের সাথে তাদের ব্যাটারি চালিত অটো ভ্যানের এক্সিডেন্ট হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় এজাহারকারীর ১৩ বছর বয়সী প্রিয় নাতি সবুজ।

তৎপ্রেক্ষিতে এজাহারকারী জলিলুর রহমান ট্রাক ড্রাইভার দুলালের বিরুদ্ধে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন। জলিলুর রহমান রাজশাহীর একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। লোকটি এতই সরল ও সাদা মনের যে এলাকার মানুষ তাকে টানা চারবার নির্বাচিত করেছেন।

মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণকালে লক্ষ্য করলাম, এজাহারকারী আসামির নাম না বলে কোনভাবে ঘটনাকে সমর্থন করেই সাক্ষ্য দিলেন। বিষয়টা এমন যে ঘটনা সত্য। কিন্তু কোন আসামী অপরাধ করেছে তা তিনি জানেন না। অথচ তিনি মামলার চাক্ষুস সাক্ষী। আসামি পক্ষের জেরায় বললেন, আসামির প্রতি তার কোন অভিযোগ নেই।

সাধারণত এক্সিডেন্টের এই মামলাগুলো ঘটনার পর পরই আদালতের বাইরে আপস হয়। স্থানীয় মটর মালিক সমিতি মালিকের পক্ষে নিহতের পরিবারের সাথে দেন-দরবার করে। উভয়ের সম্মতিক্রমে ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে আপস হয়ে যায়। এজাহারকারীর জেরার বক্তব্য শুনে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, ”আসামীর সাথে আপস হয়েছে কিনা?” তিনি বললেন, ”আপস হয় নি।”

এজাহারকারীকে বললাম, “তাহলে আমি আপনাদের মধ্যে আপস করার উদ্যোগ নেই। কিছু ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা করি।”

তিনি বললেন, ”না স্যার। আমি কোনো ক্ষতিপূরণ চাই না। যে চলে গেছে তা আর কোন কিছুর বিনিময়ে পূরণ হবার নয়।”

আমি বললাম, “তাহলে কি আপনি আসামির শাস্তি চান?”

তিনি বললেন, “না স্যার, চাই না।”

এজাহারকারীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত হলাম। অপরাধীর সাথে আপস হয়নি কিন্তু ফরিয়াদি তার শাস্তিও চায় না, তার কাছে ক্ষতিপূরণও চায় না; এমন ব্যতিক্রমী মামলা আমি আগে কখনো পাইনি।

২.

এজাহারকারীর সাথে মামলার অন্যান্য স্থানীয় সাক্ষীগণও এসেছেন। তারা সকলেই বললেন, তারা ঘটনা দেখেন নি। এক্সিডেন্টের কথা শুনেছেন। সবাই যেন আসামীকে খালাস করার মহড়া দিলেন। তাই এই মামলাকে আর টেনে লাভ নেই। মামলার ফলাফল যখন দিবালোকের মত স্পষ্ট তখন তা অঙ্কুরেই সমাহিত করা উচিত। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ সমাপ্ত করা হলো।

আসামি দুলাল বুঝতে পেরেছেন তাকে দোষী সাব্যস্ত করার মত কোনো সাক্ষ্য নেই। তিনি খালাস পেতে চলেছেন। তবু নিয়মের খাতিরে তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তার কোন বক্তব্য আছে কিনা?

আসামি কোনো সাফাই সাক্ষ্য দিবে না জানালেন। আমি তাকে বললাম, “দেখুন, আপনার দোষে হোক আর অটোওয়ালার দোষেই হোক, এক্সিডেন্টটা হয়েছে। এবং এই এক্সিডেন্টটা আপনার ট্রাকের মাধ্যমেই হয়েছে। আপনার বিবেক কী কখনো নাড়া দেয় না যে, আপনি ভুল করেছেন। আপনার কী কখনো মনে হয় না আপনি আরেকটু সতর্ক হলে একটি জীবন বেঁচে যেত।”

আসামী ডক থেকে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছে।

আমি তাকে আরও বললাম,”দেখুন, মামলার রায়ে যাইহোক আপনার দ্বারা কোনো ভুল হয়ে থাকলে, কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তার জন্য অনুশোচনাবোধ থাকতে হবে সবার আগে। এজাহারকারীর কোনো দাবী নেই সত্য। কিন্তু আপনার মধ্যে যদি অনুশোচনাবোধ আসে, তবে আপনার মধ্যে প্রায়শ্চিত্তমূলক কাজ করতে ইচ্ছে জাগবে, ছেলেটার পরিবারে বা তার এলাকায় কিছু সেবামূলক কাজ করতে ইচ্ছে জাগবে।”

আসামী দুলাল আমার কথাগুলো শুনে নীরব-নিথর- নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আসামীপক্ষের আইনজীবী মি: এম কুমার আমার কথাগুলোই তাকে রিপিট করলেন। আসামী কোনো কিছু না বলে চলে গেলেন।

৩.

দু’ সপ্তাহ পর রায়ের দিন এলো। আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় খালাস দেওয়া হলো। বেঞ্চ সহকারী অন্য মামলা ডাকবে এমন সময়…

আসামি বললেন, “স্যার, আমার কিছু কথা আছে।”

আমি মনে মনে ভাবলাম, খালাস পাওয়ার পর মানুষের কী কথা থাকতে পারে। নিশ্চয়ই তাড়াতাড়ি রায় হওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাবে। কিন্তু আমার ভাবনায় ভুল ছিল।

আসামী বললেন, “স্যার, আমি ট্রাক ড্রাইভারী ছেড়ে দিয়েছি। এখন রাজমিস্ত্রীর কাজ করি। আমি ছেলেটার এলাকায় তার নামে একটা টিউবওয়েল বসাতে চাই”।

আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি লোকটা! কারো কোন দাবী নেই, তবুও খালাস পাবার পরে কিভাবে মানুষ এটা করতে পারে!

মনে পড়ে গেলো নন্দিত ও কালজয়ী লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর বিখ্যাত উক্তিটির কথা। তিনি বলেছিলেন,” তুমি একটা খারাপ কাজ করেছো তার মানে তুমি একজন মানুষ, তুমি সেই খারাপ কাজটার জন্য অনুতপ্ত তার মানে তুমি একজন ভাল মানুষ।”

৪.

এতক্ষণে আমান ভাই নড়েচড়ে বসলেন। কোনো রকম শাস্তি, ভয়-ভীতি কিংবা প্রলোভন ছাড়া একজন অপরাধী নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলল তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।

আমান ভাই বললেন, “ভাই, দুলালকে নিয়ে লিখতে চাই। উনার ঠিকানা পাওয়া যাবে?” আমি বললাম,” নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। রেকর্ড খুজলেই পাওয়া যাবে”।

আমি অফিস স্টাফ ইউসুফকে রেকর্ড খোঁজার দায়িত্ব দিলাম।

উনি আরো জানতে চাইলেন,”আসামী দুলাল খালাস পাওয়ার পরে তার প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন করেছিল কিনা? ”

বললাম,”এটাতে আদালতের কোনো নির্দেশনা ছিল না। তাই সেটা মনিটরিং করার উপায় ছিল না। আসামীর বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে তাকে শর্তসাপেক্ষে প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া যেত। কমিউনিটি সার্ভিস অর্ডার দেওয়া যেত। তখন সেই শর্তগুলো তিনি প্রতিপালন করছেন কিনা তা প্রবেশন কর্মকর্তা/প্রয়োগকারী কর্মকর্তা মনিটরিং করতে পারতো। যেহেতু তিনি স্বেচ্ছায় দিতে চেয়েছেন, তাই সেটা তাকেই বাস্তবায়ন করতে বলেছি।”

জানতে চাইলেন,”বিদেশে দেখি বড় বড় তারকা অপরাধীরা আদালতের নির্দেশে কমিউনিটিতে সমাজসেবামূলক কাজ করেন। আমাদের দেশে কোন আইনে এমন সুযোগ আছে কিনা?

বললাম,”একাধিক আইনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আদালত কর্তৃক এমন আদেশ দেওয়ার সুযোগ আছে। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন, ২০১০ এর ৩১ ধারানুসারে আদালত দণ্ডিত ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে সমাজকল্যাণমূলক কাজে সেবা প্রদানের আদেশ দিতে পারেন এবং দন্ডিতের উপার্জিত আয় হতে যৌক্তিক পরিমাণ অর্থ সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা তার নির্ভরশীলদের দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন। এছাড়া ১৯৬০ সালের দ্য প্রবেশন অফ অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স অনুসারেও পরোক্ষভাবে সমাজকল্যাণমূলক কাজের আদেশ দেওয়া যায়। তবে কাজটা যেন অপরাধ এবং অপরাধীর সাথে সম্পর্কযুক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় – সেটা দেখতে হবে। ”

উনি জিজ্ঞেস করলেন,”আসামীপক্ষের আইনজীবী কখনো কী এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন?”

বললাম,” হ্যাঁ, একদিন অন্য এক মামলার শুনানীকালে মি. কুমার বললেন আসামী তার কথা রেখেছে।”

ইতোমধ্যে ইউসুফ এসে বললেন, “স্যার, রেকর্ড পাওয়া গেছে।”

রেকর্ডের শুরুতেই এজাহারের প্রথম পৃষ্ঠায় এজাহারকারী জলিলুর রহমানের মোবাইল নম্বর পাওয়া গেল।

ইউসুফ কথা বলে জানলেন, দুলাল এজাহারকারীকে ০৬ মাস আগেই সেই এলাকায় টিউবওয়েল বসানোর জন্য ২৫,০০০ টাকা দিয়েছে। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে টিউবওয়েল বসানো হয় নি। সেই টাকা দিয়ে কী করেছেন জানার আগে এজাহারকারীর কাছে দুলালের মোবাইল নম্বর নেওয়া হলো।

দুলালকে ফোন করা হলো। দুলাল জানালেন, তিনি রায়ের পর নিজে গিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে ২৫,০০০ টাকা দিয়েছেন। তিনি আর ট্রাক চালান না। লোকাল রুটে ভ্যান চালান। সকাল সকাল সবজির ভ্যান নিয়ে বাজারে পৌঁছে দেন।

আমান ভাই হতাশ হয়ে গেলেন। লং রুটের ড্রাইভারী ছেড়ে আবার সে লোকাল রুটের ড্রাইভার হয়েছে যেটা আরো ঝুঁকিপূর্ণ।

৫.

আমান ভাই ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে গেলেন। কিন্তু আমার মধ্যে দুলালকে নিয়ে তীব্র আগ্রহের সৃষ্টি হলো।

ইউসুফকে আবারও ফোন করতে বললাম। এবার নিজেই দুলালের সাথে কথা বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন তিনি রাজমিস্ত্রীর কাজ ছেড়ে দিলেন?

দুলাল উত্তর দিলেন,” স্যার, ট্রাক এক্সিডেন্টের পর আমি রাজমিস্ত্রীর কাজ করতাম। কিন্তু একদিন মেয়র সাহেবের (সম্ভবত তানোর মুন্ডুমালা পৌরসভা) বাসায় কাজ করতে গিয়ে পায়ে ইট পড়ে যায়। আমার পায়ের হাড় ভেঙে যায়। আমি অনেক দিন কোনো কাজ করতে পারিনি। কিন্তু বউ-বাচ্চা আছে। সংসার তো চালাতে হবে। তাই এখন ভ্যান চালাই।”

জিজ্ঞেস করলাম, আপনি যে টাকাটা চেয়ারম্যান সাহেবকে দিয়েছিলেন সেটার কী হলো?

বললেন,”আমি টাকাটা ২৫,০০০ টাকা চেয়ারম্যান সাহেবকে দিয়েছি। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে টিউবওয়েল বসানো যাচ্ছিল না। পরে উনি এলাকার জামাতে কথা বলে স্থানীয় মসজিদে একটি সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছেন।”

আমিও নিজেও অবাক হয়ে গেলাম তার কথা শুনে। কী হওয়ার কথা ছিল, আর কী হলো! একজন অপরাধীর তওবা আল্লাহ এমনভাবে কবুল করেছেন যে একটি প্রবহমান দানকে তার ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন।

ইউসুফকে বললাম, চেয়ারম্যান সাহেবকে ফোন করার জন্য। চেয়ারম্যান সাহেব বিস্তারিত বললেন। দুলালের কথার সাথে চেয়ারম্যান সাহেবের কথা মিলে গেল। চেয়ারম্যান সাহেব আরও জানালেন, সেই এলাকায় টিউবওয়েলের পানিতে প্রচুর আয়রন। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ কষ্ট পাচ্ছিল। এজন্য আশেপাশের শত শত মানুষ প্রতিদিন মসজিদের এই পাম্প থেকে বাসা-বাড়ীর জন্য পানি নিয়ে যায়। শত শত মানুষ ওজু করে।

চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে আমার শরীরে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো। ডোপামিনের প্রভাবে মুহূর্তেই আমার সারা শরীরের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। আপাদমস্তক একটা গরম হাওয়া বয়ে গেল। এটা ৪/৫ সেকেন্ড হবে। এরপর সারা শরীরে একটা ঠান্ডা স্রোত। আমি কল্পনায় চোখের সামনে সেই পাম্পের শীতল পানি দেখতে পাচ্ছি। সেই প্রথম এবং শেষ। এরপর এই অনূভুতি আর কখনো হয় নি। আমি এখনও মাঝে মাঝে সেই অনুভূতিকে খুঁজে বেড়াই।

লেখক : মো. সাইফুল ইসলাম; অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।

বি.দ্র. সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত। পক্ষগণের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। আইনী পরিভাষার কারণে কিছু ডায়ালগ ব্যাখ্যা করে লেখা হয়েছে।